ধরা যাক, আপনি কোনো নির্জন পাহাড়ের লাল ইটের সিড়িতে বসে আছেন। চারদিকে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ। সিঁড়িতে ছোট ছোট হলুদ রংয়ের ফুল পড়ে আছে। আর আপনি প্রশান্ত মনে একদম একা একা বসে চা খাচ্ছেন। আর প্রকৃতি উপভোগ করছেন। একই সময় আপনি আবার মহা ব্যস্ত সময় পার করছেন আপনার পড়ার টেবিলে। সামনে আপনার পরীক্ষা। আপনি মনোযোগের সাথে গনিতের প্রশ্ন সমাধান করছেন। আপনি একজন, অথচ একই সময়ে আপনি দুই জায়গায় দুই ভাবে অবস্থান করছেন। এটা কি সম্ভব! না কি নিছক কল্পনা মাত্র।
না কি বলবেন এটা কোনো ক্লান্ত মস্তিষ্কের অবচেতন মনে কোনো সুন্দর, প্রশান্তিকর সময়ের আকাঙ্ক্ষা। যদি বলি সত্যিই আপনি দুই জায়গায় অবস্থান করছেন! হতে পারে এখন পঞ্চম মাত্রা বা ফিফথ ডাইমেনশনে আছেন! তাহলে কি বিশ্বাস করবেন আমার এ কথা? মাত্রা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক থাকলেও “সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব” নামে একটা তত্ত্ব আছে পদার্থবিজ্ঞানে, সেখানে দশটি মাত্রার কথা বলা হয়েছে। গনিতে মাত্রার সংখ্যা অসীম হতে পারলেও তা জ্যামিতিক ভাবে সবসময় আঁকা সম্ভব নয়। তবে সুপারস্ট্রিং থিওরি সত্য হলে উপরের ঘটনার মতো ঘটনা ঘটা আসলেই সম্ভব হবে।
পঞ্চম মাত্রা কী?
পঞ্চম মাত্রা বলতে আলাদা একটা স্থানকে কল্পনা করা হচ্ছে যেটার সৃষ্টি হয় বিগ ব্যাং-এর পরপর। পদার্থবিজ্ঞানে পঞ্চম মাত্রা বলতে খুব ছোট স্থানের একটি ক্ষুদ্র মাত্রা। এরা সাব-এটমিক পার্টিকেল বা পরমাণুর মতো ক্ষুদ্রতম জায়গায় অবস্থান করে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। তাই পঞ্চম মাত্রাকে ধারনাগত, অবলোকনযোগ্য মাইক্রোডাইমেনশনও বলা হয়। তত্ত্ব মতে, এটি স্পেস-টাইমের একটি তল যা নিজের মধ্যেই নিজে বক্রভাবে প্যাঁচিয়ে আছে, সমগ্র মাত্রাটি একটি পরমাণুর চেয়ে ছোট, অনেকটা ঘূর্ণেয়মান লুপের সদৃশ। এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র পরোক্ষভাবে মহাবিশ্বের মৌলিক শক্তিগুলির উপর বিশেষ করে মাধ্যাকর্ষণের তাত্ত্বিক প্রভাবের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের হাইপোথিসিস মতে এটি মাত্র ১০-৩০ (বা ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১) সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের। এটি মানুষের চোখে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য এবং ইলেকট্রন এবং কোয়ার্কের মতো সাবটমিক কণার চেয়েও ছোট।
কালুজা-ক্লেইন থিউরী মতে তাড়িত-চৌম্বক বল ও মহাকর্ষ বলকে একত্র করে পঞ্চম মাত্রার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ বলতে আলোকে বোঝানো হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী আলোকে তাই সময়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হয়। ইনফরমেশন থিওরি মতে, ইনফরমেশনকে পঞ্চম মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারণ এটি স্থান এবং সময়ের অন্যান্য মাত্রার মতো আমাদের চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং বাস্তবতাকে আকার দেয়। যদি মাত্রা বলতে আমরা যা অনুভব করি ইনফরমেশন থিওরির মাত্রা বলতে তা বুঝানো হয় না।
পঞ্চম মাত্রা হিসেবে তথ্য
ইনফরমেশন থিওরিতে, তথ্য নিজেই পঞ্চমতম মাত্রা হিসাবে বিবেচিত হয়। স্থান এবং সময়ের মতো, তথ্যের প্রবাহ জটিল সিস্টেমকে প্রভাবিত করে—আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আমাদের আচরণ, আমাদের প্রযুক্তি। যদিও এই মাত্রা স্থান বা সময়ের মতো নয়। এটি সম্পূর্ণ বিমূর্ত ধারনা। পদার্থবিজ্ঞানে, ইলেকট্রনের মতো মৌলিক কণাগুলি যখন অন্যান্য কণার সাথে যোগাযোগ করে তখন তাপীয় বিকিরণ, ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং আরও অনেক কিছুতে তথ্য সঞ্চয় করে এবং “যোগাযোগ” করে।
পঞ্চম মাত্রা হিসেবে আলো
কালুজা-ক্লেইন তত্ত্ব উচ্চ মাত্রার তত্ত্বগুলির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই তত্ত্বটি ১৯২১ সালে থিওডর কালুজা এবং ১৯২৬ সালে অস্কার ক্লেইন দ্বারা প্রস্তাবিত হয়েছিল। বিজ্ঞানী কালুজা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করেন। তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিজমকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। তিনি দেখান যে যদি আমরা চার মাত্রিক মহাবিশ্ব পরিবর্তে পাঁচ মাত্রিক মহাবিশ্ব বিবেচনা করি, তাহলে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিজম এবং মহাকর্ষের সমীকরণগুলি একই সূত্র থেকে উৎপন্ন করা যেতে পারে। বিজ্ঞানী কালুজার কাজের ওপর ভিত্তি করে আরেক বিজ্ঞানী ক্লেইন প্রস্তাব করেন যে অতিরিক্ত মাত্রাগুলো খুবই ছোট এবং সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় অদৃশ্য থাকে। ক্লেইনের মতে, এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো ‘ক্লেইন সার্কেল’ নামে পরিচিত একটি গোলাকার গঠন করে যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র।
উদাহরণস্বরুপ একটা পাতলা সিলিন্ডারের মতো দ্বিমাত্রিক কাগজ নেওয়া হলে এর দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ পাওয়া যাবে। এখন দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ বরাবর দুই প্রান্ত এক করলে একটি গোলাকার সিলিন্ডারের আকার নিবে। একইভাবে একটা চ্যাপ্টা বাক্স নিলে যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা তিনটাই আছে। তার দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ বা উচ্চতা যেকোনো মাত্রা বরাবর বাঁকিয়ে দুই প্রান্ত লাগিয়ে দিলে বাক্সটি কি গোলাকার হবে না? দেখা যাবে ঐ সিলিন্ডার আকৃতির কাগজ বা বাক্সের পৃষ্ঠে যেভাবেই হোক একটা দাগ টানা শুরু করলে তার শেষ হবে ঐ দাগের শুরুর বিন্দুতে। তাহলে আপনি পেয়ে গেলেন বাকানো মাত্রা সমূহ।
তবে এই বক্রাকৃতির অবস্থা নির্ভর করবে কোন মাত্রাটাকে বাঁকানো হয়েছে তার উপর। যদি বৃত্তটির সাইজ একটি পরমাণুর লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ হয় তাহলে এই বক্র মাত্রাটি চোখে ধরা পরবে না। তেমনি একটা কাগজ নিয়ে ছোটবেলার সেই খেলার মতো ধরে যত ক্ষুদ্র সম্ভব গোল করে ফেললে তাহলে দেখা যাবে গোলাকার কাগজটি পাইপের মতো লম্বা হবে কিন্তু এর বক্রাকৃতির ব্যাস খুব কম থাকায় দূর থেকে এটাকে সরল রেখাই মনে হতে পারে। ঠিক এই জিনিসটাই মাত্রার ক্ষেত্রে ভেবে দেখলে বক্রাকৃতির বল নগন্যই মনে হবে। কালুজা এবং ক্লেইন ঠিক এই কনসেপ্ট নিয়েই গনিত কষে দেখালেন যে ত্রিমাত্রিক জগতের ভেতর আরেকটা ছোট মাত্রা থাকতে পারে এবং সেটি যদি এমন অতি ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের হয় যেটা ধরতে প্লাংকের স্কেলে মাপতে হবে, তাহলে সেটা অনুভূতির বাইরে।
তখন গনিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী কালুজা ও ক্লেইন দেখালেন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের মাধ্যমে যে এই অতিরিক্ত মাত্রা আমাদের ওপর কিছু প্রভাব ফেলে যেমনটা ফেলে গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ নামের বলটি। এবং গ্র্যাভিটির তুলনায় তড়িৎচৌম্বকীয় বল ততটাই শক্তিশালী। তড়িৎ চুম্বকীয় বলের বাহক হলো ফোটন। ফোটন হলো একটি ভরহীন, চার্জহীন কণা। শূণ্যস্থানে আলোর গতিবেগের সমান বেগে ধাবিত হয় এ কণা।
পঞ্চম মাত্রার প্রভাব দৃশ্যমান
ধরা যাক, একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কোনো এক ব্যক্তি কোনো সুইমিংপুলে সাঁতার কাটছেন। যখন জলের ঢেউ উঠে, তখন ব্যক্তিটি পুলের নিচের দিকে ছায়া দেখতে পাবে। কিন্তু ব্যক্তিটির উপরেও তো জলের ঢেউ ছিল। কিন্তু ঢেউয়ের ছায়া পড়ছে না কেন? পঞ্চম মাত্রার তরঙ্গ বা ওঠানামা বাস্তবে আলো বা এমনকি কণা হিসাবে উপস্থিত হয়। এটি আমাদের চতুর্মাত্রিক বাস্তবতায় “ছায়া নিক্ষেপ” করার সময় ৫ম মাত্রা থেকে আমরা যেভাবে মিশ্রিত বা বিকৃত ঘটনাগুলি অনুভব করতে পারি তার অনুরূপ।
জ্যামিতিক পঞ্চম মাত্রা
ত্রিমাত্রিক জগতে যেমন ঘনক, পিরামিড আকৃতি ইত্যাদি পলিটোপ বা জ্যামিতিক আকার বিদ্যামান। তেমনি পঞ্চম মাত্রায় শুধুমাত্র তিনটি সুষম পলিটোপ বিদ্যমান।
- সিমপ্লেক্স পরিবারের ৫-সিমপ্লেক্স : ২০টি মুখ (প্রতিটি একটি সমবাহু ত্রিভুজ)
- হাইপারকিউব পরিবারের ৫-কিউব : {৪,৩,৩,৩}, ৮০টি মুখ (প্রতিটি একটি বর্গক্ষেত্র)
- ক্রস পলিটোপ পরিবারের ৫-অর্থোপ্লেক্স : ৮০টি মুখ (প্রতিটি একটি ত্রিভুজ)
ইন্টারস্টেলার সিনেমায় পঞ্চম মাত্রা
ক্রিস্টোফার নোলানের “Interstellar” সিনেমার প্লট আশা করি সবার জানা। এই সিনেমার কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সময় ও মহাকাশ ভ্রমণকে কেন্দ্র করে। এই সিনেমায় পৃথিবীর ভবিষ্যতকে চিত্রিত করে, যেখানে পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই সংকট মোকাবিলায় একটি দল মহাকাশযানে করে নতুন বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধানে যায়। এই অভিযানের অন্যতম চরিত্র কুপার। শেষ দিকে কুপার একটি ব্ল্যাকহোলে প্রবেশ করে এবং একটি টেসারেক্টে এসে পৌঁছায় যা পঞ্চম মাত্রার প্রতিনিধিত্ব করে। যেখানে সে তার মেয়ে মার্ফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় এবং তাকে সংকেত পাঠায়, যা পৃথিবীকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
টেসারেক্ট হলো একটি চার-মাত্রিক ঘনক (hypercube)। সিনেমার প্লট মতে যা বর্তমান মানুষ নির্মিত নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা উন্নত প্রাণীর তৈরি। এটি সময়কে একটি বস্তুগত আকারে প্রদর্শন করে, যার সাথে সিনেমার নায়ক কুপার তাঁর ইচ্ছা মতো মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। অর্থাৎ সে বিভিন্ন সময় এবং স্থানকে তার ইচ্ছেমতো দেখতে এবং প্রভাবিত করতে পারে। সে মার্ফ-এর শৈশবের ঘরের সময়ের বিভিন্ন মূহুর্তে পৌঁছায় এই বিমূর্ত পঞ্চম মাত্রার উপস্থিতিতে।
লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে পরীক্ষাগুলি পরোক্ষভাবে একটি পঞ্চম মাত্রিক বিশ্ব প্রমাণ করতে পারে। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC) হল ইউরোপের একটি বিশাল কণা ত্বরক যন্ত্র। এটি মাটির ১০০ মিটার (৩২৮ ফুট) গভীরে অবস্থিত। এর মধ্যে বিস্ময়কর গতিতে একেকটি পরমাণুকে একে অপরের বিপরীতে নিক্ষেপ করা হয়। ফলে একে অপরের মধ্যে সাবঅ্যাটমিক কণাগুলো ভেঙে যায় এবং সংঘর্ষ থেকে উদ্ভূত নতুন কণাগুলি নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাত্ত্বিকভাবে, LHC মহাকর্ষের জন্য দায়ী কণা গ্র্যাভিটন তৈরি করতে পারে। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের সাহায্যে এখনও সে কণা খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যহত আছে।
কণার ত্বরণকারীর সংঘর্ষ সর্বদা ভারসাম্যপূর্ণ ঘটনা তৈরি করে, একারনে কণাগুলি সব দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। একটি “খালি অঞ্চল” (বেগ এবং শক্তির ভারসাম্যহীনতা হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে) বলতে হতে পারে যে গ্র্যাভিটনের অস্তিত্ব ছিল এবং দ্রুত ৫ম মাত্রায় চলে গেছে। “খালি অঞ্চল” একটি মাত্রা-হপিং গ্র্যাভিটন ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে এবং এই অনুমান নিশ্চিত করার জন্য সতর্ক গবেষণা প্রয়োজন।
স্ট্রিং তত্ত্বে পঞ্চম মাত্রা
স্ট্রিং তত্ত্ব পরামর্শ দেয় যে আমাদের চতুর্থ মাত্রার বাস্তবতা হল একটি ১০ মাত্রা বিশিষ্ট মহাবিশ্বেরই একটি অংশ। আমাদের ব্রেইনের অতিরিক্ত এ ৬টি মাত্রা পর্যবেক্ষণ করার সক্ষমতা নেই। অন্যরা মনে করেন যে পঞ্চম মাত্রা থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় না এমন কণাগুলি মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটার তৈরি করে। ডার্ক ম্যাটার এমন বস্তু যা মহাকর্ষীয় প্রভাব প্রদর্শন করে কিন্তু এদেরকে অন্যভাবে দেখা সম্ভব হয় না। স্ট্রিং থিওরির মতো মহাবিশ্বের বিভিন্ন পদার্থবিদ্যার মডেল বোঝার জন্য পঞ্চম মাত্রা বেশিরভাগই গাণিতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তথ্যসূত্রঃ
- Mass as the Fifth Dimension of the Universe
- What Is the 5th Dimension? (in Simple Terms)
- Five-dimensional space – Wikipedia
- The Atomicity of Electricity as a Quantum Theory Law – NASA/ADS
কালুজা-ক্লেইন থিউরি নিয়ে আরো জানতে চাইলে Hermann Weyl এর Space-Time-Matter বইটা পড়তে পারেন।
Leave a Reply