লক্ষ লক্ষ বছর আগে আমাদের এই প্রাচীন পৃথিবীকে শাসন করেছে এমন দানবের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে ডায়নোসরের কথা। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর এক মহাদানব দাপিয়ে বেড়িয়েছিলো সারা পৃথিবীর সাগর মহাসাগর। হ্যাঁ, আমাদের বঙ্গোপসাগরও বাদ রাখে নি। যার নাম মেগালোডোন। যার আকার বর্তমান গ্রেট হোয়াইট শার্কের প্রায় তিন গুণ। এরা সর্বোচ্চ ৭০ ফুটের মত পর্যন্ত লম্বা হতো, যেখানে একটি হোয়াইট শার্ক হতে পারে সর্বোচ্চ ২৫ ফুট।
এরা এতটাই হিংস্র ছিল যে জন্ম নেওয়ার আগে মায়ের পেটের ভেতরই ভাই বোনদের খাওয়া শুরু করে দিতো। রোমহষর্ক বৈচিত্র্যে ভরপুর এই দানবরা ছিলো সেই সময়ের সর্বোচ্চ স্তরের শিকারী। চলুন, গল্পে গল্পে জেনে আসা যাক এই প্রগৈতিহাসিক সমুদ্রদৈত্যকে। মেগালোডনকে তার বিশাল দেহকে পরিপুষ্ট রাখার জন্য প্রতিদিন হাজার কিলোর বেশি খাবার খেতে হতো। আর, সেই খাবারের তালিকা থেকে বাদ পড়তো না ডলফিন, সি কাউ, সি লাউন, কচ্ছপ থেকে শুরু করে তিমি-হাঙররের মত দানবরাও। এই বিশাল প্রাণীগুলোকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য তার ছিলো ত্রিভুজের মত লম্বা দাঁত। যেগুলো সর্বোচ্চ ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারত, যা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের হাতের তালুর সমান। মেগালোডনদের আমাদের মতো ৩২ টি নয়, বরং ২৭০টিরও বেশি এরকম সুঁচালো দাঁত ছিলো।
পাঁচটি সারিতে তৈরী হতো তাদের মুখের চোয়াল। আর এই চোয়াল দিয়ে শিকারের গায়ে যেই কামড় বসাতো তার ভর ছিলো ১৮০০০ কেজি। এত জোর কামড় পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীই দিতে পারত না। এমন কি ডায়নোসরও না। আসলে, এজন্যেই এদের নাম হয়েছে মেগালোডন। মেগালোডন মানে বড় দাঁত। চোয়াল দুটো হা করলে তার প্রস্থে হতো প্রায় এগারো ফুট, এবং দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় সাত ফুট, সুতরাং জনা দুয়েক পূর্ণবয়স্ক মানুষকে এক গ্রাসে মুখে পুরে নেওয়া মেগালোডনের জন্য কোন ব্যাপারই ছিলো না।
আরো মজার বিষয় হলো, এই সমুদ্র দৈত্যের একটি দাঁত পরে গেলে, মাত্র দু তিন দিনেই সেখানে নতুন দাঁত গজিয়ে উঠতো। এভাবে এদের আয়ুষ্কালে প্রায় চল্লিশ হাজার বার নতুন দাঁত গজাতো। সমুদ্রের তলদেশে এদের দাঁতের অজস্র ফসিল চাপা পরে আছে। হ্যাঁ, শুধু এন্টার্কটিকা ছাড়া বাকি সব মহাদেশের সাগরে এদের বিচরণ ছিলো, এমন কি আমাদের ঘরের কাছে বঙ্গোপসাগরেও। সুতরাং আপনি সী বিচে ঘুরতে গিয়ে যদি সৌভাগ্য বশত মেগালোডনের দাঁতের ফসিল পেয়ে থাকেন, তাহলে তা ওখানে ফেলে চলে আসবেন না। কারণ বিশ্ব বাজারে বেশ ভালো দামেই এই প্রাগৌতিহাসিক দাতগুলো বিক্রি হচ্ছে। যেখানে একটা সাড়ে ছ ইঞ্চি দাঁতের দাম সাড়ে চার শ ডলারের মত। ভাবা যায়!!
আরেকটি আশ্চর্যজনক তথ্য হলো, এই যে আমি মেগালোডনের ব্যাপারে এত তথ্য বর্ণনা করলাম, বাস্তবে তাকে আমরা কেউই দেখি নি, এমনকি ডায়নোসরের মত তাদের হাড়ের ফসিলও পাওয়া যায় নি। এই অবধি যা পাওয়া গেছে সবই এদের দাঁতের ফসিল। অতঃপর, এই দাঁতগুলোকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই বিজ্ঞানীরা আজব প্রাণীটির ব্যাপারে এত তথ্য দিয়েছেন। এগুলোর কোনটাই মন গড়া তথ্য না ৷ এমন অনেক প্রাচীন তিমির ফসিল পাওয়া গেছে, যাদের হাড়ে এই মনস্টারের দাতের ছাপ বা পুরো দাতই গেঁথে বসে আছে।
সেই দাঁতের আকৃতিকে বিশ্লেষণ করলেও বুঝা যায় প্রাণীটির চোয়াল কত বড় হবে, সেই চোয়াল দিয়ে কত বড় প্রাণী সে শিকার করতে পারবে, সেই শিকারকে হজম করার জন্য কত বড় পাকস্থলী লাগবে, আবার সেই স্পাকস্থলীকে গঠন করার জন্য কত বড় শরীর হতে হবে, এরকম আরো অনেক কিছু। আসলে, বিজ্ঞানীরা গোয়েন্দার মত। ছোট একটা ক্লু পেলেই, বাকি ঘটনার নাড়িভুড়ি তারা বের করে আনে।
যাই হোক!
কথা হচ্ছে, এই সমুদ্র দৈত্য গুলো এত বড় শারীরিক গড়ন পেলো কি করে?
গবেষণা হতে জানা গেছে, মেগালোগডনের বাচ্চা গুলোর যখন জন্ম হয়, তখনই এদের আকার প্রায় দশ ফুটের মত হয়। শৈশবেই এত বড় আকার পাওয়ার কারণ হলো স্ত্রী মেগালোডন যখন গর্ভাবস্থায় থাকে, তখন তার পেটের ভেতর অনেক বাচ্চা আগে আগে ডিম হতে বের হয়ে আসতো। যেহেতু তাদেরও বেড়ে উঠার জন্য যথেষ্ট খাবারের প্রয়োজন ছিলো, তারা মায়ের পেটের ভেতরেই তাদের দুর্বল ভাই বোনকে খাওয়া শুরু করত। আর, অস্ফুটিত ডিমগুলোও সাবার করে দিতো । এভাবেই তারা প্রচুর পরিমাণের পুষ্টি উপাদান পেত; আর জন্ম থেকেই হয়ে উঠতো বিশালদেহের অধিকারী। কিন্তু, ভাইবোনদের খেয়ে ফেলার জন্য অনেক ডিম থেকে অল্পসংখ্যকই মাছে পরিপক্ব হতে পারত।
এবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলচোনায় আসা যাক।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সমুদ্রকে শাসন করা এই সমুদ্র অধিপতিরা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলো কেন?
এর পেছনের রহস্য নিয়ে বেশ কয়েকটি ধারণা রয়েছে বিজ্ঞান মহলে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উল্লেখ করছি। প্রথমত, প্রায় ২৬ লক্ষ বছর আগে যখন বরফ যুগ পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছিল, তখন পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেক কমে এসছিল। ফলে হিমবাহের পরিমাণ বাড়ছিল, আর সমুদ্রের উপরিভাগ বরফ হয়ে এসেছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই অগভীর পানিতে মেগালোডনরা বাচ্চা জন্ম দিত, আর লালনপালন করত যতদিন না তারা পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠে। কারণ গভীর জলে হোয়াইট শার্ক, টাইগার শার্কের মত চালাক শিকারীদের হাতে বাচ্চারা শিকার হওয়ার ভয় থাকে সবসময়। তো, সমুদ্রের উপরের অঞ্চল বরফে ঢেকে যাওয়ায় বাচ্চা গুলো তাদের বাসস্থান হারিয়ে গভীর সমুদ্রে আশ্রয় নেয়।
এরপর তাই হল, যা হওয়ার কথা। তারা শিকারী তিমি, সাদা হাঙর সহ বিভিন্ন প্রাণীদের প্রধান শিকারে পরিণত হল, এভাবে এই প্রজাতির বড় একটা অংশ হুমকির মুখে পড়ে গেল। সেই শিকারী তিমি আর হাঙররা, মেগালোডনের বাচ্চাদের শিকারের পাশাপাশি অন্যান্য জলজ জীবকেও মেগালোডনের চেয়ে দ্রুত শিকার করে ফেলত। ফলে মেগালোডনের জন্য খাবারের পরিমাণ খুব কমে গেছিল। গবেষকরা ধারণা করছেন, অবশেষে ক্ষিধে মেটানোর জন্য নিজেদের বাচ্চাদেরও ভক্ষণ করা শুরু করেছিল মেগালোডনরা। এভাবে সংখ্যা কমতে কমতে একসময় তারা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলো, আর কখনো ফিরে আসেনি।
এসব ছাড়াও, সেই বরফ যুগে পৃথিবীর টেকটোনিক প্ল্যাটের উল্লেখযোগ্য নড়াচড়ার ফলে সমুদ্রের মধ্যে ব্লকেজ তৈরি হয়। যে কারণে সামুদ্রিক প্রাণীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়। যা তাদের বিচরণে বেশ সমস্যা তৈরি করে। তাছাড়া মেগালোডনের অনেক শিকার সেই ব্লকেজের অন্য পাশে আটকা পড়ে যায়। এর পাশাপাশি, সে সময় টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যৎপাতেরও সৃষ্টি হয়, সবমিলে সমুদ্রের ইকোসিস্টেমে লক্ষনীয় পরিবর্তন ঘটে। যার নেতিবাচক প্রভাব মেগালোডনের বিলুপ্তির পেছনে ভুমিকা রাখে। পাশাপাশি আরো একটি সমস্যা ছিলো। সমুদ্রের বড় একটা অংশ হিমবাহে পরিণত হওয়ার কারণে, জলের পরিমাণ কমে এসছিলো। অবশিষ্ট জলে লবণের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। জলের উপাদানের তারতম্যের কারণে জলের গতিও পাল্টে গেল। ফলে অনেক প্রাণী মানিয়ে নিতে না পেরে মারা যায়।
যেমন- অনেক প্রজাতির তিমি সেই সময় বিলুপ্ত হয়ে যায় সমুদ্রের ইকোসিস্টেম পরিবর্তনের কারণে। এদিকে, তিমি মেগালোডনের প্রধান খাবার ছিল। আর যেই তিমি গুলো বেঁচে ছিল তারা টিকে করার জন্য গরম জল থেকে ধীরে ধীরে শীতল জলের দিকে চলে যেতে থাকে। কিন্তু মেগালোডন শীতল জলের সাথে মানিয়ে নিতে পারতো না। (ঠিক যেই কারণে এন্টার্কটিকা মহাদেশে তাদের ফসিল পাওয়া যায় না।) যার নেতিবাচক প্রভাব মেগালোডনের অস্তিত্বের উপর পড়েছিল, যেহেতু ইকোসিস্টেমে একটি প্রাণী অন্য প্রাণীর উপর নির্ভরশীল। তা হলে, কি বুঝলাম? এই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটির বিলুপ্তির পেছনে একটি নয়, বরং কয়েকটি কারণ একসাথে কাজ করছিলো।
যদিও এখনও মাঝে মধ্যে শোনা যায়,“মেগালোডনরা এখনো বেঁচে আছে, তারা আবার ফিরে এসেছে।” এসব সত্য হলে বেশ চমকপ্রদ হতো। কিন্তু এগুলো নেহাতই গুজব। কারণ তারা বেঁচে থাকলে আমরা তাদের বর্তমান সময়ের ফসিল পেতাম। কিন্তু এ পর্যন্ত মেগালোডনের যেসকল দাঁতের ফসিল পাওয়া গেছে, তা কোটি বছরের পুরোনো। তারা সম্পুর্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে। তাদের আর বিবর্তন হয় নি। আমাদের পৃথিবীতে প্রায় তিন ভাগ স্থল, সাত ভাগ জল। পৃথিবীর জলে ও স্থলে অনেক এপেক্স প্রেডিটর এসেছে আর গেছে। কিন্তু মেগালোডনের মত এপেক্স প্রেডিটর এ পর্যন্ত কখনো আসেনি, ভবিষ্যতেও হয়তো আর কখনো আসবে না।
তথ্যসূত্র-
- Australopithecus sediba | Characteristics & Facts | Britannica
- Discover how climate change and food scarcity may have caused the megalodon’s extinction
- Megalodon is definitely extinct—and great white sharks may be to blame
- Megalodon Shark Nursery Found in Panama – FossilEra.com
- How fast was the megalodon? | ZSL
- Megalodon: the truth about the largest shark that ever lived | Natural History Museum
- Making a megalodon: the evolving science behind estimating the size of the largest ever killer shark
- The Megalodon | Smithsonian Ocean
- https://www.fossilguy.com/topics/is-megalodon alive/index.htm#:~:text=There%20is%20no%20record%2C%20the, fossils%20are%20no%20longer%20present.
Leave a Reply