সুবিশাল এই মহাবিশ্ব আমাদের সামনে রহস্যের এক বিরাট জাল বুনে রেখেছে। রাতের আকাশের দিকে তাকালে রহস্যের গভীরতা আরও টের পাওয়া যায়। এই রহস্যের জাল সবসময় ছিঁড়তে চেয়েছে মানুষ। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ কৌতূহলী চোখে রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়েছে। চেনার চেষ্টা করেছে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা নক্ষত্ররাজিকে।
বর্তমানে আকাশ পর্যবেক্ষণের বিষয়টা কমে গিয়েছে। মানুষের এই ব্যস্ত ও যান্ত্রিক সময়ে নিজের দিকে তাকানোরই সময় হয় না আর তো আকাশ। শহরের আলোকদূষণ আকাশ পর্যবেক্ষণকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তারপরও কিছু মানুষ আছেন যারা মহাবিশ্বকে বুঝতে চান। জানতে চান নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশকে। এই জানার কাজটা বেশ সহজ হয়ে যেতো এই বিষয়ে পর্যাপ্ত বই থাকলে। বাংলা ভাষায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেরকম বই নেই বললেই চলে। আব্দুল জব্বার স্যারের “তারা পরিচিতি” দারুণ বই এই বিষয়ে। কিন্তু এই বইটা নতুনদের জন্যে নয়।
চলতি বইমেলায় প্রকাশিত দীপেন ভট্টাচার্য স্যারের লেখা “আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই” দারুণ এক উপহার আকাশ পর্যবেক্ষকদের জন্যে। যারা নতুন নতুন তারা পর্যবেক্ষণ শুরু করতে চান তাদের জন্যে গাইডলাইন এই বই। এই বিষয়ে লেখা আগের বইগুলো অনেক পুরোনো। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দারুণ একটা বই এটা। বইয়ের ভেতরে কি আছে সেখানে যাওয়ার আগে লেখক সম্পর্কে একটু বলে নেয়া যাক। আমি লেখককে চিনি আব্দুল জব্বার জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মশালার মাধ্যমে। এই কর্মশালার মাধ্যমেই করোনায় অনলাইনে তাঁর ক্লাস করার সৌভাগ্যও হয় আমার। সেখানেই লেখকের বোঝানোর ক্ষমতার পরিচয় হয়ে যায়। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানকে বাংলায় এতো সহজে উপস্থাপন করা যায় তা লেখকের পড়ানো না দেখলে বিশ্বাস হতো না। লেখকের এই বোঝানোর ক্ষমতা পুরো মাত্রায় তাঁর বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অসাধারণ বাংলার দক্ষতা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের মতো বিষয়কেও অনেক সহজ করে দিয়েছে। একদিকে মানুষের মনে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের বাসনা জাগানোর ইচ্ছে আর অন্যদিকে তাঁর পাণ্ডিত্য এই দুটি বিষয় বইটিকে নিয়ে গেছে এক অন্য মাত্রায়। পাঠক এই বইয়ে এতো সাবলীল ভাবে গভীরে চলে যাবেন যে বুঝতেই পারবেন না।
এবার দেখা যাক বইয়ে আছে কি। যারা আকাশকে বুঝতে চান, কৌতূহলী চোখে রাতের আকাশের দিকে তাকান এই বই তাদের জন্যে। যারা নতুন নতুন আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করতে চান তাদের জন্যে এটা গাইডলাইন। এই বইয়ে মোট অধ্যায় রয়েছে ২২ টি। অধ্যায় গুলো খুব বড় নয়। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে লেখক নক্ষত্র পর্যবেক্ষণে নিজের অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। গামা রশ্মি নিয়ে গবেষণার সময় তাঁর কর্কট নীহারিকা (Crab Nebula) পর্যবেক্ষণের দারুণ বর্ণনা রয়েছে। প্রথম অধ্যায় খুব সহজেই পাঠককে বোঝাতে সক্ষম হবে কি কারণে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ মনে আনন্দ এনে দেয়। এরপর মহাকাশ নিয়ে কিছু ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে।
এরপর নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ নিয়ে মূল অংশ শুরু হয়েছে। শুরুতে তারাদের গতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে পৃথিবীর আহ্নিক আর বার্ষিক গতি ছাড়াও সূর্যের গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে চলার গতিসহ আরো অনেক বিষয় আছে। এই অংশে একজন আকাশ পর্যবেক্ষকের মাথায় কি কি থাকা উচিত তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া নক্ষত্রদের স্থানাংক, উজ্জ্বলতা সহ আরো অনেক বিষয় রয়েছে যা আকাশ পর্যবেক্ষণে জরুরি। তার সুন্দর বর্ণনা রয়েছে এই অংশে।
এছাড়া রয়েছে বাইনোকুলার ও দূরবীনের বিশদ বিবরণ। মানুষের একটি বড় ধারণা ভালো মানের টেলিস্কোপ ছাড়া আকাশ পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয় । লেখক দেখিয়েছেন শুধু বাইনোকুলার দিয়েও দারুণ আকাশ দেখা যায়। এই অংশ পড়লে পাঠক বিস্তারিত ধারণা পাবেন এই বিষয়ে। তাছাড়া টেলিস্কোপের খুব ভালো বিবরণ রয়েছে এই অংশে। এই বইয়ে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ছবিগুলো বাংলায় করার ব্যাপারটা। এমনকি হারৎস্প্রুং-রাসেল ডায়াগ্রামের বাংলা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে।
বইয়ে রাতের আকাশে থাকা নক্ষত্রমন্ডলীর পরিচয় দেওয়া হয়েছে দারুণভাবে। প্রথমে ঋতুভিত্তিক আকাশের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কোন সময়ে আকাশে কোন নক্ষত্র মন্ডলী থাকে তা দেখানো হয়েছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো লেখক সহজে চোখে পড়ে এমনসব নক্ষত্রমন্ডলীর বর্ণনা দিয়েছেন। মানে শহরের এই আলোকদূষণেও আপনি তাদের শনাক্ত করতে পারবেন। যেমন সপ্তর্ষি, কালপুরুষ এদের চেনা সহজ অন্যদের চেয়ে। এছাড়া নীহারিকা, স্টার ক্লাস্টার সহ আরো অনেক কিছুর বর্ণনা রয়েছে। এই সব জানার জন্যে বইটি অবশ্যই আগ্রহী পাঠকের পড়া উচিত।
দারুণ এই বইয়েও আমার মনে হয়েছে কিছু জিনিস আরো ভালো করা যেতো। এই বইয়ে বাংলার ব্যবহার চমৎকার। কিন্তু লেখক কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন যা এখন আর প্রচলিত নয়। যেমন ইনারসিয়াকে (Inertia) লিখেছেন জাড্য কিন্তু এখন ইনারসিয়া জড়তা নামেই বেশি পরিচিত। নতুন পাঠকদের জন্যে এই ধরনের বাংলা বোঝা একটু জটিল হবে। তাছাড়া অনেক টেকনিক্যাল শব্দ লেখক ব্যবহার করেছেন যা নতুন পাঠকদের বোঝা কঠিন করে দিতে পারে। তাই বইয়ের শেষে একটি শব্দার্থ তালিকা থাকলে ভালো হতো। এছাড়া হারৎস্প্রুং-রাসেল ডায়াগ্রাম পুরো এক পৃষ্ঠা হলে ভালো হতো। এই বইয়ের আরো একটি সমস্যা হলো অতিমাত্রায় সংক্ষিপ্ততা। লেখক লিখতে গিয়ে অনেক কিছুই লেখেননি যা পাঠকের মনে কিছুটা হলেও অতৃপ্তি রেখে দেবে। আশা করি লেখক সামনে বড় পরিসরে আলাদা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই লিখবেন।
বইয়ের নাম- আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই
প্রকাশক- প্রথমা
লেখক- ড. দীপেন ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য- ৩০০ টাকা
পৃষ্ঠা- ৯৫
Leave a Reply