হাজার হাজার বছর ধরে চাঁদ মানুষকে সময় ও ঋতুর হদিশ দিয়ে আসছে। আকাশে চাঁদের নিয়মিত চক্র এক বছরে মাসের সংখ্যা ঠিক করে নিতে সাহায্য করেছে। ঋতুর পরিবর্তনের বিষয়টি খেয়াল রাখতেও চাঁদ মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। এবং ধর্মীয় উৎসবের আরম্ভের উদ্বোধন নিজের অজান্তেই করে আসছে এটি।
ইসলাম ধর্মানুসারীরা চন্দ্রমাস মেনে তাঁদের উৎসব পালন করেন। ১২টি চন্দ্রমাসকে বলা হয় হিজরি সন। ইসলামি এই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী আকাশে একফালি (অর্ধেক) চাঁদ দেখা সাপেক্ষে শুরু হয় মাস। যেমন, এক মাসের রোজার সাধনা শুরু হয় রমজান মাসের চাঁদ দেখে। আবার ২৯ বা ৩০ দিন পর শাওয়াল মাসের একফালি চাঁদে ইদ উৎসব শুরু হয়। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানকে রমজান ও ঈদ-সহ ইসলামিক ঘটনা এবং উৎসবের অংশ করে নিয়েছে।
চাঁদের পর্যায়গুলো
চাঁদের নিজের কোনও আলো নেই। তবুও সে রাতে আলো ছড়ায়। যাকে আমরা জ্যোৎস্না বলি। এই আলো সে পায় সূর্যের কাছ থেকে। সূর্য থেকে পাওয়া আলো প্রতিফলিত করে। চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রাকৃতিক উপগ্রহ। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সেটি নিয়মিত ঘোরে। নিজের কক্ষপথে স্বাভাবিকভাবেই চাঁদ একেক সময় একেক জায়গায় অবস্থান করে। ফলে সূর্যের আলো সেভাবেই চাঁদের গায়ে পড়ে। কখনও বেশি আলো পড়ে তো কখনও কম। আলোকিত অংশ সবসময় সমান হয় না। পৃথিবী থেকে সারা মাস ধরেই চাঁদের আকার পরিবর্তন হতে দেখা যায়। এই আকার গুলোই একেকটি ফেজ বা পর্যায়। চাঁদের পর্যায়।
চাঁদের আটটি পর্যায়। শুরুটা হয় ‘নতুন চাঁদে’। সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবী মুখোমুখি থাকে এ পর্যায়ে। তাই সূর্যের আলোয় চাঁদ আলোকিত হয় না। এখানে কথার ফাঁকি রয়েছে। চাঁদ কিন্তু ঠিকই আলোকিত হয়। সূর্য ও পৃথিবীর সরলরেখায় থাকে বলে পৃথিবী থেকে চাঁদ দেখা যায় না। যদি সূর্য থেকে দেখা সম্ভব হতো—তাহলে পূর্ণচাঁদ দেখতে পেতাম। পৃথিবী থেকে এই অদৃশ্য চাঁদই নতুন চাঁদ। একে বাংলায় বলা হয় চাঁদের অমাবস্যা।
দ্বিতীয় পর্যায়ের নাম ‘ওয়াক্সিং ক্রিসেন্ট’। ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া একফালি চাঁদ হিসেবে আকাশে ধরা দেয়। যেখানে চাঁদের পৃষ্ঠের ছোটো একটা অংশ আলোকিত হয়। এবং পৃথিবী থেকে সেই অংশটাই ‘ফালি’ হিসেবে দেখা যায়। এই পর্যায়টিই মূলত চন্দ্রমাস বা ইসলামিক মাসের সূচনা করে দেয়।
তৃতীয় পর্যায়টির নাম ‘ফার্স্ট কোয়ার্টার’। অর্থাৎ প্রথম চতুর্থাংশ। পূর্ণ চাঁদ হওয়ার সফরে আদর্শ অর্ধচন্দ্র এটি। চতুর্থ পর্যায়টিও চাঁদের বৃদ্ধির প্রমাণই দেয়। ‘ওয়াক্সিং গিবাস’ এই পর্যায়ে আলোকিত অংশের বৃদ্ধি চলমান থাকে।
পঞ্চম পর্যায়ে এসে চাঁদের অর্ধেক অংশের পুরো রূপটা দেখা যায়। ‘ফুল মুন’ বা পূর্ণিমা বা পূর্ণচন্দ্র। প্রথম ধাপটি যদি মনে থাকে তাহলে এই ধাপের বিষয়টি ধরা সহজ হবে। এখানে সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ সরলরেখায় থাকে। তাই পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকা অংশটি পুরোটা উজ্জ্বল।
পর্যায় ষষ্ঠ। চাঁদ ছোটো হওয়ার প্রথম ধাপ। ইংরেজিতে ‘ওয়ানিং গিবাস’ বলা হয়। এই ধাপে আলোকিত অংশের কমে যাওয়া স্পষ্ট হয়। পরের ধাপটি তৃতীয় ধাপের মতোই, তবে বিপরীত। সপ্তম এই ধাপটি ‘থার্ড কোয়ার্টার’ বা তৃতীয় চতুর্থাংশ। পূর্ণ চাঁদ কমে কমে অর্ধেকে ঠেকেছে। মূল চাঁদকে এক ধরলে পূর্ণ (উজ্জ্বল) চাঁদ অর্ধেক। তার অর্ধেক এক-চতুর্থাংশ।
সবশেষ, অষ্টম ধাপটি ‘ওয়ানিং ক্রিসেন্ট’—দ্বিতীয় ধাপের হুবহু, কিন্তু এটিও বিপরীত। কারণ চাঁদের আকার ক্রমশই কমছে। চাঁদের এই আট ধাপের চক্র চলতেই থাকে। এবং পুরো একটা চক্র সম্পূর্ণ করতে ২৯.৫ দিন সময় নেয়।
নতুন ফালি/ক্রিসেন্ট চাঁদটা কী? বিশেষত্ব আছে কি কোনও?
একটা নতুন চক্রের প্রথদ চাঁদ—পৃথিবী থেকে দেখা একফালি সে চাঁদকে ক্রিসেন্ট বলা হয়। এই পর্যায়ে আকাশে সবচেয়ে সরু বাঁকা রেখা হিসেবে পাওয়া যায় চাঁদকে। অর্থাৎ, সূর্যের আলো চাঁদের সরু একটা অংশে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধের দেশ। সেখানে নতুন ক্রিসেন্টের অংশটুকু ইংরেজি বর্ণ উলটো সি-এর মতো দেখায়। একইভাবে দক্ষিণ গোলার্ধে অবশ্য স্বাভাবিক ‘সি’ আকৃতির মতো চাঁদ স্পষ্ট হয়।
যে কারণে বিশ্বে একদিনে ঈদ-রোজা হয় না
নতুন ক্রিসেন্ট মানেই নতুন মাসের শুরু। মাসের পুরো পর্যায় শেষ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৯.৫ দিন। বাড়তি অর্ধেক দিন হিসেবে ধরা হয় অন্যভাবে। কোনও মাসে ২৯ দিন পুরো হয়ে অর্ধেক দিন কম থাকলে তা পরবর্তী মাসের অর্ধেকের সাথে যুক্ত হবে। ফলে পরের মাসে একদিন যুক্ত হয়ে ৩০ হবে। চলমান মাস থাকবে ২৯ দিনেই। চন্দ্রমাস তাই হয় ২৯ দিন নয়তো ৩০ দিনে গণনা করা হয়। এখন মাস কতদিনে হবে, তা নির্ভর করে প্রতি মাসে কত দিনে নতুন ক্রিসেন্ট চাঁদটি প্রথম কবে দেখা যায়—তার ওপর। নিউ ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক ইমাদ আহমেদ বলেন— “প্রতিটি চন্দ্রমাসের ২৯ তারিখে সূর্যাস্তের পর মুসলমানরা চাঁদের সন্ধানে আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখেন।”
এখন যদি কোনও মাসে নতুন চাঁদ ২৯ তারিখেই দেখা যায়, তাহলে মাস শেষ। নতুন মাস শুরু হবে। সেক্ষেত্রে পুরাতন মাসটি ২৯ দিনেরই ছিল। যদি নতুন চাঁদ দেখা না মেলে—মাস ৩০ দিন পুরো হবে। এ জন্যই কোনও বছর রমজান মাস ২৯ তো কোনও বছর ৩০ দিনের হয়।
ওপরের আলোচনা থেকেই বোঝা যায়, ক্রিসেন্ট চাঁদ কখন দেখা যাবে বিষয়টি পুরোটাই বিজ্ঞাননির্ভর। পৃথিবীর সব জায়গা থেকে একই চাঁদ দেখা যাবে এমনও হয় না—সম্ভব নয়। এক সাথে চাঁদ সব জায়গায় সমান বা হুবহু দেখা যায় না বলেই এমন হয়। ক্রিসেন্ট চাঁদের দৃশ্যমান হওয়ার বিষয়টিও স্থান, কালভেদে পরিবর্তন ঘটে। যেমন ঘটে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়। তাই পৃথিবীর সকলে একসাথে এদুটো দেখে না। সম্ভবও নয়। আপনি কোথায় আছেন, তার ওপর ভিত্তি করে আপনার চাঁদ দেখার সম্ভাব্যতা পরিবর্তন ঘটবে। তাছাড়া অনেক দেশের নিজস্ব চন্দ্রবর্ষপঞ্জিও রয়েছে। সে অনুযায়ী তাঁরা সব মেনে চলে। তাই পুরো বিশ্বে এক সাথে রোজা শুরু হয় না। বাংলাদেশে সবসময় আরব দেশগুলোর পরদিন রোজা, ঈদের মতো উৎসবগুলো হয়।
স্পষ্ট ক্রিসেন্ট চাঁদ দেখার তিনটি উপায়
- সূর্য দিগন্তরেখার নিচে পৌঁছানোর পর। ক্রিসেন্ট চাঁদ সরু বলে আলো থাকলে চোখে না-ও ধরা পড়তে পারে। তাই যথেষ্ট অন্ধকার হওয়া চাই।
- চাঁদটিকে থাকা লাগবে দিগন্ত রেখার ওপর।
- আকাশে চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে দূরত্ব যথেষ্ট থাকতে হবে। একে ড্যানজন সীমা বলা হয়। যে সীমায় সূর্য ও চাঁদ ৫-৭ ডিগ্রিতে আলাদা থাকতে হবে। আমাদের হাতের প্রথম তিনটি আঙুলের সৃষ্ট বাহুর দৈর্ঘ্য।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply