রাতের আকাশ, মাথার উপরে অনন্ত মহাকাশ, অগণিত নক্ষত্র, দিগ্বিদিক নিরন্তর ছুটে চলা ধুমকেতু, উল্কা ও নিহারীকাসমূহ– এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানব মনে উন্মেষ ঘটিয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিস্ময়কর সুস্থ মস্তিষ্কও কখনো কখনো আশ্রিত হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ কুসংস্কারের। আটকা পড়েছে বিশ্বাস অবিশ্বাসের বেড়াজালে।
তবে, সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক বিজ্ঞানের অপার মহিমায় মহাকাশের সীমাহীন রহস্য আজ অনেকটাই দৃষ্টিগোচর। আর এই রহস্য উন্মোচনের পথকে সুগম করেছে মহাকাশ গবেষকদের নিরলস গবেষণা, বিজ্ঞানীদের অনবদ্য লেখনশৈলী আর সৃষ্টিশীল বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা। তেমনই একটি বিষয় হলো ফার্মি প্যারাডক্স।
পূর্বের আর্টিকেল ফার্মি প্যারাডক্সে আমরা কথা বলেছিলাম আমাদের আপন ছায়াপথে বিদ্যমান উন্নত সভ্যতার সম্ভাবনা নিয়ে। তুলে ধরেছিলাম একটি সম্ভাব্য-সহজতম গাণিতিক বর্ণনা। আজকের লেখায় চলুন আরও বৃহৎ পরিসরে পরিভ্রমণ করে আসি। জেনে আসি বিগব্যাং-এর পর সম্প্রসারমান মহাবিশ্বের বয়সের টাইম স্কেলে সৃষ্টি হওয়া বুদ্ধিমান প্রাণের সংখ্যা, অত্যাশ্চর্য বিভিন্ন সভ্যতা ও তাঁদের পর্যায়গত যত অনবদ্য সম্ভাবনার কথা।
সূচনা
বয়সের পার্থক্য অনুযায়ী আমাদের সূর্য মহাবিশ্বের অন্য নক্ষত্রদের চেয়ে অনেকটাই অল্পবয়সী। সেই সাথে স্বল্পবয়সী এর পরিবারের গ্রহ-উপগ্রহরাও। এই তো সেদিন, সাড়ে চার বিলিয়ন বছর পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে তাদের। কিন্তু জানেন কী- মহাবিশ্বে এমন কতক নক্ষত্রও বিদ্যমান যাদের সৃষ্টিকাল প্রায় আট বিলিয়ন বছর পূর্বে? এদেরকে বৃত্তাকারে পরিভ্রমণকারী গ্রহদের বয়সও প্রায় কাছাকাছি।
এরকম প্রবীণ একটি গ্রহের কথাই ভাবা যাক। ধরা যাক এর নাম ট্র্যাকিয়ন (X)। আরও ধরা যাক, পৃথিবীর মতো ট্র্যাকিয়ন গ্রহেও এক বিলিয়ন বছর পর সৃষ্টি হয়েছে প্রাণের স্পন্দন। প্রায় ৪.৪৫ বিলিয়ন বছর পর উন্মেষ ঘটেছে মানুষের মতো বুদ্ধিমান সত্তার। এ হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর পূর্বেই বুদ্ধিমত্তা, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিজ্ঞানে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থানে ছিল ট্র্যাকিয়ন গ্রহের সভ্যতা।
একবার ভাবুন তো, পৃথিবীর মানবসভ্যতা বিগত একশ বছর পূর্বে কোথায় ছিল, আর আগামী একশ বছর পর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! যেখানে কেবল ৫০ বছরের উন্নতি-ই অবাক করে সবাইকে, সেখানে ট্র্যাকিয়ন গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর এগিয়ে! ভাবা যায়?
মানব মনে আবারও একঝাঁক প্রশ্নের আবির্ভাব- তাহলে তাদের সভ্যতা কোথায় পৌঁছেছে আজ? কিংবা, কোন স্তরেই-বা অবস্থান করছে তাদের বুদ্ধিমত্তা? কোন পর্যায়ে চলমান রয়েছে তাদের জীবনযাপন ব্যবস্থা? চলুন সবিস্তারে এসব জেনে আসি। ঘুরে আসি মহাবিশ্বের রহস্যেমোড়া তাবৎ প্রবীণ গ্রহদের জগৎ থেকে।
বর্ণনা
সময়টা ১৯৬৪ সাল। সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ ও মহাকাশ গবেষক নিকোলাই কার্দেশভ এরকম বুড়ো গ্রহদের পর্যায়গত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পেতে এদেরকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। যদিও পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা এদেরকে বিভক্ত করেন মোট পাঁচটি স্তরে। ট্র্যাকিয়ন-এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে হলে জানতে হবে তাদের শ্রেণিবিন্যাস। এরা হলো- প্রথম<দ্বিতীয়<তৃতীয়<চতুর্থ<পঞ্চম।
বলে রাখা ভালো, এসব শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে মূলত একেকটি সভ্যতার শক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও দক্ষতার উপর।
প্রথম পর্যায়ের সভ্যতা
এরা নিজ গ্রহের সকল শক্তি নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারবে। নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তাবৎ প্রতিকূল পরিস্থিতি। তাদেরকে কাজে লাগাতে পারবে শক্তি উৎপাদনে। এই যেমন- আমরা এখনো শক্তির জন্য ভূগর্ভস্থ মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর নির্ভরশীল, যারা হাজার বছর পূর্বে চাপা পড়েছিল মাটির নীচে। তাপ, চাপ ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাবে তারা পরিণত হয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লায়। রূপান্তরিত হয়েছে উপযোগী শক্তিতে। সেসব ব্যবহার করেই চলছে আমাদের জীবনযাপন।
কিন্তু প্রথম পর্যায়ের সভ্যতার এসবের প্রয়োজন পড়ে না। তারা নিজেদের গ্রহের আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, এমনকি ঘূর্ণিঝড়কেও সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেদিন আমরা তাদের মতো এসবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো, সেদিন আমরাও পরিণত হব প্রথম শ্রেণির সভ্যতায়। এর জন্য বর্তমানের চেয়ে প্রায় এক লক্ষ গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করা জানতে হবে আমাদের। শিখতে হবে আহরিত শক্তির যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহার।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান এর মতে, মহাবিশ্বে আমাদের সভ্যতাগত অবস্থান মাত্র ০.৭! গবেষক ও পদার্থবিদ মিচিও কাকু মনে করেন, আগামী এক শ থেকে দু শ বছরের মধ্যেই আমরা পরিণত হবো প্রথম পর্যায়ের সভ্যতায়। কিন্তু, এত অল্প সময়ে তা কী আদৌ সম্ভব হবে?
দ্বিতীয় পর্যায়ের সভ্যতা
এরা নিজেদের গ্রহের সকল শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যবহার করতে পারবে সূর্যের শক্তিও। কিন্তু কীভাবে তারা করবে এটা? এর জন্য তারা তৈরি করবে এক সুবিশাল ডাইসন স্ফিয়ার। এটি মূলত একধরনের সোলার প্যানেল। ধরা যাক- সূর্য, বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গলকে ঘিরে তৈরি হবে এটি। এই প্যানেলে সূর্যের সকল শক্তি আহরিত হবে, প্রক্রিয়াজাত হবে, এবং উপযোগী এ শক্তি ব্যয় করা হবে পৃথিবীর স্বার্থে। যদিও কিছু শক্তি ডাইসন স্ফিয়ার বিকিরণও করবে।
এছাড়াও, কখনো যদি সুবিশাল কোনো উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর পানে ধেয়ে আসে তখন এই ডাইসন স্ফিয়ার একে প্রতিহত করবে। মুহূর্তেই বাষ্পীভূত করে দেবে এটিকে। এমনকি অনবদ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে তার কক্ষপথ থেকে কিছুটা সরিয়ে ফেললেও হয়ে যাবে কাজ।
তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের সভ্যতা
এবার তৃতীয় পর্যায়ের সভ্যতার বিষয়ে আলোকপাত করি চলুন। ধারণা করা হয়, তারা পুরো ছায়াপথকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ব্যবহার করতে পারবে এর সমস্ত শক্তি। উপনিবেশ স্থাপন করবে পুরো ছায়াপথ জুড়ে। শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহারের তুলনা করলে এরা দ্বিতীয় শ্রেণির সভ্যতা থেকে দশ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি আহরণ করতে পারবে।
অনুমান করুন তো, চতুর্থ শ্রেণির সভ্যতার ক্ষমতা কেমন হবে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এরা সমগ্র মহাবিশ্বের শক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। স্থান-কাল ও সময়কে পরিবর্তন করতে পারবে তারা, নিজেদের ইচ্ছামতো। আর তাই মহাবিশ্বের চির রহস্যময় স্থান কৃষ্ণগহ্বরেও গড়ে উঠবে তাদের বসতি।
আর পঞ্চম পর্যায়ের সভ্যতা হবে অকল্পনীয় ক্ষমতার অধিকারী। অনেকটা সৃষ্টিকর্তার মতো। শুধু এই মহাবিশ্ব নয়, মাল্টিভার্স বা সকল মহাবিশ্বের সকল শক্তিকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে তারা। পদার্থবিজ্ঞানের চিরন্তন সূত্রকে অগ্রাহ্য করে তারা দাপিয়ে বেড়াবে এখান থেকে সেখানে। তৈরি করবে অনন্য সব প্রযুক্তি। ভাবছেন কিসব আবোলতাবোল বকছি? তবে থাক, আর না আগাই। চলুন ফিরে যাই ট্র্যাকিয়ন গ্রহের কাছে।
ট্র্যাকিয়নের উপনিবেশ স্থাপন
বুড়ো ট্র্যাকিয়ন গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন বছর এগিয়ে রয়েছে। এরা যদি কোনোক্রমে নিজেদের তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতায় নিয়ে যেতে পারে তবে এরা নিজেদের ছায়াপথকে এতদিনে আয়ত্তে নিয়ে ফেলার কথা। কিন্তু সেটা কীভাবে? চলুন ছোট্ট একটি হিসেব কষে দেখি।
ধরা যাক, ট্র্যাকিয়নের অনতিদূরে পৃথিবীর মতো একটি বসবাস উপযোগী গ্রহ রয়েছে। যেখানে রয়েছে প্রাণের জন্য সুষম উপাদান। এখন তৃতীয় শ্রেণিতে উন্নীত ট্র্যাকিয়নের বাসিন্দারা মাত্র ২০০ বছরের ব্যবধানে সেখানে পৌঁছে যাবে৷ নির্মাণ করে ফেলবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আন্তঃগ্রহ পরিভ্রমণকারী নভোযান। সেখানে বসতি স্থাপনের পর তাঁরা পুনরায় আরও দুইটি গ্রহের পানে যাত্রা করেছে। সেসব গ্রহেও এরকম ২০০-৩০০ বছরের ব্যবধানে গড়ে তুলেছে নিজেদের উপনিবেশ।
এভাবে এক গ্রহ থেকে দুই, দুই গ্রহ থেকে চার, চার গ্রহ থেকে আট– উপনিবেশ স্থাপনের এ কর্মযজ্ঞ চলবে ছায়াপথের শেষ সীমানা পর্যন্ত! সময়ের সর্পিল গতিতে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে এ কার্যক্রম। অর্থাৎ মাত্র ৩.৭৫ মিলিয়ন বছরের ভেতরেই পু্রো ছায়াপথ জুড়ে তারা তৈরি করে ফেলবে নিজেদের উপনিবেশ। আধিপত্য কায়েম করবে সর্বত্র।
পরিশেষে
মহাবিশ্বের বিলিয়ন বছরের সময় প্রবাহে ৩.৭৫ মিলিয়ন বছর খুবই নগন্য। এর মধ্যে যদি আমাদের হিসেবকৃত এক লক্ষ সভ্যতার অন্তত এক শতাংশও তৃতীয় শ্রেণির সভ্যতায় পরিণত হয়ে থাকে তবে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, প্রতিবেশী এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি কিংবা দূরের কোনো গ্যালাক্সিতেও তাদের দাপিয়ে বেড়ানোর কথা। বিজ্ঞানীদের অভিমত- এরকম সভ্যতার সংখ্যাও হওয়ার কথা অন্তত হাজারখানেক। কিন্তু কোথায়? এত এত মোড়লরা একসঙ্গে বসবাস করা সত্ত্বেও কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেউ-ই দেখতে আসে না আমাদের! প্রেরণ করে না চির আকাঙ্ক্ষিত রেডিও সিগন্যাল।
তবে ওরা কোথায়?
তথ্যসূত্রঃ
- Fermi Paradox – Britannica
- The Fermi Paradox – Wait but Why
- Fermi Paradox: Where are the aliens? – Space.com
- The Fermi Paradox: Where Are All the Aliens? – Britannica
- Carl, L.D., (2019). On the Meaning of Fermi’s paradox. Futures.
- Slijepcevic, P., Wickramasinghe, C. (2021). Reconfiguring SETI in the microbial context: Panspermia as a solution to Fermi’s paradox. Biosystems.
Leave a Reply