অমরত্ব, মানবজাতির এক লালিত আকাঙ্ক্ষা। আর এই আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ন নিয়ে রচিত “অমরত্বের ইতিবৃত্ত” একজন জীববিজ্ঞান প্রেমী ও অপ্রেমী উভয়েরর কাছেই সুপাঠ্য হবে। বই নিয়ে আলোচনার আগে আপনাদের কয়েকটা যুক্তি দেই এবং তার প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন করি। বলুন তো, মানুষ বুড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কেন রোগ-অসুস্থতা বাড়ে? এর একটা কারণ হলো যত বয়স বাড়ে তত বেশি কোষ বিভাজিত হয়, আর কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ রেপ্লিকেশন হয়। এই রেপ্লিকেশনসহ যাবতীয় কাজ করে প্রোটিন, তবে প্রতিবার সে কিছু ভুল করে যাকে বলে মিউটেশন।
আর এর জন্যই ভুলভাল রিয়েকশন হয়, রোগ হয়। এখন আমাকে বলুন, একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। যেই প্রাণীর দেহ বড় বা কোষ বেশি যেমন মানুষ আর হাতির মধ্যে হাতি, তার কি মেউটেশন বেশি হওয়ার কথা নাকি কম? অবশ্যই বেশি কারণ কোষ বেশি, তাহলে হাতির আয়ু মানুষের চেয়ে কম হবার কথা নাকি বেশি? অবশ্যই কম, কারণ যত মিউটেশন তত ক্যান্সার, রোগ হবে। তার মানে মানুষের চেয়ে হাতির আয়ুষ্কাল কম হবে। কিন্তু বাস্তবতা বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা, হাতির আয়ু বরং বেশি! কিন্তু কেন?
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/Eid-3.png?resize=256%2C320&ssl=1)
আবার আরেকটা পরিপ্রেক্ষি বলি, আমাদের দেহকোষ একটা নির্দিষ্ট কোষ হতে তৈরি। মনে করুন, আপনার একটি অঙ্গ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এখন কি আপনি চাইলে কোনো উপায়ে সেই অঙ্গ নিজের দেহ থেকে তৈরি করতে পারবেন? কি মনে হয়? “অমরত্বের ইতিবৃত্ত” বইটি এমন সব অসাধারণ প্রশ্নে আপনার ভাবুক মনকে প্রাঞ্জল করে রাখবে। এখন আসি, এই বই নিয়ে আমার ভাবনায়। বইটি পড়ার প্রতি মুহূর্তে আমি একটা আকর্ষণ অনুভব করেছি সামনে এগিয়ে যাওয়ার। কি হবে এই প্রশ্নোত্তরে আমি বিভোর ছিলাম। জীববিজ্ঞানের অনেক বিষয় লেখক যথাযথ পারদর্শীতার সাথে লিখেছেন। যেমন: টেলোমিয়ার ক্ষয়ের অংশে তাঁর ব্যাখ্যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। টেলোমিয়ার হলো ক্রোমোজোমের কিছু অতিরিক্ত অংশ যেগুলো জোড়া লেগে ক্রোমোজোম ক্রোমাটিন তন্তু গঠন করে। তবে এর একটা বিরাট ভূমিকা আছে কোষ বিভাজন বা বয়স বৃদ্ধির সাথে। যত কোষ বিভাজন হবে, টেলোমিয়ার ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে থাকবে। আর এই ক্ষয়ের ফলে কোষে মিউটেশন কম হয়।
কারণ প্রতিবার ডিএনএ রেপ্লিকেশনে প্রোটিনগুলো কিছু ভুল করে, কখনো কিছু অংশ বাদ দিয়ে দেয়। এই বাদ দেওয়া বা ভুল করার ফলে উলটা পালটা প্রোটিন তৈরি হয় বা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন তৈরিই হয় না। আর এর ফলে দেহে নানান সমস্যা দেখা দেয়। মূলত টেলোমিয়ারের ফলে এ জাতীয় সমস্যা কিছুটা কম হয় একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। আর এই পুরো ঘটনাটা লেখক, আলসে বন্ধুর বই কপি করা দিয়ে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ প্রোটিনগুলো হচ্ছে আলসে বন্ধু যারা বই কপি ( ডিএনএ রেপ্লিকেশন) করার সময় শেষের কয়েক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে দেয়। আলসে বন্ধু যাতে বইয়ের (ডিএনএ) কিছু অংশ বাদ দিলেও মূল জিনিস বাদ না যায় তাই বইয়ের শেষে কিছু সাদা পেজ যুক্ত থাকে আর এই সাদা পেজই টেলোমিয়ার!
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/03/image-11.png?resize=405%2C405&ssl=1)
এ ছাড়া ডিএনএ রেপ্লিকেশন, মিউটেশন জনিত তার ব্যাখ্যাও ছিল সাবলীল ও চমকপ্রদ। মোদ্দাকথা, জীববিজ্ঞান একটা বোরিং বিষয়, এই বইটা পড়ে আমার মনেই হয় নি! এটা সম্পূর্ণ লেখকের মৌলিকত্ব ও সৃজনশীলতার পরিচায়ক। তার উপর লেখকের গবেষণার বিষয় হওয়াতে বইয়ে গভীর ভাবনার খোরাকটা খুব সুন্দরভাবেই সজ্জিত ছিল। বইয়ের আরেকটা সুন্দর ব্যাপার হলো, প্রতিটি অধ্যায়ের শেষ নতুন অধ্যায়ের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলে। এত সুন্দর ধারাবাহিকতা খুব কমই দেখা যায়!
এবার আসা যাক কিছু অতৃপ্তির কথায়। প্রথমত, বইটিতে সাবলীল ও সুন্দর উদাহরণগুলো কিছু প্রশ্নের জাগরণ ঘটায়। যেমন, ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় ডিএনএ পলিমারেজ প্রোটিন প্রতি দশলক্ষ অক্ষরে একবার ভুল করে। কেন এই ভুল হয়? কেন হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে না? আর প্রতি দশলাখে একটা ভুল হয় এটাই বা আমরা কিভাবে জানলাম অথবা বলা যায়, নিশ্চিত হলাম? তারপর টেলোমিয়ার ক্ষয়ই বা কেন হয়? কেন প্রোটিনগুলো স্কিপ করে যায় প্রতিলিপি তৈরির সময়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় নি। এছাড়াও কিছু জায়গায় বানান ভুল ছিল, যা প্রুফ রিডের মাধ্যমে পরবর্তীতে সংশোধন করলে ভালো হবে।
এবার বইয়ের গঠনটা নিয়ে একটু বলা যায়, বইয়ের বাইন্ডিংটা প্রচন্ড সুন্দর। তবে এর কারণে আমার মনে হয় বইয়ের মূল্যও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু বইয়ের গাঠনিক সজ্জা, প্রিন্টিং, কাগজ সবকিছুই সুন্দর। এই ছিল “অমরত্বের ইতিবৃত্ত” নিয়ে আমার খানিকটা আলোচনা। তবে আলোচনার সমাপ্তিতে, আমি আমার মনে আসা আরেকটা প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, বইটা পড়ার সময় এই প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়েছে-
ধরুন, আমি মারা যাব বা মারা গেলাম। তখন যদি আমার দেহে কিছু জীবিত কোষ থাকে, তবে সেই কোষকে স্টেম কোষে রূপান্তর করে কি সম্পূর্ণ আমাকে তৈরী করা সম্ভব? আমার অস্তিত্ব, স্মৃতি রক্ষা করে কি আমাকে অমর করা সম্ভব?
একনজরে-
বইয়ের নাম- অমরত্বের ইতিবৃত্ত
লেখক- শামীম মোন্তাজিদ
প্রকাশক- মাতৃভাষা প্রকাশ
পৃষ্ঠা- ৮৭
মুদ্রিত মূল্য- ৩০০ টাকা
Leave a Reply