এঞ্জেল হেয়ার: ফ্লোরেন্সের আকাশে রহস্যজনক ইউএফও, কীসের ইঙ্গিত?

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

২৭ অক্টোবর, ১৯৫৪ সাল। স্টেডিও আর্টেমিও ফ্রাঞ্চি স্টেডিয়াম। ফ্লোরেন্স, ইতালি।

হ্যালোউইন উৎসবের তখনও দিন চারেক বাকি। এরইমধ্যে চমৎকার এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে তৎকালীন দুই পরিচিত ক্লাব–ফিওরেন্টিনা ও পিস্তোইয়েস। উৎসব আর উৎকণ্ঠার আমেজমাখা মুহূর্তে উত্তেজনা বিরাজ করছিল চরম আকারে। জনা হাজার দশেক দর্শকের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচটি যেন আরো জমজমাট হয়ে উঠেছিল। গুটি গুটি পায়ে বল যখনই গোলবারের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, তখনই হৈ-হুল্লোড়ে ফেটে পড়তে লাগলো সবাই।

অর্ধ সময় শেষ। এবার রেফারির বাঁশিতে এলো মধ্যবিরতির নির্দেশ। খেলোয়াড়েরা সারিবেঁধে চললেন বিরতি রুমের দিকে। ছোট্ট বিরতি শেষে ঝাঁঝালো শক্তিতে আবারও ফিরে এলেন মাঠে। শুরু হলো চূড়ান্ত লড়াই।

কিছু সময় পর, চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেও দর্শকদের মাঝে কোনো হৈ-হুল্লোড় নেই। নেই চিৎকার চেঁচামেচিও। দর্শক গ্যালারিতে যেন বিরাজ করছে নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঘটনা কী? ঘটনা বুঝতে চেষ্টা করলেন খেলোয়াড়েরা। যার যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়লেন ঠায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দর্শক গ্যালারির পানে। ততক্ষণে গোলাকার বলটি খেলোয়াড়ের পা ছাড়িয়ে মাঠের এককোণে এসে থেমেছে।

সবারই দৃষ্টি খোলা আকাশের দিকে। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে কী যেন দেখছেন তারা। অবশেষে পাশ ফিরে রেফারিও তাকালেন সেদিকে। মনের অজান্তেই বলে উঠলেন–এ কী! আকাশের একাংশ থেকে দ্রুতবেগে কিছু বিশালাকার অবয়ব সারিবেঁধে স্টেডিয়ামের কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি এসে যেন গতি কমিয়ে একেবারে মন্থর হয়ে গেলো আকাশযানগুলো।

সে সময় যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাদের ভাষ্যমতে–ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জমাটবাঁধা মেঘ কিংবা আধুনিক কোনো উড়োজাহাজের মহড়া যে সেগুলো নয়, এ ব্যাপারে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত। তবে, শব্দহীন, কিম্ভূতকিমাকার এই আকাশযানগুলো আসলে কী ছিল সে ব্যাপারে সঠিকভাবে কেউই কিছু বলতে পারলো না। একপর্যায়ে সবাই কানাঘুঁষা করতে শুরু করলো–তারা বেনামী উড়ন্তযান বা ইউএফও দেখতে পেয়েছে। ততক্ষণে বাহনগুলো থেকে পড়তে শুরু করেছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো রুপালী তন্তু-সদৃশ কিছু।

শিল্পীর তুলিতে আঁকা কাল্পনিক দৃশ্য; ছবিসূত্র: bbc.com

কেমন ছিল এদের আকৃতি?

অদ্ভুতদর্শন এসব আকাশযানের আকার নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মাঝে। কেউ কেউ বলছেন এগুলো ডিম্বাকৃতির। কেউবা বলছেন–না! এদের আকৃতি ছিল বিয়ার কেনের ন্যায় সরু ও লম্বাটে ধরণের।

ঠিক পনেরো মিনিট সময় এভাবে আকাশে থমকে থেকে দ্রুতগতিতে আবারও মিলিয়ে গেলো তারা। ততক্ষণে এর ভেতর থেকে ঝরতে থাকা রুপালি তন্তুর ন্যায় বস্তুগুলো দিয়ে ছেয়ে গেছে আশেপাশের এলাকা।

দর্শক গ্যালারিতে উপস্থিতদের শরীরেও পড়েছে এদের কিয়দাংশ। তবে এতে কারো ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায় নি। ক্ষত সৃষ্টি হয় নি বা আঘাত লাগেনি এতটুকুও। কেননা, তুলোর ন্যায় মিহি এসব তন্তু ধরতে গেলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছিল। মিলিয়ে যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ।

আকাশযানগুলো হারিয়ে যাবার পর, সবারই ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগলো। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ম্যাচ সাময়িকভাবে ঘোষণা করা হলো স্থগিত। কারণ সবার মাঝে তখন অজানা আতঙ্ক। মাথায় উঁকি দিচ্ছিল হাজারো নির্বাক প্রশ্ন। এমন পরিস্থিতিতে দর্শক বা খেলোয়াড়দের কারোরই খেলা দেখার বা চালিয়ে যাবার মানসিক সক্ষমতা আর ছিলো না।

এমন একসময়ে ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব, বুদ্ধিমান প্রাণীর আবির্ভাব, উড়ন্ত বেনামী আকাশযান নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চলছিল সর্বত্র। আড্ডা-গল্পে এদের নিয়েই আলোচনা আগাতো অনেকক্ষণ। এই ঘটনার পর যেন এসব আলোচনার পালে রীতিমতো তীব্র ঝাপটা লাগলো। এমন ধরণের রোমাঞ্চকর ঘটনার সম্মুখীন হয়ে হাজারো দর্শক কী মন্তব্য করবে তা-ই ভেবে পাচ্ছিল না তারা। ভাবতে লাগলো–সত্যিই কী তারা এলিয়েনশিপ আর ভিনগ্রহীদের দেখেছে? নাকি এগুলো কেবলই চোখের ভুল? কিন্তু এতগুলো মানুষের একসঙ্গে ভুল হবার তো কথা না! তাহলে?

তুলোর ন্যায় মিহি তন্তু; ছবিসূত্র: bbc.com

আরো আকাশযানের দেখা

সে বছরের অক্টোবরের শেষ নাগাদ কেবল ফ্লোরেন্স নয়, আশেপাশের বেশকিছু অঞ্চলেও এদের দেখতে পান স্থানীয়রা। পুরো টাস্কানী জুড়েই দানবীয় এসব বাহন নিঃশব্দে ঘুরে বেড়িয়েছে। ফ্লোরেন্সের অদূরবর্তী অঞ্চল প্রাটোতে অমাবস্যার অন্ধকার রাতে রহস্যজনক সাদাটে আলো ছড়িয়ে পড়তে দেখার অভিজ্ঞতাও জানান অনেকে। সেখানেও ঘটেছে একই ঘটনা। রুপালি তন্তু ছড়িয়ে পড়েছে মাঠেঘাটে, লোকালয়ে, বনেবাদাড়ে। এসময় লোকজন এর নাম দেন–এঞ্জেল হেয়ার বা দেবীর চুল। কারো কারো কৌতুহলে তোড়জোড় শুরু হয় এদের সংরক্ষণে। তেমনই একজন মানুষের নাম বাতিনি।

বেনামী সেসব আকাশযান ও এঞ্জেল হেয়ারের ঘটনা শোনামাত্র তিনি বেরিয়ে পড়লেন সেখানকার উদ্দেশ্যে। ঠিক লোকালয়ে নয়, লোকালয় ছেড়ে কিছুটা অদূরে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তিনি। কেননা, যখন তিনি শুনেছেন, ততক্ষণে হয়তো লোকালয়ের এসব রুপালি তন্তু মিলিয়ে গেছে। একমাত্র ভরসা এবার বনের ঝোপঝাড়। সেখানে নিশ্চিতভাবেই এদের পাবার কথা। তাই বন্য লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়ে মোড়ানো স্থানে সরাসরি পৌঁছে গেলেন তিনি।

হাতের সংস্পর্শে এসব তন্তু মিলিয়ে যাবার কথা বাতিনি আগে থেকেই জানতেন। তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ম্যাচের কাটি ও নলাকার কাঁচের জার। কাটির সাহায্যে আলতো করে পেঁচিয়ে এঞ্জেল হেয়ার পুরতে লাগলেন জারে। এরপর এদেরকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক গবেষণাগারে। কেননা, ততদিনে চারিদিকে এদের নিয়ে রটে গেছে নানান গল্পগুজব।

কেউ কেউ বলছিলেন–আকাশে উড়তে থাকা এসব বস্তু আসলে  বিশালাকৃতির কোনো মাকড়সা প্রজাতি ছিলো, যারা ঝাঁকবেধে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পাড়ি জমাচ্ছিল। উড়ে বেড়ানোর সময় এদেরই আঁশ বা জাল ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশে। সত্যিই কী তাই? এটা জানতেই সংরক্ষণকৃত এসব তন্তুর পরীক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছিল সেসময়।

কাঁচের জারে এঞ্জেল হেয়ার; ছবিসূত্র: bbc.com

পরীক্ষার ফলাফল

ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার তখন চরম ব্যস্ত সময় পার করছে। কেননা, বাতিনির মতো আরও অনেকেই তন্তুসমেত জড়ো হয়েছেন সেখানে। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। উৎসুক মানুষ অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছেন সবকিছু। অদূরে জানালার পাশে বসে গুনছেন অপেক্ষার প্রহর। স্থানীয় পত্রিকার ক্ষুদে সাংবাদিক বাতিনিও অপেক্ষা করতে লাগলেন এটা কী দিয়ে তৈরি তা দেখার জন্য।

পরীক্ষা করে দেখা গেল–এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বোরন ও সিলিকনের মতো মৌল। কিন্তু মাকড়সার জালে উপস্থিত থাকে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও ক্যালসিয়াম উপাদান। ঘটনা যেন পুরোপুরি বিপরীত। তাই এঞ্জেল হেয়ার যে পুরোটাই মাকড়সার জাল, এমন তত্ত্ব তখন আর ধোপে টেকে নি। এসময় এমন ধারণা পোষণকারী ব্যক্তিদের আলোচনা এখানেই ক্ষান্ত হলো।

এছাড়াও, এঞ্জেল হেয়ারে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম আর ক্যালসিয়াম সচরাচর আমাদের চেনা অনেক কিছুতেই পাওয়া যায়। কিন্তু এতে থাকা দুষ্প্রাপ্য মৌল বোরন আর সিলিকন আমাদের চেনা অনেক কিছুতে উপস্থিত থাকে না। অতএব, এখানেও যে রহস্য লুকিয়ে আছে, তা সকলেরই ততক্ষণে বোঝা শেষ। সুতরাং, চিরায়ত রীতি অনুযায়ী আবারও রটতে লাগলো নানান গুজব।

পত্রিকায় ছাপা ইউএফও এবং এঞ্জেল হেয়ারের সংবাদ; ছবিসূত্র: bbc.com

গুজবের নতুন রূপ

গুজব এবার মোড় নিল পুরোপুরি ভিন্ন পথে। অনেকে উপস্থাপন করতে লাগলো বিদঘুটে সব মতামত। তাদের মতে, শত্রুভাবাপন্ন দেশের যুদ্ধকৌশলের মহড়া এটি। কেউ কেউ তো আরো এক পা এগিয়ে। বলছিলেন–ভিনগ্রহের প্রাণীদের আবির্ভাবের সাথে সাথে মহাজাগতিক যুদ্ধের সূচনা হয়ে গেছে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি।

এছাড়াও কেউ আবার বলতে লাগলেন, এটা চোখের ভুল ছাড়া কিছুই না। তবে, এ সবকিছুই ছিলো সাধারণ মানুষদের কেবল ধারণা। সেদিন এতগুলো মানুষের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে যা ঘটেছিল তা-ও তো হেসে ফেলে দেবার না। আবার এই ঘটনার সঠিক উত্তরও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। 

সেদিনের সেই রহস্যজনক ঘটনার আর তেমন সমাধান হয় নি। রহস্য, রহস্য হিসেবেই থেকে যায় অদ্যাবধি। আকাশে ভেসে আসা কিম্ভূতকিমাকার সেসব আকাশযান আর এঞ্জেল হেয়ারের সত্যতা কতটুকু ছিল আর কতটুকুই বা কল্পনা তা খুঁজে বের করাও ছিল দুরূহ কাজ। কেননা, সে সময়কার পত্র-পত্রিকা ঘেঁটেও এ ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য জোগাড় করা সম্ভব নয়।

তবে, সেদিন স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকা দশ হাজার দর্শক আর খেলোয়াড়েরা আর যা-ই দেখে থাকুক, সেটা যে একেবারে নিছক ভাঁওতাবাজি নয় তা নিশ্চিতভাবে বলাই যেতে পারে। তাহলে কী ছিলো সেসব? চলুন আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাক।

আকাশের পানে ইউএফও দেখছে তারা; ছবিসূত্র: bbc.com

আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে ইউএফও রহস্য

নীল আকাশে উড়ন্ত বেনামি যান বা ইউএফও দেখার দাবি বেশ পুরনো। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য ও মিশরের আদিম ইতিহাসে এরকম লিপিবদ্ধ ঘটনার দেখা মিলে অহরহ। ঠিক সে সময় থেকে আজ অবধি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইউএফও দেখার জোর দাবি করে আসছেন অনেকেই। তাই বিষয়টি মীমাংসা করা জরুরি হয়ে পড়ে একসময়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ হাতে নেয় বেশকিছু প্রজেক্ট। গ্রহণ করে ইউএফও-রহস্য উন্মোচনকারী পরিকল্পনা। এদের মধ্যে অন্যতম প্রজেক্ট ব্লু বুক।

১৯৫২ সালের নভেম্বর মাস। মার্কিন বিমানবাহিনীর চৌকস একটি দল হাতে নেয় এই প্রজেক্ট। এর আওতায় খতিয়ে দেখা হবে ইউএফও-র যত রহস্য ছড়ানো অজানা ঘটনা। সময় যায়, ধীরে ধীরে এগোতে থাকে তাদের গবেষণা। এবং একসময় সর্বমোট ১২ হাজার ৬১৮টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে ফেলে তারা। এসব ঘটনার বেশিরভাগই– দৃষ্টিভ্রম, গোয়েন্দা বেলুনের উড়ে বেড়ানো, বা ফাইটার জেট বিমানের পরীক্ষণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অতএব, এলিয়েন নিয়ে মার্কিনিদের ভয়ের কোনো কারণ নেই জানিয়ে ১৯৬৯ সালে প্রজেক্টটির সফল সমাপ্তি টানা হয়।

সুতরাং, এখান থেকে সহজেই অনুমেয়, মানুষ অজানাকে ভয় পায়। এর সঠিক সমাধান খুঁজতে ব্যর্থ হলে দিতে থাকে অস্পষ্ট বর্ণনা। সৃষ্টি করে রোমাঞ্চকর নানান হেঁয়ালি, যা শুনে কাঁটা দেয় শরীরে, কেঁপে ওঠে অন্তরাত্মা! তবে প্রশ্নকর্তা মন জানতে চায়, কী পেয়েছিল তারা, প্রজেক্টের ফলাফলে?

ফাইটার জেট বিমানের পরীক্ষণ ও দৃষ্টিভ্রম; ছবিসূত্র: Getty Images

সফল প্রজেক্টের ফলাফল

প্রজেক্ট শেষ করে বেশকিছু ফলাফল হাতে আসে তাদের। এদের মধ্যে অন্যতম–

আবহাওয়া গবেষণা বেলুন
সেসময় আবহাওয়া গবেষণায় ব্যবহৃত হতো বিশালাকার সব বেলুন, যদিও তা জানতো না অনেকেই, জানানো হতো না সাধারণদের। স্বচ্ছ এসব বেলুন অনেক উপরে উঠতো বলে অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিতো মানব চক্ষুযুগলে। কখনো বাতাসের গতিবেগ বাড়লে দ্রুতগতিতে চলতে থাকতো এরা, আবার কখনো স্থির দাঁড়িয়ে থাকতো আকাশের এক কোণে। তা দেখেই মানব মনে দানা বাঁধতো রহস্য আর কৌতুহল।

বিমানের পরীক্ষণ ও মহড়া
সে সময় এখানকার মতো বিমান নির্মাণের প্রযুক্তি অতোটাও উন্নত ছিল না। ছিল না যথাযথ নজরদারি ও ব্যবস্থাপনাও। আবার, নির্মাণের পর পরীক্ষা করা হতো যত্রতত্র, যেখানে-সেখানে। তাই পরিচিত নয়, এমন অস্পষ্ট কিছু দেখলেই ইউএফও বলে ধরে নিতো অনেকেই।

ইচ্ছাকৃত গুজব ছড়ানো
হেরে যাওয়ার মতো ম্যাচ চলার সময় গুজব ছড়িয়ে খেলা পণ্ড করার রীতি অনেক প্রাচীন। আকাশযান থেকে রাসায়নিক দ্রব্য ছুঁড়ে ছড়ানো হতো এমনসব গুজব। ঘটানো হতো আজগুবি সব কাণ্ডকারখানা। এই তো সেদিন, ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমসে বিমানের সাহায্যে কৃত্রিম বৃষ্টিবর্ষণ করেছিল চীন। যদিও এটি ছিল পরিকল্পিত, নির্ধারিত দিনে বৃষ্টি যেন না হয় সেজন্য।

জলাভূমি থেকে নির্গত গ্যাস
আগেকার দিনে নির্জন জলাভূমি এলাকার তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যেতো। এর ভেতর থেকে নির্গত হতো প্রচুর পরিমাণ গ্যাস। এসব গ্যাস মাটি থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসতো উপরে। ভাসতে থাকে গুচ্ছাকারে, আকাশে। তা দেখেও অনেকের নজরে সৃষ্টি হতো দৃষ্টিবিভ্রম। ভাবতো, না জানি ভয়ানক কী দেখে ফেলেছে!

উল্কাপিণ্ডের আলোর ঝলকানি
এছাড়াও, দূর মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এসে সৃষ্টি করতো ঘর্ষণের। ধীরে ধীরে ভূপাতিত হতো ভূ-ভাগে, নির্জন মাঠ ও জলাশয়ে। সেখানে পড়ার কিছু সময় পূর্বেও নিজের আলোক ছড়িয়ে দিতো সে। ফলে তীব্র আলোয় জ্বলে উঠতো আশেপাশের এলাকা। এমন কিছু দেখেও অনেকেই ভাবতেন, এলিয়েন বাহনের সাদা আলো ছড়িয়ে পড়েছে বুঝি সে স্থানে।

ধেয়ে আসা উল্কাপিণ্ড; ছবিসূত্র: Wikipedia

পরিশেষে

ফ্লোরেন্সের আকাশের সেই রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে উপরের বিষয়গুলো মিলে যাচ্ছে, তাই না? হ্যাঁ, মিলে যাওয়ারই কথা, আর ঘটেছেও হয়তো তাই। সুতরাং, চলুন শেষ করি ছোট্ট একটি সত্যিকার গল্প দিয়ে, এতে করে গুজব কতটা বিদঘুটে হতে পারে তা আরও সহজেই বুঝতে পারবেন–

“বিখ্যাত পরিচালক ‘জর্জ অরসন ওয়ালেস’ একবার বেশ ভালো করেই পড়েছিলেন প্রখ্যাত লেখক ‘এইচ জি ওয়েলস’-এর ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ গল্পের একটি বই। অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েই মূলত লেখা হয়েছিল বইটির পটভূমি।

একদিন কী হলো– সিবিএস ন্যাশনাল রেডিওতে টকশোর অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন ওয়ালেস। কথা বলার একফাঁকে দর্শকদের সঙ্গে কেবল মজা করার অভিপ্রায়ে সেখান থেকে বেছে নেন একটি গল্প। তবে গল্পটি সত্যিকার ঘটনা আকারে বর্ণনা করতে থাকেন তিনি।

পৃথিবীর প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলের বাসিন্দারা নাকি পৃথিবী (ওয়ালেসের এলাকা) আক্রমণ করে বসেছে। সেখানকার গবেষকরা ছুড়ে মারতে শুরু করেছে নিজস্ব ল্যাবে তৈরি ভয়ংকর ডেথ রে (মরণ রশ্মি)! ঘটনাটি শোনামাত্র তৎক্ষণাৎ সেখানকার বাসিন্দারা ছাড়তে শুরু করেন এলাকা। আঁটঘাট বেঁধে পালাতে লাগেন যেখানে-সেখানে।

পরেরদিন, সংবাদপত্রে ঘটা করে ছাপাও হয় এই ঘটনা। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী নাকি রেডিওর সামনে বসে থাকার সময়ও নাকে পেয়েছেন বিষাক্ত ঝাঁজালো গ্যাসের গন্ধ। কেউ কেউ তো আবার নিস্তব্ধ রাতের আকাশে অদ্ভুত ধরনের আলোর ঝলকও দেখতে পেয়েছেন, বেশ দূর থেকে!

কিন্তু মজার বিষয় হলো- এই ঘটনার সত্যতা জানার পর অনেকেই হেসে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। কেউ কেউ খেয়ে যান রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা। ভাবেন- ওয়ালেসের মুখে ঘটনার এমন চমকপ্রদ বর্ণনা শুনে, সে সময়, এটা যে নিছকই বানোয়াট গল্প তা কেউই বুঝতে পারে নি। ধরতে পারে নি এর কৃত্রিমতা। আর তাই, ধারণা করা হয়, এভাবেই ছড়িয়েছে বেশিরভাগ আনআইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট বা ইউএফও-র যতসব রহস্যজনক গল্প।”

তবে, সত্যি কথা বলতে কী– এসব গল্প সত্যিকার মানুষের ভেতরকে নাড়া দেয়। আন্দোলিত করে ভেতরকার নীলরঙা জগৎকে। সৃষ্টি করে রহস্য ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটা একেবারেই স্বাভাবিক। বিজ্ঞান বলে, এর প্রয়োজনও রয়েছে বেশ। অজানাকে জানার ইচ্ছা, অদেখাকে দেখার প্রবল আগ্রহ আছে বলেই আজকের দুনিয়া এতো চমকপ্রদ, সুন্দর।

এই সুন্দর বিজ্ঞানের অপরূপ ভুবনে আপনাকে বারংবার স্বাগতম।

তথ্যসূত্র:

লেখাটি 21-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading