বেটম্যান প্রিন্সিপাল (Bateman’s Principle) জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী এ. জে. বেটম্যান ফলের মাছি (Drosophila melanogoster)এর গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত হয়। বেটম্যান প্রাথমিকভাবে চার্লস ডারউইনের যৌন নির্বাচনের তত্ত্বের পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই গবেষণায় অনুপ্রাণিত হন। তিনি ডারউইনের তত্ত্বকে ত্রুটিপূর্ণ না মনে করলেও অসম্পূর্ণ মনে করতেন। যৌন নির্বাচন কীভাবে নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রজনন সাফল্যে ভূমিকা রাখে তা তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন। তিনি ডারউইনের ধারণা এবং যৌন দ্বৈতরূপের (sexual dimorphism) মাঝে যে শুন্য স্থান তা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন। বেটম্যানের নীতিটি ব্যাখ্যা করে যে প্রজনন ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের সফলতা কীভাবে ভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়।
বেটম্যান প্রিন্সিপালের মূল ধারণা
ডারউইন তার বই ডিসসেন্ট অফ ম্যান বইয়ে বলেছেন-
‘The males of almost all animals have stronger passions than the females. Hence it is the males that fight together and sedulously display their charms before the female’
চার্লস ডারউইন এর মতে পুরুষদের মিলনের প্রতি আগ্রহ বেশি কারণ ছোট শুক্রাণু তৈরি এবং বহন করা বড় ডিম্বানুর চেয়ে সহজ এবং কম খরচে হয়। তবে নারী ও পুরুষের প্রজনন ক্ষেত্রের ভিন্নতা সম্পর্কে সর্বপ্রথম সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেন বেটম্যান। বেটম্যানের বিখ্যাত পরীক্ষাগুলি দেখায় যে একজন পুরুষ ড্রোসোফিলা দ্বারা তার সঙ্গীর সংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে সন্তানের সংখ্যাও সেই হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু স্ত্রী মাছির ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম দেখা যায়। একটি স্ত্রী মাছি বেশ কয়েকটি পুরুষের সাথে মিলনের ফলে সন্তানের সংখ্যা যেই হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেই হারে বৃদ্ধি পায়নি। বেটম্যান উপসংহার টেনেছিলেন,
একটা শুক্রাণু উৎপাদনের চাইতে একটা ডিম্বাণু উৎপাদন অধিক ব্যয়বহুল। তাই একটা স্ত্রী ফলের মাছি কয়টা বাচ্চা দেবে তা ডিম্বাণু উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যদিকে পুরুষ মাছির প্রজনন সাফল্য নির্ভর করছে কত বেশি নারী মাছিকে গর্ভবতী করাতে পারে তার ওপর। সেই সঙ্গে মানুষের লিঙ্গভেদে জননকোষের আকারে পার্থক্য হবার দরুন মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে লিঙ্গের প্রতিযোগিতা বেশি হবে ।
অতএব দেখা যাচ্ছে পুরুষদের প্রজনন সফলতা সাধারণত তাদের সঙ্গীর সংখ্যার ওপর নির্ভর করে। যত বেশি সঙ্গীর সাথে তারা মিলিত হতে পারে, তত বেশি সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে নারীদের প্রজনন সফলতা প্রধানত তাদের সন্তানদের যত্ন ও পুষ্টির মানের উপর নির্ভর করে। একটি নারী সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিম্বাণু উৎপাদন করে এবং প্রতিটি সন্তানের যত্নের জন্য তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় ও সম্পদ ব্যয় করতে হয়।
বেটম্যান ড্রোসোফিলা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ছয়টা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। প্রতিটা পরীক্ষায় উভয় লিঙ্গের পাঁচ থেকে ছ’টা মাছি ব্যবহৃত হয়েছিল। পরীক্ষা চলে তিন থেকে চার দিন ধরে। কিছু পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল একটা বোতলে। এর উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষার পরিবেশ যাতে পরিবর্তন না হয়। বাকী পরীক্ষাগুলোর বেলায়, বেটম্যান প্রতিদিন ফলমাছি এবং তাদের ডিমগুলোকে নতুন বোতলে স্থানান্তর করতেন। পরীক্ষা ভেদে তিনি ফলমাছির বয়সও পরিবর্তন করেছিলেন, যার মোট বয়সের পার্থক্য ছিল এক থেকে ছয় দিন।
তিনি কখনোই ফলমাছির মিলন পর্যবেক্ষণ করেননি। তিনি ইনব্রেড (আন্তঃপ্রজনিত) জাতের ড্রোসোফিলা ব্যবহার করতেন, যেখানে প্রতিটি পুরুষের আলাদা আলাদা জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকত। ফলে, যখন একটি লার্ভা জন্মাতো, বেটম্যান সেই লার্ভার বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারতেন কোন পুরুষের সাথে মহিলা সঙ্গম করেছে। যেমন, একটি লার্ভার চোখের রঙ যদি লাল হয়, তবে তিনি বুঝতেন যে এটি লাল চোখের পুরুষের সন্তান। যদি একজন মহিলা একাধিক পুরুষের সাথে সঙ্গম করে এবং পরবর্তী প্রজন্মে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের লার্ভা জন্মায়, তাহলে বেটম্যান বুঝতে পারতেন যে মহিলাটি একাধিক পুরুষের সাথে সঙ্গম করেছে। প্রতিটি লার্ভার বৈশিষ্ট্য দেখে তিনি তা নির্ধারণ করতে পারতেন।
যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছিল তা হলো, যদি একটি মহিলা ড্রোসোফিলা পাঁচজন পুরুষের সাথে মিলিত হতো এবং শুধুমাত্র একটি লার্ভা বেঁচে থাকত, বেটম্যান অন্য চারটি মিলনের হিসাব দিতে পারতেন না। সেট এক থেকে চার পর্যন্ত সংগৃহীত ডেটার বিশ্লেষণ দেখিয়েছে যে পুরুষদের প্রজনন সাফল্য, (সন্তানদের সংখ্যা ) একটি স্থির হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যতক্ষণ না মোট তিনবার মেটিং পর্যন্ত পৌঁছেছে। এটি উল্লেখযোগ্য যে বেটম্যান তার পরীক্ষাগুলিতে পুরুষ ও মহিলার লিঙ্গ অনুপাত ( sex ratio)সম্পূর্ণ সমান রেখেছিলেন। কিন্তু তিনবার মেটিং অতিক্রম করার পরে, পুরুষদের প্রজনন সাফল্য কমতে শুরু করে। মহিলাদের প্রজনন সাফল্যও সঙ্গীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বাড়ছিল, কিন্তু পুরুষদের তুলনায় অনেক ধীরে।
সেট পাঁচ ও ছয় থেকে সংগৃহীত দ্বিতীয় সিরিজের ডেটা একটি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন ফলাফল দেখিয়েছে। পুরুষদের প্রজনন সাফল্য একটি স্থির ও খাড়া গতিতে বাড়ছিল, কখনো কমছিল না। অন্যদিকে, মহিলাদের প্রজনন সাফল্য একটি সঙ্গীর পরে স্থির হয়ে গিয়েছিল। ( যা নিচের গ্রাফ চিত্রে দেখানো হয়েছে)
বেটম্যান তার ফলাফল আলোচনা করার সময় প্রধানত দ্বিতীয় সিরিজের ডেটার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। তার প্রধান উপসংহার ছিল যে নারীদের প্রজনন সাফল্য অতিরিক্ত সঙ্গীর সাথে বৃদ্ধি পায় না, কারণ নারী প্রজাতির ডিম্বানু সংখ্যা পুরুষের মতো অজস্র নয় বরং লিমিটেড। এছাড়া সন্তান লালন পালনে স্ত্রী প্রজাতিকেই অধিক শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয়।তাই স্ত্রী প্রজাতির জন্য একটি সক্ষম সঙ্গীই সফলভাবে নিষেক সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এটি প্রায়ই বেটম্যানের গ্রেডিয়েন্ট হিসাবে পরিচিত।
প্রভাব ও গুরুত্ব
বেটম্যান প্রিন্সিপাল অনুযায়ী, পুরুষ ও নারীদের প্রজনন কৌশল এবং আচরণে পার্থক্য থাকে। এটি ব্যাখ্যা করে কেন পুরুষরা সাধারণত বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং নারীরা সাধারণত বেশি নির্বাচক হয় সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
উদাহরণ স্বরূপ পশুদের মধ্যে অনেক প্রজাতির পুরুষ সদস্যরা একাধিক নারীর সাথে প্রজনন করতে চেষ্টা করে, যাতে তাদের জিনের বিস্তার সর্বাধিক হয়। অন্যদিকে, নারীরা সঙ্গী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বেশি যত্নশীল হয়, কারণ তাদের বিনিয়োগ প্রতিটি সন্তানের যত্ন ও পুষ্টির ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।মানুষের মধ্যে, পুরুষরা প্রায়শই তাদের সঙ্গীর সংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করে, যেখানে নারীরা এমন সঙ্গী নির্বাচন করে যারা সন্তানদের জন্য সবচেয়ে ভালো পিতা হতে পারে। তবে কিছু জীব যেমন : ব্যাঙ, সিহর্স , কয়েক প্রজাতির পাখি যেখানে পুরুষ প্রজাতিকে সন্তান পালনে অধিক ভূমিকা রাখতে হয় সেখানে বিপরীত ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। নারীদেরকে পুরুষ প্রজাতির সঙ্গ পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে দেখা যায়।
বেটম্যানের নীতিটি তিনটি সহজ বক্তব্যে প্রকাশ করা যেতে পারে-
- পুরুষের প্রজনন সাফল্য তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়া সঙ্গীর সংখ্যার সাথে বৃদ্ধি পায়, যেখানে নারীর প্রজনন সাফল্য তেমন হয় না।
- পুরুষের প্রজনন সাফল্যের তারতম্য নারীর তুলনায় বেশি হয়।
- যৌন নির্বাচন সেই লিঙ্গের উপর বেশি প্রভাব ফেলবে যার প্রজনন সাফল্যের(Reproductive success) তারতম্য(variance )বেশি।
বেটম্যান প্রিন্সিপাল এর সমোলচনা
হাবেল এবং জনসন প্রস্তাব করেছিলেন যে প্রজনন সাফল্যের পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে প্রজননের সময় এবং বাসস্থান দ্বারা প্রভাবিত হয়। ২০০৫ সালে, গাওয়াটি এবং হাবেল প্রস্তাব করেছিলেন যে কিছু কৌশলের উপর নির্ভর করে প্রজনন প্রবণতা পরিবর্তিত হতে পারে। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে বেশি বাছাই করতে পারে, যেখানে বেটম্যান প্রস্তাব করেছিলেন যে তার মতবাদ প্রায় সব যৌন প্রজননকারী প্রজাতির মধ্যে “প্রায় সর্বজনীন” হবে। সমালোচকরা প্রস্তাব করেছিলেন যে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশি যৌন নির্বাচনের অধীনে থাকতে পারে, তবে সব ক্ষেত্রে নয়।
২০০০ সালের একটি পর্যালোচনায় বার্কহেড যুক্তি দিয়েছিলেন যে যেহেতু বেটম্যানের পরীক্ষা শুধুমাত্র তিন থেকে চার দিন স্থায়ী হয়েছিল, তাই মহিলা ফলের মাছি, ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টার, বারবার মিলিত হওয়ার প্রয়োজন নাও থাকতে পারে, কারণ এটি চার দিন পর্যন্ত শুক্রাণু সংরক্ষণ করতে পারে; যদি বেটম্যান এমন একটি প্রজাতি ব্যবহার করত যার মধ্যে মহিলাদের ডিম নিষিক্ত করার জন্য আরও ঘন ঘন সহবাস করতে হয়, তবে ফলাফলগুলি ভিন্ন হতে পারে। স্নাইডার এবং গাওয়াটি বেটম্যানের ১৯৪৮ সালের পেপারের ডেটার প্রথম গভীর বিশ্লেষণ পরিচালনা করেন। তারা নমুনায় পক্ষপাত, গাণিতিক ত্রুটি এবং নির্বাচনশীল তথ্য খুঁজে পেয়েছেন।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply