বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল এবং দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫ শতাংশেই ফলানো হয় ধান। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধান চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু, আশেপাশের কোনো এক ধান চাষির জীবন পর্যবেক্ষণ করুন। দেখবেন অনেক স্বপ্ন, আশা-প্রত্যাশা নিয়ে সার, বীজ, কীটনাশকের উচ্চমূল্য দিয়ে, কৃষি উপকরণ ও কৃষি শ্রমিকের অভাবসহ, ঋণের বোঝা নিয়ে কৃষক ধান চাষ করেন। পরবর্তীতে মাঝারি ব্যবসায়ীদের শোষণ, নিম্ন দাম ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার অভাবের কারণে তার সেই আশা হতাশায় রূপান্তরিত হয়।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IFPRI) এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রধান খাদ্যশস্য হওয়া সত্ত্বেও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না ধান চাষাবাদ। ধান বিক্রির টাকা ও উৎপাদন খরচ দিয়ে খেয়েপড়ে বাঁচতে পারেন না কৃষক, মানবেতর জীবনযাপন বেছে নিতে হয়। এই কঠিন বাস্তবতা খুবই পীড়া দিত সিলেটের কুলাউড়ার সন্তান, বিখ্যাত ধান গবেষক ড. আবেদ চৌধুরীকে।
কৃষিতে কিভাবে আয় বাড়ানো যায় এবং ব্যয় কমানো যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন ড. আবেদ চৌধুরী। তার এই চিন্তা ও গবেষণারই ফসল ‘পঞ্চব্রীহি’ ধান। যা একবার রোপণে বছরে পাওয়া যাবে পাঁচবার ফলন। শুধুমাত্র একবার চাষ ও বীজতলা তৈরি করতে হয় বলে এই ধান চাষে খরচও হয় কম।
‘পঞ্চব্রীহি’ ধান সম্পর্কে বিস্তারিত
আজ থেকে ১০-১৫ হাজার বছর আগেও ধান চিরজীবী ছিলো। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে ধান বিভিন্ন মৌসুমে ভাগ করে চাষ শুরু করা হয়। ফলে ধানও সেভাবে অভিযোজিত হতে থাকে। বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী চাইছিলেন আম, কাঁঠাল গাছ যেমন দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে, ঠিক তেমনই ধান গাছগুলোকেও দীর্ঘজীবী করা যায় কিনা। ২০১০ সালে প্রথম মৌলভিবাজারের হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটার জমিতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষনা শুরু করেন ড. আবেদ চৌধুরী। সেখান থেকে তিনি প্রথমে নতুন ধানের শিষ হয় এমন ভিন্ন জাতের ১২টি ধানবীজ সংগ্রহ করেন এবং তিন বছর ধরে জাতগুলোর চাষ পর্যবেক্ষণ করেন।
দেখা যায়, নিয়মিতভাবে দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে এই ধানগুলো। এরপর তিনি একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা শুরু করেন এবং তাতেও সফল হন। কিন্তু তার মধ্যে চারটি জাত ছাড়া অন্য জাতগুলো চতুর্থবার ফলনের পর ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর এই ৪ জাতের ধানের ওপর আবারও ১০ বছর ধরে গবেষণা চালান। মূলত স্থানীয় জাতের সঙ্গে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাত এবং স্থানীয় জাতের সঙ্গে স্থানীয় হাইব্রিড জাতের সংকরায়ন করে এই উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত পাওয়া যায়, যা একই গাছে ৫ বার ফলন দিতে সক্ষম হয়। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে কোনোরকম রাসায়নিক ছাড়াই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর তার গবেষণা চালিয়ে যান।
আবেদ চৌধুরী আরও জানান, পঞ্চব্রীহি ধানের গাছ ৫ সে.মি দূরত্ব রেখে রোপণ করতে হয়, যাতে গাছটি গোড়া থেকে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। পঞ্চব্রীহি ধান চাষে প্রথম বার ১১০ দিন পর ফলন আসে। পরের ফলন আসে ৪৫ দিন অন্তর। একবার বোরো, দুইবার আউশ ও দুইবার আমন ধানের ফলন পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিন মৌসুমে বা বছরজুড়েই ধান দিবে একই গাছ। পঞ্চব্রীহি ধানে প্রথমবার হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয়েছে ৪ টন। ডক্টর আবেদ চৌধুরীর ভাষায়,
‘এ নতুন ধান চাষ পদ্ধতি যদি সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী ৫০ বছরের জন্য গোটা জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে’।
সমালোচনা ও আশার কথা
বিজ্ঞানীমহল ড. আবেদ চৌধুরীর এই আবিস্কার নিয়ে বেশ কিছু সংশয় প্রকাশ করেছেন। যেমনঃ
- ৫ সে. মি. দূরত্বে চারা লাগানো হলে, গাছ বড় হওয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা কোথায় পাবে?
- একই গাছে বার বার ফলনের কারণে ধানে চিটা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
- এলাকার সব ধান একই সাথে কাটা হলে রেটুন ফসল পোকার বংশবিস্তারের হাব হিসেবে কাজ করবে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি করবে।
- ৫ বার ফসল ফলনে খড়ের ফলন কম হবে। খড়ের আর্থিক বাজারমূল্য কিন্তু কম নয়। এবং খড় গবাদিপশুর খাদ্যের অন্যতম উৎস।
- সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন হয়ে থাকে তিন থেকে চার টন। পঞ্চব্রীহি ধান একবার রোপণ করে, ৫ বার ফলনে যে ফসল পাওয়া যাবে, তা বস্তুত আলাদা আলাদা ফসল রোপণে উৎপাদিত ধানের চেয়ে কম। প্রথমবার ফলন আসার পর পরের বার ফলন কমতে থাকে। এ জন্য এটি এতটা লাভজনক নয়।
যেহেতু এ ধান নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে, তাই এত সব সমালোচনার পরও আমরা এই যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে আশা বুনতে পারি। কারণ, এই ধান চাষে কৃষকের সময় যেমন বাঁচবে, তেমনি তিনগুণ কম খরচে উৎপাদন করা যাবে বলে সাশ্রয় হবে অর্থও। এছাড়া এই ধান চাষ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব এবং প্রতিবার চাষ ও ফসল ফলাতে হয় না বলে মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের কম নিঃসরণ হয়। একইসঙ্গে একই জমিতে একই গাছে পাঁচবার ধান উৎপাদনের ফলে দূর হবে দেশের খাদ্যসংকট। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত, বন্যাপ্রবণ ও খরাপীড়িত দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্যসংকট দূরীকরণে নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। বাংলাদেশে বছর বছর কৃষি জমি কমে গেলেও কৃষি উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। কৃষিতে নতুন নুতন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির আবিষ্কার ও ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
ধান নিয়ে এই গবেষণা এখনও চলমান রয়েছে এবং এই গবেষণা এখনও কোনো পিয়ার-রিভিউড্ জার্নালে প্রকাশ করা হয় নি। এই ধানের নাম এখনও চূড়ান্ত করেননি ড. আবেদ চৌধুরী। কারণ এর ষষ্ঠ ফলন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। পরবর্তী ষষ্ঠবার ফলন দিলে ধানটিকে ‘ষষ্ঠব্রীহি’ নামকরণ করা যেতে পারে।
কে এই ড. আবেদ চৌধুরী?
ড. আবেদ চৌধুরী বাংলাদেশের আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রথম সারির একজন গবেষক, বিখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ, লেখক ও চিন্তাবিদ। জিনতত্ত্ব, প্ল্যান্ট ব্রিডিং, মলিকিউলার বায়োলজি এবং বায়োটেক বিষয়ে দক্ষতার কারণে তিনি নিজেকে আধুনিক জীববিজ্ঞানে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৮৩ সালে পিএইচ.ডি গবেষণাকালে তিনি ‘রেকডি’ নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন আশির দশকে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তিনি বিলুপ্তপ্রায় ৩০০ প্রজাতির ধান উদ্ধার করেছেন। তাছাড়া তিনি একপ্রকার রঙিন ভুট্টা উদ্ভাবন করেছেন, যাতে ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান রয়েছে। এর আগে তিনি বছরে দুইবার ফলন হয়, এমন একটি ধানের জাত আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু, আইনী জটিলতা, সরকার ও কৃষি অধিদপ্তরের যথেষ্ঠ সহযোগিতার অভাবে এ ধান কৃষকদের মাঝে সেভাবে জনপ্রিয়তা পায় নি।
বৈজ্ঞানিক অবদানের পাশাপাশি, ড. আবেদ চৌধুরী তার নিজ শহর, সিলেটের কানিহাটিকে সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, কৃষি এবং পরিবেশগত উন্নতিতে আদর্শ গ্রামে পরিণত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনেক গুলো বই লিখেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
‘মানবজিনোম : মানুষের জিন জিনের মানুষ’, ‘অনুভবের নীলনকশা’, ‘নির্বাচিত কবিতা’ ইত্যাদি।
‘পঞ্চব্রীহি’ ধান নিয়ে উদ্ভাবকের ভাবনা
নতুন এই ধান উৎপাদন পদ্ধতি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে ড. আবেদ চৌধুরী জানান, ‘তিনি তার এই আবিষ্কার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন না। দেশের দরিদ্র কৃষকদের জন্য সহজলভ্য করে দিবেন। তিনি চান, এই আবিষ্কার দেশের মানুষের জীবনমান বদলে দিক এবং মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করুক।’
সবশেষে, জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি অংশ মনে পড়ে যায়, ”একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে”। সত্যিই, নক্ষত্ররা চুপি চুপি আসে, একা একা চলে এবং একা একা বিস্ময় তৈরি করেন।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply