কল্পনাবিলাসী মানুষ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন পূরণের পর হাত বাড়ান অনন্ত মহাকাশের পানে। পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে নিঃসীম অন্ধকার মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করার ইচ্ছায় লিপ্ত হন কঠোর গবেষণায়। বিশেষ করে, উন্নত বিশ্বের নীল রক্তের মানুষেরা স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হিসেবে সেসময় বেছে নেন মহাকাশ জয়ের প্রচেষ্টা। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগেন তারা। নামেন তুমুল প্রতিযোগিতায়। যদিও মহাকাশ অভিযানে মানুষের তখনও হাঁটি হাঁটি পা। কেননা, ইতিহাস সৃষ্টিকারী ইউরি গ্যাগরিন তখনও পৃথিবীর কক্ষপথ মাড়াননি। এপোলো-১১ এর নভোচারীরা- নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অল্ড্রিন পাড়ি জমাননি ঝলমলে রূপালী চাঁদের জগতে। কিন্তু কেন?
কারণটা পরিষ্কার। আচমকা একজন মানুষকে রকেটের ককপিটে বসিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া যায় না অজানা মহাশূন্যের ভরশুন্য পরিবেশে। কেউ-ই জানে না কার্বনগঠিত মানবদেহ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে এসে কেমন আচরণ করবে সেখানে। ধরণীর সুরক্ষাচাদর বায়ুমন্ডল ত্যাগ করার সময়ই-বা মানব শরীরে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে। এছাড়াও, মহাজাগতিক অজানা রশ্মির প্রখর বিকিরণ আলস্যপূর্ণ মনুষ্যদেহে রোগব্যাধির জন্ম দেবে কি-না সেসবও অজানা! তাহলে উপায়?
উপায় হিসেবে বিজ্ঞানীরা চিরায়ত পন্থার-ই অনুসরণ করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন- নানারকম পশুপাখি, পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ পাঠানো হোক মহাকাশে।অনেকটা মানব শরীরে সদ্য আবিষ্কৃত ওষুধ প্রয়োগের পূর্বে জীবজন্তুর দেহে প্রয়োগ করে যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার মতো। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মহাকাশ অভিযানে গৃহীত হলো প্রথম পরিকল্পনা। সময়ের ঘূর্ণাবর্তে প্রেরণ হতে লাগলো একের পর এক তৃতীয় শ্রেণীর প্রাণী। যদিও জানেন কী- এমন গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে ব্যবহৃত প্রথমকার প্রাণীরা কারা ছিল?
চলুন দেখে আসা যাক। প্রথম পর্বের আজকের আয়োজনে জেনে আসা যাক মহাকাশ জয়ের অদম্য অভিযাত্রী পোকামাকড় ও পশুপাখিদের গল্প।
ফলমূল খেকো মাছি
১৯৪৪ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়কাল।
বীভৎস মহাযুদ্ধের দামামায় পুড়ছে পুরো বিশ্ব। দূরদর্শী নাৎসি বাহিনীর রণাঙ্গনের সমরাস্ত্র হিসেবে তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইল ভি-২, যার নেতৃত্বে জার্মান বিজ্ঞানী ভন ব্রাউন। দূরপাল্লার এই মিসাইল পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উপর দিয়ে ২০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। আর তাই পৃথিবীর প্রথম স্পেস রকেটের তকমা লেপ্টে যায় ভি-২ এর-ই অদৃশ্য কপালে।
সময় গড়িয়ে যায়, আসে নতুন ভোর। নাৎসি বাহিনীর ভাগ্যাকাশেও উদিত হয় কালো মেঘের ঘনঘটা। মিত্রবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে পুরোদস্তুর ব্যর্থ হয় ভি-২। একসময় পরাজয়ও বরণ করতে বাধ্য হয় তারা। গুণী বিজ্ঞানী ভন ব্রাউন আত্মসমর্পণ করেন আমেরিকান সেনাবাহিনীর কাছে। তাঁকে অতি সন্তর্পণে নিজেদের মানুষ হিসেবে ঘরে তোলে নেয় আমেরিকানরা। অনেক জার্মান বিজ্ঞানীর মতো তাঁর আর বিচার-আচার হয় নি। প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
এর পরের ঘটনা…
ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ সাল। হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জ, নিউ মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র।
নীল আকাশের পানে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে গেলো একটি ভি-২ রকেট। এর অগ্রভাগে সুরক্ষিত স্থানে রাখা হয়েছে তিনটি ফলের মাছি। উদ্দেশ্য- প্রাণীর ডিএনএ-তে মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব কেমন হতে পারে, সেটি পরীক্ষা করা। বিজ্ঞানীদের অভিমত- এই পরীক্ষণ মহাকাশ গবেষণায় খোলে দেবে নতুন দ্বার। সৃষ্টি করবে নিকট ভবিষ্যতে মনুষ্যবাহী রকেট তৈরির অমিয় সম্ভাবনা।
রকেটটির গন্তব্যস্থান বায়ুমন্ডল ও মহাকাশের মাঝামাঝি অবস্থান, যা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ১০৯ কিলোমিটার উচ্চতায়। অনুসন্ধানী রকেট ততটুকু পাড়ি দিতে পারলেই বিজ্ঞানীদের কার্যসিদ্ধ। রকেটও ঠিক সেই সীমানায় পৌঁছে যায়। অতঃপর, খসে পড়ে এর অগ্রভাগ। প্যারাসুটের মাধ্যমে সফলভাবে অবতরণ করে সমুদ্র উপকূলে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, ক্ষুদে মাছিগুলো আবদ্ধ স্থানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে দিব্যি।
রেসাস প্রজাতির বানর
১৯৪৮ সালের জুন মাস। প্রথম স্তন্যপায়ী হিসেবে মহাকাশে এবার যাবে এক মাঝবয়েসী বানর। নাম তার প্রথম আলবার্ট। নির্ধারিত দিনে সদ্য প্রস্তুতকৃত ভি-২ মহাকাশযানে করে বানরটাকে পাঠানো হয় মহাকাশের আদিগন্ত পানে। কিন্তু নভোযান উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণ পরই ভেতরকার পরিবেশ বৈরী হতে শুরু করে। যার প্রভাবে মারা যায় আলবার্ট। ধারণা করা হয়, প্রথম আলবার্টকে বহনকারী রকেটটি ৬২ কিলোমিটার পর্যন্ত উচ্চতায় উঠতে পেরেছিল।
পরের বছরের জুনের ১৪ তারিখ। বিজ্ঞানীরা নব উদ্যমে আবারও প্রেরণ করেন আরেকটি বানর। এর নাম দ্বিতীয় আলবার্ট। রকেট উৎক্ষেপণের পর এবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় সবাই। যদিও এবার দ্বিতীয় আলবার্টকে নিয়ে রকেটটি ঠিকই ১৩৩ কিলোমিটার উপরে গিয়ে মহাশূন্য পরিভ্রমণ শেষে পৃথিবীর পানে ধেয়ে আসে। কিন্তু ফেরার পথে সুরক্ষা প্যারাসুটটি অকেজো হয়ে গেলে প্রচন্ড গতিতে আছড়ে পড়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে। সেখানেই মৃত্যু হয় দ্বিতীয় আলবার্টের।
আলবার্টের সেই অভিযানের পর থেকে এখন অবধি প্রায় ৩২টি বানরকে পাঠানো হয়েছে মহাশূন্যে। যাদের মধ্যে রেসাস ছাড়াও রয়েছে ম্যাকাও, সাইনোমলগ্যাস, পিগ-টেইলড ও স্কুইরেল-টেইলড প্রজাতির বিভিন্ন বানর।
গেছো ইঁদুর
১৪ অগাস্ট, ১৯৫০ সাল। শরৎকাল।
বানরের পর এবার বিজ্ঞানীরা মহাকাশে ইঁদুর প্রেরণে তোড়জোড় শুরু করেন। পাঠিয়েও দেন প্রথম গেছো ইঁদুর। এটিকে বহনকারী রকেটটি একদম ১৩৭ কিলোমিটার উপরে উঠে যায়৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দ্বিতীয় আলবার্টের ভাগ্য তাকেও বরণ করতে হয়। একই মাসের শেষ তারিখে আবারও প্রেরণ করা হয় আরেকটি সমগোত্রের ইঁদুর। কিন্তু সে অভিযানও পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়।
দমে যান নি বিজ্ঞানীরা। ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করে চেষ্টা করতে থাকেন একের পর এক। এবং অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯৬০ সালের ১৯ আগস্ট সফলভাবে একইসঙ্গে উৎক্ষেপিত হয় ৪৪টি শ্বেত ইঁদুর। জীবিত অবস্থায় তারা প্রত্যেকেই ফিরে আসে ধরণীর বুকে। এর মাধ্যমে মহাশূন্যের প্রতিকূল পরিবেশে মানুষেরা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, তার বিশদ ধারণা পায় মহাকাশ গবেষকেরা। যা পরবর্তী গবেষণায় কাজে আসে ব্যাপকভাবে।
কুকুর সাইগান ও ডেজিক
এবার সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের পালা। আমেরিকানরা যখন একের পর এক প্রাণী মহাকাশে প্রেরণ করছিল তখন তারা ব্যস্ত নিজেদের গবেষণাগার গুছিয়ে নিতে। তবে এই সময়টুকু খুব বেশিদিন গড়ায় নি। এরইমধ্যে নিজেদের গুছিয়ে নেয় তারা। ১৫ আগস্ট ১৯৫১ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মহাকাশে একত্রে প্রেরণ করে দু’টি কুকুর। এদের নাম সাইগান ও ডেজিক।
মহাশূন্যের রহস্যময়তাকে এরাই প্রথম ছুঁতে পেরেছিল। ঘুরে এসেছিল এক অনন্য দূরত্ব। অতঃপর নিরাপদে অবতরণ করে ভূপৃষ্ঠে। সে বছর সেপ্টেম্বরে তাদেরকে পুনরায় অভিযানে পাঠানো হলে সে যাত্রায় প্রাণ হারায় ডেজিক। তাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয় গবেষণাগারের পাশে শুভ্র ফুলের বাগানের এককোণে।
দুঃসাহসী লাইকা
লাইকার কথা মনে আছে আপনাদের? যাকে অনেকেই চেনেন প্রথম মহাকাশ ভ্রমণকারী কুকুর হিসেবে। ১৯৫৭ সালের প্রারম্ভের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ গবেষকেরা দুরন্তপনায় মেতে থাকা লাইকাকে খুঁজে পায় ছোট্ট একটি রাস্তার মোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে একে কোলে করে নিয়ে আস হয় গবেষণাগারে। ধীরে ধীরে একে অভ্যস্ত করা হয় নানাবিধ প্রশিক্ষণে। ৩ নভেম্বর লাইকাকে পাঠানো হয় মহাকাশে।
লাইকাই প্রথম প্রাণী যে কি-না পরিভ্রমণ করে আসে মায়াময় ধরণীর কক্ষপথ। যদিও পৃথিবীতে ফেরার পর লাইকাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি ধারণা করা হয়, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মাত্র ২৪ ঘন্টার খাবার আর ৭দিনের অক্সিজেন সরবরাহ দিয়ে একে তুলে দেওয়া হয়েছিল রকেটে। আর তাই অনাহারে-অর্ধাহারে ও অক্সিজেনের অভাবে অনন্ত পরপারে পাড়ি জমায় লাইকা। তার এমন নিদারুণ মৃত্যু ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিল তখনকার বিশ্ববাসীকে।
ব্যাঙ ও গিনিপিগ
১৯৬১ সালের মার্চের শুরুর ঘটনা। অত্যাধুনিক আকাশযান করাব্ল-স্পুটনিককে তৈরি করা হচ্ছে অত্যন্ত সুশ্রী রূপে। যেন এখনই ছুটে যাবে হাওয়ার তোড়ে, ডানা মেলে। হারিয়ে যাবে অনন্ত ঊর্ধ্বাকাশে। কিন্তু না! কিছুটা সময় নিয়েই পরিপাটি করা হচ্ছে সবকিছু। কিন্তু কেন?
আসলে মহাকাশ অভিযানের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হবে যানটি। যেখানে একসঙ্গে ভ্রমণ করবে অনেক প্রকার প্রাণী। এরা হলো- ব্যাঙ, গিনিপিগ, ইঁদুর আর চেরনুস্কা নামের ফুটফুটে এক কুকুরছানা। কিন্তু এতগুলো ভিন্ন প্রাণী একসঙ্গে কেনো? আসলে একই নভোযানে মহাকাশ অভিযানে আলাদা আলাদা প্রাণীর উপর কেমন প্রভাব পড়ে সেটিই দেখতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা৷
এই ঘটনার পর ১৯৭০ সালে নাসা পুনরায় দু’টি ব্যাঙকে মহাকাশে প্রেরণ করে। ষষ্ঠ দিনের মাথায় এগুলোও সফলভাবে ফিরে আসে পৃথিবীতে।
সাগরের মাছ
১৯৭৩ সাল। নাসার এপোলো-১১ মিশন ইতোমধ্যেই সফলতার মুখ দেখেছে। মানুষ প্রথমবারের মতো পাড়ি জমিয়েছে দূরের মহাকাশে, উপগ্রহে। স্পর্শ করেছে চাঁদের মাটি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মাথায় উঁকি দিচ্ছে ভিন্ন ভাবনা। কী সেটি?
তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর মাছ মহাকাশে নিজেদের অভিযোজন করতে পারে কি-না। এরই লক্ষ্যে তাঁরা প্রেরণ করে একঝাঁক হৃষ্টপুষ্ট সাগরের মৎস। সঙ্গে পাঠান মাছের সদ্য পাড়া ডিমও। দেখতে চান রেডিয়েশনের প্রতি কেমন প্রভাব দেখায় এগুলো।
সর্বশেষ ২০১২ সালে জাপান আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে একটি সুরক্ষিত অ্যাকুরিয়াম প্রেরণ করে। যেখানে ছিল স্বচ্ছ ত্বকবিশিষ্ট মাদেকা মাছ। গবেষণার উদ্দেশ্যেই মূলত সেটিকে প্রেরণ করা হয় সেখানে।
পরিশেষে
অনন্ত মহাকাশের আদিগন্ত রহস্য উন্মোচন ভাবুক মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এক চির রোমাঞ্চকর প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টার শুরুটা হয়েছিল ছোট্ট এক মাছিকে নিয়ে, যা এখনো চলমান, চলবে অনিঃশেষকাল পর্যন্ত। অজানাকে জানার ইচ্ছা, অদেখাকে দেখার প্রচেষ্টা, আবিষ্কারের সুমহান সংকল্প, মহাকাশ অভিযানকে প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সফলতার সুউচ্চ শিখরে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply