ফার্মি প্যারাডক্স: মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণের খোঁজে

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

শরতের শুভ্র-নীল বিকেলে পেঁজা তুলোর মতো আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে একঝাঁক শান্ত মেঘেদের দল। চারিধারে বিরাজ করছে এক স্নিগ্ধ-মনোরম পরিবেশের আবহ, যা ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে ঐ অবারিত আকাশের পানে। সাঁঝের আঁধারে সুশীতল বাতাসের তোড়ে আমাদের চক্ষুযুগলে ধরা দিচ্ছে এক আকাশ সমান রহস্য। একে দুইয়ে ফুটতে শুরু করেছে রাতের আকাশের ফুল, দূরের আলোকের দল, অগণিত তারকারাজি। যারা ঝলমল করছে ঐ বিশাল অন্তরীক্ষে।

ভালো করে দেখলে বুঝবেন, রহস্যময় এ পরিবেশ মিলেমিশে আছে আকাশের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। যেন গ্রামীণ নারীর শ্যামল শাড়ির আবরণে ঢাকা পড়েছে পুরো আকাশমণ্ডলী। হ্যাঁ, এটিই আমাদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এখানকার ছোট্ট একটি গ্রহ পৃথিবী, যেখানে মাটি ও পানির সংস্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে প্রাণের স্পন্দন। তৈরি হয়েছে সজীব প্রকৃতি।

প্রাচীন ভারতীয়রা আকাশের এই ধুসর গোধূলীমাখা অংশের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন তাদের পৌরাণিক নদী গঙ্গাকে। আর তাই তো এর নাম দিয়েছিলেন আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। গ্রীকদেরও মনে হয়েছিল, সে পথে ছড়িয়ে আছে দেবী অ্যান্ড্রোমিডার জমাটবাধা দুগ্ধ। নাম দিলেন মিল্কিওয়ে। খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন গ্রীক বীরদের গল্প, জিউস-হারকিউলিসের রূপকথার উপাখ্যান!

নক্ষত্রখচিত এই আকাশের পানে কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই দেখবেন, অজানা সুখে ভরে উঠবে মন। শীতল স্পর্শে ভালো লাগা কাজ করবে হৃদয়ে। কখনো আবার মনিকোঠায় জাগবে প্রশ্ন, কতই না ক্ষুদ্র আমাদের এই ধরণী, কী আছে ঐ দূরের তারাদের জগতে? আজ থেকে ৭৫ বছর পূর্বে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মিরও এমনটাই মনে হয়েছিল? খাবার খেতে খেতে মনে প্রশ্ন জেগেছিল- ওরা কোথায়?

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ; ছবি সূত্র: Space and Research

প্রশ্নের সূচনার কথা

মে, ১৯৫০। ফুলার লজ রেস্টুরেন্ট। লস আলামস, যুক্তরাষ্ট্র।

গ্রীষ্মের অলস দুপুরে খাবার খেতে বসেছেন চার বিজ্ঞানী। তারা হলেন- এডওয়ার্ড টেলার, হার্বার্ট ইয়র্ক, এমিল কোনোপিনস্কি ও এনরিকো ফার্মি। তখনকার সময়ে তারা প্রত্যেকেই একেকজন পুরোধা বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যমণি এনরিকো ফার্মি, যিনি কি-না নিউক্লীয় বিক্রিয়ার জনক। খাবারের একপর্যায়ে সবাই ফ্লাইং সসার নিয়ে মেতে উঠলেন আলোচনায়। এর পেছনে একটি কারণও রয়েছে অবশ্য। কী সেই কারণ?

কিছুদিন হলো নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় স্থাপন করা হয়েছে বেশকিছু ট্র্যাশবিন। দিন দুয়েকের ব্যবধানে কে বা কারা অতি সন্তর্পণে বিনগুলো সরিয়ে ফেলছে। এ নিয়ে নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে কতগুলো ব্যঙ্গচিত্র। সেখানে দেখানো হয়, আকাশ থেকে নেমে এসেছে এক ভিনগ্রহী ফ্লাইং সসার। এর ভেতর থেকে বেয়ে আসা ভিনগ্রহের বাসিন্দারা ডাস্টবিনগুলো নিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গেই ঠাট্টাচ্ছলে জমে উঠলো আলাপচারিতা। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্যেও নাকি শোনা যাচ্ছিল ফ্লাইং সসার দেখার গল্প-গুজব। কাজেই চার বিজ্ঞানীর আলোচনা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক ছিল না।

একসময় আলোচনা মোড় নিল অন্য পথে, এগোতে লাগলো পৃথিবীর মতো গ্রহ প্রাপ্তির সম্ভাবনা, সে গ্রহে প্রাণের উদ্ভব, বুদ্ধিমান প্রাণীর আবির্ভাব, সভ্যতার বিকাশ, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন এবং রেডিও সিগন্যাল পাঠানো ও গ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে। এছাড়াও আলোর বেগে চলমান স্পেসশিপ নিয়েও চললো কথাবার্তা কিছুক্ষণ। একপর্যায়ে ফার্মি টেলারকে জিজ্ঞেস করলেন- এডওয়ার্ড, বলো তো, আগামী দশ বছরে আলোর বেগে চলমান বস্তুর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? দু-দণ্ড ভেবে নিয়ে টেলার উত্তর দিলেন, ১০-৬!

মুখে মুখে হিসেব কষছেন বিজ্ঞানীরা এবং সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন- সম্ভাবনাগুলোতো বেশ বড়! তাহলে তো এতোদিনে মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বুদ্ধিমান প্রাণীতে ছেয়ে যাওয়ার কথা আমাদের সৌরপরিবার৷ কিন্তু কই, একটির ও তো দেখা মেলে না। বাজখাঁই স্বভাবের ফার্মি তখন আনমনে বলে উঠলেন- কোথায় সবাই? (Where is Everybody?)। 

পরবর্তীকালে ফার্মির এই প্রশ্নটিই হয়ে উঠে বিখ্যাত। ব্যাপক সাড়া জাগায় জ্যোতির্বিদদের ভাবনায়। সেসময় যারা বহির্বিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণী খুঁজছিলেন, তাদেরকেও নতুনভাবে ভাবায় এটি। গবেষকরা এর নাম দেন ফার্মির হেঁয়ালি বা ফার্মি প্যারাডক্স। চলুন আজ এই রহস্যময় প্রশ্নটিরই উত্তর খোঁজা যাক। যাত্রা করা যাক মহাবিশ্বের পানে, বুদ্ধিমান প্রাণের সন্ধানে।

পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি; ছবি সূত্র: Alone Alien

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ

শুরু করা যাক আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ দিয়েই। মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশে একেই দেখতে পাই আমরা। কিন্তু জানেন কী, দু-চোখ ভরে আমরা ঠিক কতগুলো তারকা দেখি? দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে দাঁড়িয়ে আমরা ২৫০০ এর কাছাকাছি তারকার দেখা পাই, যা এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ১০০ মিলিয়ন ভাগের মাত্র ১ ভাগ। আর দূরত্বের হিসেবে, টেলিস্কোপের সাহায্যে এখন অবধি আমরা পৌঁছাতে পেরেছি ছায়াপথের ১ ভাগ পর্যন্ত, যা ১০০ আলোকবর্ষ দূরত্ব।

তার মানে, ছায়াপথের ৯৯ ভাগ এখনো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। অথচ এই এক ছায়াপথেই আছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র! বিজ্ঞানীদের অভিমত, সর্বদা প্রসারিত হওয়া এই মহাবিশ্বে ঠিক একই পরিমাণ, অর্থাৎ ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন ছায়াপথও রয়েছে। তাহলে একবার ভাবুন তো, মহাবিশ্বে ঠিক কী পরিমাণ নক্ষত্র বা তারকারাজি রয়েছে?

এতো এতো তারকাদের কারো কারো জগতে নিশ্চয়ই আছে নিজস্ব সৌরপরিবার, আছে গ্রহদের দল। যেখানে সময়ের আপেক্ষিকতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সবকিছু। তার মাঝে কী শুধু সূর্য নামের এই একটি তারকার জগতেই সৃষ্টি হয়েছে প্রাণের স্পন্দন? উন্মেষ ঘটেছে মানুষের মতো বুদ্ধিমান সত্তার? আবির্ভাব ঘটেছে উন্নত সভ্যতার? আমাদের মতো আর কেউ কী নেই ওখানে? কেউ কী নেই!

আমাদের দৃষ্টিসীমার ভেতরের ছায়াপথ; ছবি সূত্র: New Scientist

গাণিতিক বিচার-বিশ্লেষণ

আকাশগঙ্গা ছায়াপথের তুলনার পর এবার চলুন একটু বৃহৎ পরিসরে পরিভ্রমণ করি। তবে, বলে রাখা ভালো, এবার কিন্তু আমরা আগাবো কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতে, গড়পড়তা হিসেব করে। কেননা, কারো পক্ষেই মহাবিশ্বের সকল গ্রহ-নক্ষত্র গণনা করা সম্ভব না। জ্যোতির্বিদরাও অনুমানের ভিত্তিতেই হিসেব কষেছেন। তুলে ধরেছেন সম্ভাব্য সহজতম গণনা। সেখানে অল্পকিছু গোঁজামিল থাকলেও খুব বেশি পার্থক্য নেই। চলুন তাহলে শুরু করা যাক। 

পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বে মোট ছায়াপথের সংখ্যা ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন। আবার, একটি ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যাও ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন। অর্থাৎ, মহাবিশ্বে মোট নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ১০২২ থেকে ১০২৪ টি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এতগুলো নক্ষত্রের মধ্য থেকে ৫ থেকে ২০ শতাংশ নক্ষত্র গঠন-প্রকৃতি, তাপমাত্রা ও উজ্জ্বলতার মাপকাঠিতে আমাদের সূর্যের মতো। আমরাও সর্বদা ছোট সংখ্যাগুলো (১০২২ ও ৫) নিয়েই হিসেব করবো। তাহলে মহাবিশ্বে সূর্যের মতো মোট নক্ষত্রের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন বিলিয়ন।

বিদ্যমান এসব নক্ষত্রের সবার পরিবারে নিশ্চয়ই নেই পৃথিবীর মতো এমন উপযুক্ত একটি গ্রহ, তাই-না? যেখানে সঞ্চিত আছে প্রাণের সুষম উপাদান, অবস্থান করছে সূর্য থেকে এক নির্ধারিত দূরত্বে। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিটি নক্ষত্রের চারপাশে পৃথিবীর মতো গ্রহ থাকার সম্ভাবনা অর্ধেকেরও বেশি (৫০ শতাংশ)। আবার সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, এই অনুপাত ২২ শতাংশ। পূর্বের মতো আমরা এখনো কম ধরেই হিসেব করি। তাহলে মহাবিশ্বে পৃথিবী সদৃশ গ্রহ রয়েছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বিলিয়ন।

চলুন আরও আগানো যাক। সৌরজগতে আমাদের মাতৃগ্রহ পৃথিবী তৈরির প্রায় ১ বিলিয়ন বছর পর এখানে সৃষ্টি হয়েছে প্রাণের স্পন্দন। ধরে নিই সেসব পৃথিবী সদৃশ গ্রহের অন্তত ১ শতাংশে উদ্ভব ঘটেছে প্রাণের। আরও ধরে নিই, প্রাণধারী এসব গ্রহের মাত্র ১ শতাংশ গ্রহে বিকাশ ঘটেছে মনুষ্য প্রজাতির মতো বুদ্ধিমান প্রাণের। এর মানে হলো মহাবিশ্বে মানুষের মতোই উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে ১০ মিলিয়ন বিলিয়ন। ভাবা যায়!

বুদ্ধিমান প্রাণের খোঁজে তাক করা এন্টেনা; ছবি সূত্র: SETI

পরিশেষে

পেছনে পড়ে থাক সুদূর মহাবিশ্ব। একই হিসেব অনুযায়ী আমাদের আপন ছায়াপথেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর মতো ১ বিলিয়ন গ্রহ, যেখানে আছে ১ লক্ষের কাছাকাছি বুদ্ধিমান সভ্যতার সম্ভাবনা। আমেরিকান এলিয়েন গবেষণা সংস্থা ছেটি (SETI) এরকম বুদ্ধিমান প্রাণের খোঁজে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০ সাল থেকে মহাকাশের পানে তাক করিয়ে রেখেছে নিজেদের এন্টেনা। হয়তো সে দিন বেশি দূরে নয়, যে দিন তারা সাড়া দিবে প্রেরিত সিগন্যালের, কিংবা নিজেরাই প্রেরণ করবে নিজস্ব যোগাযোগ বার্তা। নয়তো মনের গহীনে আবারও জাগবে প্রশ্ন- তবে ওরা কোথায়?

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 383-বার পড়া হয়েছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা

  • মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ  অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

    মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

  • আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

    আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

  • ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

    ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

  • কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

    কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

  • মহাবিশ্বের জ্যামিতি ও অন্তিম পরিণতি

    মহাবিশ্বের জ্যামিতি ও অন্তিম পরিণতি

  • খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি: কতটা ভয়ংকর?

    খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি: কতটা ভয়ংকর?


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading