আল্টিমা থুল (Ultima Thule), যেন এক স্বর্গরাজ্য। পৃথিবীর সর্বোচ্চ উত্তরে যার অবস্থান। উষ্ণতা যেখানে দুর্লভ, আলো যেখানে অপ্রতুল, বছরজুড়ে তুষারপাত এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী ঝড় যেখানে নিত্যসঙ্গী। শতাব্দী ধরে কিংবদন্তিরা যেখানে অভিযান চালাতে চেয়েছে। অন্ধকারের কুয়াশা আর হিমশীতল বরফের ঘূর্ণিঝড়ের ওপারে আলোর আভাসের সন্ধানে অভিযানে বের হয়ে মারা গেছে সহস্র মানুষ। শীতল বরফের আলিঙ্গন একীভূত করেছে কয়েক প্রজন্মের দু:সাহসিক অভিযাত্রী এবং মেরু ভালুকের অস্থি । উত্তর মেরু তারপরেও সহস্র যুগ ধরে ছিল মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে, পরীক্ষিত নাবিকের রোমাঞ্চের বিলাসিতার বাকেট লিস্টে। তাই হয়ত, উত্তর মহাসাগরের কিংবদন্তিদের গল্প থাকে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতির লোকগল্পে, হারিয়ে যাওয়া বীরদের উপকথায়, নর্স মিথোলোজিতে, মনে দাগ কাটার মতো ঘুমপাড়ানি গানে, ধংস্বপ্রাপ্ত সভ্যতার ধোঁয়াশা বর্ণনায়।
তবে বাস্তবতা যেন আরও রোমাঞ্চকর। উত্তর মেরু এতোটাই ঠান্ডা যে সেখানে পুকুরের পরে নদী, নদীর পরে সাগর, সাগরের পরে মহাসাগরের পানিও ঠাণ্ডায় জমে যায়। আর্কটিক মহাসাগরে বরফের চাঁই (sea ice floe) কিছু জায়গায় একটি কাগজের মতো সরু, আবার কিছু জায়গায় ইস্পাতের পাতের চেয়েও পুরু। এই পুরুত্বের হেরফের এতোটাই বেশি যে, কেউ হয়ত উত্তরের আর্কটিক মহাসাগরে হাঁটতে গিয়ে বরফ ভেঙ্গে পানিতে ডুবে যাবে, আবার কিছু জায়গায় এতোটাই পুরু যে এর উপর দিয়ে একটি দুই লক্ষ কেজি ওজনের ক্রুজ শিপও (মালবাহী জাহাজ) চলাচল করতে পারবে। আর্কটিকের বরফের চাঁই বিশাল আয়তনের এবং সাধারণত অনড়। এরপরও তারা দিনে দশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব ভেসে পাড়ি দেয়। এ যেন এক পরাবাস্তবতার জগৎ যেখানে পরিচিত সবকিছুই বিবর্ণ, নিকষ, এবং ধীরগতির।
খুঁজে পাওয়া
দশ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে নাবিকদের কাছে আর্কটিক মহাসাগর ছিল এক দুর্বোধ্য ধাঁধার নাম। তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক অভিযানের শেষে বিজ্ঞানীরা আর্কটিক মহাসাগরকে বুঝতে শুরু করে। শুরুটা হয় ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৬ এর মাঝামাঝি সময়ে। বিখ্যাত সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নানসেন তাঁর ঐতিহাসিক আর্কটিক অভিযান থেকে যেই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন তা পরবর্তী এক শতাব্দী পর্যন্ত বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী, আবহাওয়াবিদ, রাজনীতিবিদ, এবং নৌবাহিনীর সামরিক অফিসাররা ব্যবহার করেছিলেন[1]। তাঁর সংগৃহীত তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই প্রস্তাবনা করা হয় অনেক মূল্যবান থিওরি এবং মডেল সিমুলেশনের স্থাপনা। ১৯৩০ সালে রাশিয়ানরা একের পর এক ছোট ছোট মিশনের জন্য আর্কটিকে ঘাঁটি গাড়া শুরু করলে এই মহাসাগরের পানির বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়ার প্যাটার্ন, সমুদ্রের শক্তি প্রবাহ, এবং অন্যান্য মহাসাগরের সাথে আর্কটিকের তাপমাত্রার আদান প্রদান সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়তে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই আর্কটিক মহাসাগর হয়ে পরে সমগ্র পৃথিবীর সমুদ্রবিজ্ঞানী এবং প্রায় ১০ টি দেশের নৌবাহিনীদের প্রধান আগ্রহের বিষয়। কেননা বরফে ঢাকা এই সাগর পাড়ি দেয়ার কার্যকরী কায়দা জানলেই তো উত্তর মেরুতে এক দেশে আরেক দেশে যাওয়া যাবে আগের চেয়ে দশ ভাগের এক ভাগেরও কম সময়ে!
সমাধিলগ্ন
এই ছিল আর্কটিক মহাসাগরের সাথে আধুনিক মানব সভ্যতার প্রথম পরিচিতির স্বল্প উপাখ্যান। তবে এই লেখাটির উদ্দেশ্য কিছুটা আলাদা। মহাপরাক্রমশালী এই আর্কটিক মহাসাগরও হার মেনেছে মানুষের বিত্তবৈভব, চাহিদা, এবং গরিমার কাছে। আর্কটিক হারিয়েছে তাঁর চিরায়ত জৌলুস। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর কারণে শুধু গত ৩৫ বছরেই আর্কটিক হারিয়েছে দুই লক্ষ বর্গকিলোমিটারের চেয়েও বেশি বরফের আস্তরণ[2]। প্রচুর পরিমাণ বরফ গলে গিয়ে পানিতে মিশে যাওয়ায় প্রশান্ত, আটলান্টিক, এবং আর্কটিক মহাসাগরের পানির লবণাক্ততার হেরফের হয়েছে। আঞ্চলিক অনেক মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সংখ্যায় অর্ধেকেরও বেশি কমে গিয়েছে তাদের উপরে নির্ভরশীল সামুদ্রিক সীল এবং মেরু ভালুক। যখন সাগরের উপরে বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন সেই বায়ুর শক্তির একটা বড় অংশ বরফ শোষণ করে নেয় এবং কিছুটা অংশ বরফের নিচের পানিতে প্রবাহিত হয়। এই শক্তি উৎপন্ন করে বরফের নিচের স্রোত। তাই বলা যায় যে, বরফের চাঁই কার্যত বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের পানির বাইরের শক্তির যাতায়াতের চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কি হবে যদি এই বরফের চাঁই-ই নাই হয়ে যায়? কি হবে যদি তাপমাত্রা বাড়তে থাকা এই পৃথিবীতে আমরা হারিয়ে ফেলি বরফের চাঁই এর চিরায়ত পুরুত্ব? বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্টি হওয়া এই ঘটনা কি শুধু আর্কটিক মহাসাগরকেই প্রভাবিত করবে? নাকি ক্ষতিগ্রস্ত করবে সমগ্র পৃথিবীকে? চিরকাল অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা আর্কটিক সবার সম্মুখে এসে মিলিয়ে যাওয়ার আগে আমাদেরকে দুঃসহতার অভিশাপ দিয়ে যাবে না তো?
পাঁচটি অপ্রিয় দৃশ্য
বরফের ঘনত্ব যখন কমে যায় তখন কি কি দৃশ্যপট সামনে চলে আসে তা নিয়েই এখন কথা বলবো। প্রথমত, পুরু বরফের চাঁই সামগ্রিকভাবে পানিতে ভাসতে থাকা একটি দেয়ালের মতো ফাংশন করে। তবে যখন বরফের চাঁই গলে পাতলা হয়ে যায়, তখন উন্মুক্ত সাগরে তারা বাতাসের সাথে সাথে আরও দ্রুত প্রবাহিত হয়। যার ফলে সাগরের স্রোতের গতিপথ বায়ুমণ্ডলের গতিপথের সাথে একীভূত হয়ে যায়। এতে করে সমুদ্রের ঘুর্ণবত স্রোতের গতিশক্তি (Eddy kinetic energy) বেড়ে যায়[3]।
দ্বিতীয়ত, পাতলা বরফের আস্তরণ আর্কটিকের ঘূর্ণিঝড়গুলোকে প্রতিহত করতে পারে না[4]। বরং তারাও ঝড়ের সাথে দ্রুত আছড়ে পরে বা বহু কিলোমিটার পর্যন্ত ভেসে যায়। নিচ্ছিদ্র বরফের চাঁই অনেক ঝড় ঝাপটা এবং সাইক্লোন এর প্রভাব শুষে নেয় কারণ এই অবস্থায় বরফ অভঙ্গুর এবং তাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি খুবই বেশি। কিন্তু পাতলা বরফের চাঁই বায়ুর গতিশক্তি (Wind kinetic energy) কে নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে না।
তৃতীয়ত, পাতলা বরফের চাঁই এর নিচ্ছিদ্র আবরণ ভেদ করে সূর্যালোক প্রবেশ করলে বরফের ঠিক নিচের স্তরেই সৃষ্টি হয় শৈবালের মহামারি, যা নিয়ে আমি এই ব্লগে বিস্তারিত লিখেছি কিছু দিন আগে।
চতুর্থত, যখন বরফের পুরুত্ব কমে যায় তখন উলম্বদিকে (vertical direction) মিশ্রণ বেড়ে যায়[5]। এতে করে তাপশক্তি, লবণ, পুষ্টি উপাদান পানির গভীর স্তর থেকে উপরের স্তরে চলে আসে। এতে করে দুইটি সমস্যা হয় –
- গভীর স্তরে থাকা বাস্তুসংস্থান এর খাদ্যাভাব সৃষ্টি হয়, এবং
- গভীরের স্তরে জমে থাকা পটেনশিয়াল তাপমাত্রা উপরে উঠে আসলে তা বরফের নিচের স্তরকেও গলিয়ে দেয়।
সবশেষে, যখন বরফ গলে যায়, তখন তার ঠিক নিচের স্তরের পানির লবণাক্ততা কমে যায়। এতে করে বরফের নিচে বেশ কিছু কিলোমিটার পর্যন্ত পানির pH এর পরিবর্তন হয়। সাধারণত, গ্রীষ্মকালে এটা স্বাভাবিক তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এই pH এর মান এখন সারাবছর ধরেই কমে যাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে আর্কটিক এর পানির অম্লত্ব (acidification) বেড়ে যাচ্ছে[6]।
পরিশিষ্ট
মানুষের সভ্যতার দাম প্রতিটা যুগে প্রকৃতিকে দিতে হয়েছে। আর্কটিক মহাসাগরের নাশ আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রার পিছের একটি খরচমাত্র। বেশ কিছু আধুনিক গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের প্রথমবারের মতো বরফ শূন্য আর্কটিক দেখার অভিজ্ঞতা হবে। আর্কটিক এর এই নাজুক অবস্থা আমাদেরকে থামিয়ে রাখেনি, সামান্যতম সংবেদনশীল করেনি। বরং উন্নত দেশগুলোতে আর্কটিক থেকে খনিজ উপাদান নিষ্কাশনের এক প্রতিযোগিতা চলছে[7]। বরফ গলে তৈরি হয়ে যাওয়া উন্মুক্ত সমুদ্র পথের মালিকানা নিয়ে শীতল যুদ্ধ চলছে। বাস্তবিকভাবে, এই সবকিছুই মানুষের স্বভাবচরিত ইতিহাসের প্রতিফলন মাত্র। তবে তেড়ে আসা বরফের চাঁই এর চিৎকারের সাথে গলা মিলাবে আমাদের ঠিক পরবর্তী প্রজন্ম। তারা কি আমাদেরকে ঠিক সেই চোখেই দেখবে যেভাবে আমরা দেখি পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে পৃথিবীজুড়ে বিশাল বন (megafauna) বিলুপ্তিকরণ বা পনেরো হাজার বছর আগে মেসোলিথিক যুগ থেকে বন্য পশুপাখিদের জোর করে গৃহপালিত (domistication) করে প্রকৃতির সাথে গলা উঁচিয়ে যুদ্ধ করা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে?
তথ্যসূত্র-
- Fridtjof Nansen and the geology of the Arctic.
- Thinning and volume loss of the Arctic Ocean sea ice cover: 2003–2008.
- Eddies and the distribution of eddy kinetic energy in the Arctic Ocean.
- Extreme arctic cyclone in August 2016.
- On the effects of increased vertical mixing on the Arctic Ocean and sea ice.
- Impact of rapid sea-ice reduction in the Arctic Ocean on the rate of ocean acidification.
- Arctic resource competition and the return of the great game.
Leave a Reply