গাছের মূলে আলু, আর লতায় টমেটো! অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারনে একই গাছে দুই ধরনের সবজি ফলানো সম্ভব হয়েছে। চলুন এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
পম্যাটো (Pomato) নাম শুনেই নিশ্চই বোঝা যায় এটি আলু এবং টমেটো এর সংমিশ্রণে তৈরি কিছু একটা যেখানে একটি একক গাছ থেকে আপনি দুটি ভিন্ন প্রকারের ফসল (টমেটো এবং আলু) পেতে পারেন। এটি হলো একটি সংকরিত উদ্ভিদ। এটি একটু লতানো জাতীয় উদ্ভিদ। এর লতাতেই মুলত টমেটো এবং মূলে আলু ফলে। এই উদ্ভিদটি কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবনের এক চমৎকার উদাহরণ, যা স্থান ও কর্মসংস্থান সাশ্রয় করতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি বিশেষ করে সেই সব অঞ্চলের জন্য উপকারী, যেখানে চাষের জমি কম এবং সঙ্কটাপণ্য ।
পম্যাটো উদ্ভিদের ধারণাটি প্রথম আসে ১৯৭০-এর দশকে, যখন কৃষি বিজ্ঞানীরা গ্রাফটিং প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। পোমেটো উদ্ভিদের ধারণাটি ১৯৩০ সালে অস্কার সোডারহোম দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে এই উদ্ভিদটি প্রাথমিকভাবে ১৯৭৭ সালে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। বাণিজ্যিক কাজে ব্যাবহারযোগ্য হলেও তা এই উদ্ভিদের উদ্ভাবনের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে সফল নয়। এই উদ্ভিদ পম্যাটো উদ্ভিদ উৎপাদন শুরু হয় ২০০০ ছিল কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সীমিত জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন।
পম্যাটো উদ্ভিদের উদ্ভাবন মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে হয়েছে। উদ্ভাবকরা লক্ষ্য করেছেন যে টমেটো ও আলু উভয়ই সোলানাসি (Solanaceae) পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাদের মধ্যে গ্রাফটিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করা সহজ। এছাড়াও, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাছের নানান রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
পম্যাটো উদ্ভিদটি সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা ল্যাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল। বর্তমানে এটি সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মত দেশেই পাওয়া যায়। তবে কয়েক বছর আগে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কৃষি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. গাজী মো. মহসীনের তত্ত্বাবধানে পমেটো চাষ শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে পরীক্ষামূলকভাবে পমেটোর এ চাষাবাদ শুরু হয়।
পম্যাটো গাছ তৈরি করার জন্য প্রথমে একটি সুস্থ টমেটো গাছের চারা এবং একটি সুস্থ আলু গাছের চারা সংগ্রহ করা হয়। টমেটো গাছের চারা থেকে উপরের অংশ এবং আলু গাছের চারা থেকে নিচের অংশ কেটে নেওয়া হয়। তারপর দুটি অংশকে গ্রাফটিং টেপ বা ক্লিপ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, দুটি অংশ একসাথে মিশে যায় এবং একটি নতুন গাছ জন্মায় যা উপরে টমেটো এবং মাটির নিচে আলু উৎপাদন করে।
পদ্ধতির পরিচয়
পম্যাটো গাছ তৈরির মূল পদ্ধতি হলো গ্রাফটিং। গ্রাফটিং এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে দুটি আলাদা উদ্ভিদের অংশ একত্রিত করে একটি নতুন উদ্ভিদ তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় টমেটো এবং আলু গাছের উপযুক্ত অংশগুলি সংযুক্ত করা হয়। গ্রাফটিং পদ্ধতিটি দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এটি বিশেষ করে ফল গাছের জন্য জনপ্রিয়।
গ্রাফটিং প্রযুক্তির মূল কৌশল হলো সঠিকভাবে কাট ও সংযুক্তি করা। এটি নিশ্চিত করতে হয় যে দুটি উদ্ভিদের কাটার অংশগুলো সমান ব্যাসের এবং সঠিকভাবে মিলেছে। এরপর, গাছটিকে কিছুদিন আর্দ্র ও সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রেখে যত্ন নিতে হয় যাতে সংযুক্তি সফলভাবে মিলে যায়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিম্নে পদ্ধতিটির ধাপগুলো লেখা হলো।
- প্রয়োজনীয় উপকরণ: পমেটো গাছ তৈরির জন্য আপনাকে সমান আকার ও বয়সের একটি টমেটো গাছ এবং একটি আলু গাছের প্রয়োজন হবে। গাছদুটি ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা হলে ভাল হয়। যদি গাছগুলো টবে থাকে তবে টবগুলোকে কাছাকাছি এনে রাখুন। যদি আপনার বাগানে থাকে, তবে যে কোনো একটি গাছকে তুলে এনে অন্যটির কাছে লাগান। দুটি গাছ যেন একে অপরের কাণ্ড স্পর্শ করতে পারে, এমনভাবে রাখতে হবে।
- প্রস্তুতি ও অবস্থান: গাছদুটিকে কাছাকাছি এনে রাখুন, যেন কাণ্ডগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এটি করার জন্য আপনার বাগানে যদি গাছদুটি আলাদা জায়গায় থাকে, তাহলে একটি গাছকে তুলে এনে অন্যটির কাছে লাগাতে হবে।
- কলম করার উপকরণ: কলম করার জন্য আপনাকে প্রয়োজন ধারালো একটি ছুরি এবং পলিথিনের চিকন ফিতে। প্রথমে একটি গাছের কাণ্ডের পাশে কিছুটা অংশ ছুরি দিয়ে কেটে উঠিয়ে ফেলুন। এ কাজটি খুব সাবধানে করতে হবে। কাটা অংশটি চলটার মত উঠে আসবে। এই চলটার দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির বেশি হবে না এবং কাণ্ডের ১/৩ ভাগের বেশি গভীর হবে না। পুরো কাণ্ডটি যাতে কেটে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- একই প্রক্রিয়া অন্য গাছে: এবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন অন্য গাছটিতেও। নিশ্চিত করুন যে কাটা অংশটি একই উচ্চতায় রয়েছে। এবার গাছ দুটির কাটা অংশ একত্রে জোড়া লাগিয়ে পলিথিনের ফিতে দিয়ে বেঁধে দিন। এমনভাবে বাঁধুন যেন সংযোগের অংশটি সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে, যাতে কাটা অংশে কোনো রোগজীবাণু প্রবেশ করতে না পারে।
- ছায়ায় রাখা ও যত্ন: রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচাতে টব দুটিকে ছায়ায় নিয়ে রাখুন অথবা বাগানের গাছগুলোর উপরে ছায়া দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আবহাওয়া যদি বেশি গরম হয়, তবে আলু গাছের পাতাগুলোকে কেটে ফেলুন।
- বৃদ্ধির লক্ষণ ও কাণ্ড কাটা: কলম করার প্রায় ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে টমেটো গাছে নতুন বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যাবে। কলমের স্থানে কাণ্ডটি ফুলে গেছে বলে মনে হবে। এ অবস্থায় কলমের একটু নিচ থেকে টমেটো গাছের গোড়া কেটে ফেলুন এবং কলমের ওপর থেকে আলু গাছের অংশটি কেটে ফেলুন। এরপর পলিথিনের ফিতে খুলে ফেলুন।
- আর্দ্রতা সংরক্ষণ ও নিয়মিত পানি দেওয়া: কিছুদিনের জন্য গাছটিকে পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে ঢেকে রাখুন আর্দ্রতা সংরক্ষণের জন্য। গাছে নিয়মিত পানি দিন। এভাবেই আপনার পমেটো গাছটি বৃদ্ধি পাবে এবং একই সাথে ফলবে আলু ও টমেটো!
- ফলাফল: এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনি সহজেই পমেটো গাছ তৈরি করতে পারবেন, যা আপনাকে একই গাছে টমেটো এবং আলু ফলানোর সুবিধা দেবে। এভাবে আপনি একটি নতুন ধরনের উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন এবং আপনার বাগানকে আরও বৈচিত্র্যময় করতে পারবেন
তবে বাড়িতে এটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ।
প্রোটোপ্লাজম ফিউশন
এটি তৈরির একটি বিকল্প পদ্ধতিও আছে। সেটি হোলো প্রোটোপ্লাস্ট ফিউশন। কোষাভান্তরে অবস্থিত সজীব প্রোটোপ্লাজম ও নির্জীব বহুগুলোকে একত্রে প্রোটোপ্লাস্ট বলে। প্রোটোপ্লাস্ট ফিউশনে, একেকটি বা একাধিক প্রোটোপ্লাস্ট একসাথে ফিউজ করে একটি নতুন প্রোটোপ্লাস্ট তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বায়োলজিক অংশের সমন্বয়ে কাজ করে, যেমন সেলুলার মেম্ব্রেন, জেনেটিক উপাত্ত, এবং প্রোটিনের সংমিশ্রণ। এ প্রক্রিয়ায় দুইটি ভিন্ন প্রজাতির প্রোটোপ্লাস্ট সমন্বয় ও তা থেকে নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উদ্ভিদ উৎপন্ন করা হয়। সাধারণ সংকরায়নের ক্ষেত্রে পুং ও স্ত্রী গ্যামিটের মিলন ঘটে । পুং গ্যামিটে প্রোটোপ্লাস্ট খুব কম থাকে ও তা স্ত্রী গ্যামিটের বাইরেই রয়ে যায় । তবে সোমাটিক হাইব্রিড তৈরি হলে, সেখানে প্রজাতি দুইটির সাইটোপ্লাজমের মিলন ঘটে (নিউক্লিয়াসের নয়) একে সাইব্রিড বলে। এভাবেই প্রোটোপ্লাস্টের মিলনের ফলে নতুন উদ্ভিদ তথা পম্যাটোর জন্ম হয় (জীববিজ্ঞান, একাদশ দ্বাদশ শ্রেণী, ড. মোহাম্মাদ আবুল হাসান , পৃষ্ঠা ৩৭৯ এবং ৩৮০)।
সুবিধা
- দুই ধরনের ফসল: একই গাছে টমেটো ও আলু পাওয়া যায়, যা স্থান ও সংস্থানের সাশ্রয় করে।
- খাদ্য নিরাপত্তা: এক গাছে দুই প্রকার সবজি পাওয়া খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
- উদ্ভাবনী বাগান: শখের বাগানী ও কৃষকদের জন্য এটি একটি চমৎকার উদ্ভাবনী প্রকল্প।
- জমির সাশ্রয়: এক জমিতে দুই ফসল উৎপাদন করে কৃষকেরা জমির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারেন।
- অর্থনৈতিক সাহায্য : মানুষের আগ্রহ সীমাহীন বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার এই যেমন পম্যাটো নিয়ে মানুষের আগ্রহের সীমা নেই এবং সেই আগ্রহের জায়গা থেকেই মানুষ এটি খাওয়া সহ আরও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করবে যা একটি দেশের অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব ফেলবে ।
অসুবিধা
একটি আবিষ্কার যেমন সুবিধা আনে ঠিক তেমনি তার বিভিন্ন অশুবিধাও আছে নিচে পম্যাটোর কিছু অসুবিধা সম্পর্কে বলা হলো ।
- যত্নের প্রয়োজন: গ্রাফটিং সফলভাবে করতে কিছুটা ধৈর্য ও যত্নের প্রয়োজন।
- সীমিত উৎপাদন: বাণিজ্যিকভাবে এটি এখনও সীমিত আকারে উৎপাদিত হয়।
- সম্ভাব্য রোগ: দুটি ভিন্ন উদ্ভিদের সংমিশ্রণ হওয়ায়, পম্যাটো গাছ রোগের জন্য বেশি সংবেদনশীল হতে পারে।
- পুষ্টির সমস্যা: পম্যাটো গাছ থেকে প্রাপ্ত ফসলের পুষ্টির মান কিছুটা কম হতে পারে।
পম্যাটো গাছের উৎপাদন এখনও অনেক ক্ষেত্রে সীমিত কারণ এর চাষের জন্য বিশেষ যত্ন ও দক্ষতার প্রয়োজন। এছাড়া, গ্রাফটিং প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং এতে ব্যর্থতার সম্ভাবনাও থাকে। তবে, বিজ্ঞানীরা এবং কৃষকরা ক্রমাগত এর উন্নতির জন্য কাজ করছেন।
পম্যাটো গাছ উদ্ভাবনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি কেবলমাত্র কৃষি গবেষণার জন্য নয়, বরং শখের বাগানী ও ছোট পরিসরের কৃষকদের জন্যও অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে। এই উদ্ভিদটি প্রমাণ করে যে উদ্ভাবনী চিন্তা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে অসাধারণ উন্নতি সম্ভব। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে পম্যাটো আরও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও উৎপাদনশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
তথ্যসূত্র:
- জীববিজ্ঞান , একাদশ দ্বাদশ শ্রেণী , ড. মোহাম্মাদ আবুল হাসান , পৃষ্ঠা ৩৭৯ এবং ৩৮০।
- Hartmann, H. T., Kester, D. E., Davies, F. T., & Geneve, R. L. (2010). Plant Propagation: Principles and Practices. Prentice Hall.
- Gaba, V., & Collonnier, C. (2003). “Grafting and its role in crop improvement.” Plant Cell, Tissue and Organ Culture, 74(2), 147-161.
- Kolb, M. (2013). “Pomato plants: tomato-potato plants from grafting.” The Daily Gardener.
- প্রিয়.কম : টমেটো+পটেটো=পমেটো!
Leave a Reply