শুরু করি একটি মজার তথ্য দিয়ে। আমাদের বায়ুমণ্ডল কতখানি উঁচু পর্যন্ত বিস্তৃত? ঘনত্বের হেরফের হবে, তবে ভূমি থেকে প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের বিস্তার। দশ হাজার কিলোমিটার কিন্তু অনেক বড় একটি দূরত্ব। আপনি যদি দিনে মাত্র ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়ে, বাকি এক মুহূর্তও নষ্ট না করে, কোন বিশ্রাম না নিয়ে খুবই দ্রুতগতিতে হাঁটতে থাকেন, তারপরেও বায়ুমণ্ডলের এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আপনার সময় লাগবে প্রায় চার মাস!
এই বিশাল বিস্তৃতির বায়ুমণ্ডল কিন্তু পুরো পৃথিবী জুড়ে ঘেরা! তারপরেও এই সম্পূর্ণ বায়ুমণ্ডল সূর্য থেকে আসা বা পৃথিবী থেকে বিকিরিত হওয়া যে পরিমাণ তাপ ধরে রাখে, আপনি কি বলতে পারবেন সমুদ্রের কতখানি গভীরতা পর্যন্ত পানি তার সমপরিমাণ তাপ ধরে রাখতে পারবে? উত্তর হলো, মাত্র ৩ মিটার! হ্যাঁ, সঠিক পড়েছেন। মাত্র ৩ মিটারের (মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত) এই পানির গভীরতা প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার বায়ুর তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা দেখায় [1]। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি পানির তাপধারণ ক্ষমতা কতখানি বেশি। বিজ্ঞানীরা তাই সমুদ্রকেই পৃথিবীর অন্যতম প্রধান তাপ ভাণ্ডার (Heat reservoir) হিসেবে বিবেচনা করেন।
এই তথ্যের অবতারণা করার কারণ এই যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য যখন আমরা বলি যে “পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে”, আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে আসলে যা বুঝাই তা হলো “পৃথিবীর সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।” এখন কথা হলো, মহাসমুদ্র তো পাঁচটি – প্রশান্ত, আটলান্টিক, ভারত, উত্তর এবং দক্ষিণ মহাসাগর। কোন মহাসাগরের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বিগত চল্লিশ বছরে? উত্তর হলো, উত্তর (আর্কটিক) মহাসাগর। শুধু যে বেড়েছে তাই না, আর্কটিক মহাসাগরের তাপমাত্রা বাকি সব মহাসমুদ্রের গড় তাপমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে চলেছে [2]।
এখন সরাসরি প্রশ্ন চলে আসে: তো, আর্কটিক মহাসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে তো যাক না! আমি বাংলাদেশ এ থাকি, আমাকে কীভাবে তা প্রভাবিত করবে? আমি গ্রিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, বা সুইজারল্যান্ড এ থাকলে না হয় একটা কথা ছিল! চলুন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পরে দেখে নেয়া যাক “আমি বাংলাদেশ এ থাকি” এই ধারণা বেশি গুরত্বপূর্ণ নাকি “আমি পৃথিবীতে থাকি” এই ধারণা বেশি গুরত্বপূর্ণ।
সমগ্র পৃথিবীর আবহাওয়া বা জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে আর্কটিক মহাসাগর এর তিনটি প্রধান গুরত্বের কথা বলবো এখানে। প্রথাগতভাবে সবাই শুরু করে আর্কটিক মহাসাগরের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে। অবশ্যই এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ পয়েন্ট তবে আমি অন্য তিনটি ব্যাপারে আলোকপাত করবো যা প্রসঙ্গত আমাদের জন্য জানা জরুরি।
তাপ শোষণ
প্রথমত, আর্কটিক মহাসাগর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত তাপমাত্রা কার্যত শুষে নেয় (Heat sink) এবং সেই সাথে বড় একটি অংশ মহাকাশে প্রতিফলিত করে দেয় [3]। পানির তাপ ধারণ ক্ষমতার (৪২০০ জুল প্রতি কেজি) চেয়ে বরফের তাপ ধারণ ক্ষমতা (২১০০ জুল প্রতি কেজি) অনেক কম হওয়ায় বরফে ঢাকা অঞ্চল খুব দ্রুত ঠান্ডা হতে পারে।
একটা তাত্ত্বিক উদাহরণ দেয়া যাক। আর্কটিক মহাসাগর এর এক লক্ষ ভাগের এক ভাগও যদি হুট করে ঢাকা শহরের মাঝামাঝি কোথাও একদিনের জন্য রেখে দেয়া যেতো, সমগ্র ঢাকা শহরের কোন এক গ্রীষ্মের দুপুরের তাপমাত্রা সেই একদিনের মাঝেই মাত্র ৫° সেলসিয়াস এ নেমে যেতো। সুতরাং, এই প্রাসঙ্গিক উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি আর্কটিক কি অসাধারণভাবে আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে।
তাপ প্রতিফলন
দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্ব হিসেবে বলা যায়, আর্কটিক মহাসাগর এর বরফের উপস্থিতির কথা। সূর্যের রশ্মি যখন পৃথিবীতে প্রবেশ করে, যখন বরফ তা সহজে প্রতিফলিত করে দেয় (ঠিক যে কারণে আমরা গ্রীষ্মকালে সাদা কাপড় পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, কিংবা টেস্ট ম্যাচে ক্রিকেটাররা সাদা জার্সি পরেন)। এই ব্যাপারটিকে বলে পৃষ্ঠ আলবেডো (surface albedo)। অন্যদিকে যখন সাগর বরফে ঢাকা না থাকে, তখন পানি অতি সহজেই সূর্যের তাপ শুষে নিতে পারে এবং গরম হয়ে যায়।
আর্কটিক মহাসাগর প্রতি বছর কি পরিমাণ সূর্যের তাপ শোষণ করে তা অকল্পনীয়! সংখ্যাতে প্রায় ৫ জেটা জুল ( zetta joules)। অর্থাৎ, ৫ এর পরে ২১ টা শূন্য [4]! আরও পরিচিত ভাষায় ভেঙ্গে বললে, ৮০ বিলিয়ন হিরোশিমা বোম্ব যেই তাপ উৎপাদন করে তার সমান তাপ আর্কটিক মহাসাগর প্রতি বছর শুষে নেয় এবং তার বড় একটি অংশ মহাকাশেই ফেরত পাঠিয়ে দেয় ! চিন্তা করুন যদি আর্কটিকের সব বরফ গলে যায়, তাহলে এই ভয়াবহ পরিমাণ তাপ পৃথিবীর ট্রপিকাল দেশগুলো (বিশেষত বাংলাদেশ) এর তাপমাত্রা কীভাবে বাড়িয়ে তুলবে!
পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ
তৃতীয়ত, আর্কটিক মহাসাগর একটি সাধারণ মাধ্যম (common channel) হিসেবে প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগরের পানি মিশ্রিত করতে কাজ করে [5]। উত্তর মেরুতে বেরিং প্রণালি এবং ফ্রাম প্রণালি দিয়ে যথাক্রমে প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাগরের পানি আর্কটিক মহাসাগরে প্রবেশ করে। প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগরের পানির বৈশিষ্ট্য, ঘনত্ব, লবণাক্ততা, স্বচ্ছতা ভিন্ন। তাদের এই মিশ্রণটি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য নিয়ন্ত্রণে এবং দুই মহাসাগরের মধ্যে পুষ্টি উপাদান বিনিময়ের জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ। এবং আর্কটিক মহাসাগর এর মাধ্যমে তারা এই বিনিময়টি সম্পূর্ণ করে। এই লবণ এবং পুষ্টি বিনিময় পরবর্তীতে অন্যান্য সাগর এবং উপসাগরেও (যেমন, বঙ্গোপসাগর) জৈব বিচিত্রতা নিয়ে আসে। অর্থাৎ, আর্কটিক মহাসাগরের উপস্থিতি যে আমাদেরকে শুধু বায়ুমন্ডলভিত্তিক (atmospheric) উপকার করছে তা নয়, বরং পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং জলজ প্রাণীর স্থায়িত্ব ও বিচিত্রতা নিয়ন্ত্রণেও অসাধারণ ভূমিকা রাখছে।
পরিশিষ্ট
বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও অধ্যাপক লিন মারগুলিস এবং রসায়নবিদ অধ্যাপক জেমস লাভলক সত্তর দশকে প্রথমবারের মতো একটি তত্ত্ব প্রদান করেন যা পরবর্তীতে Gaia Hypothesis হিসেবে পরিচিতি পায় [6]। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সমস্ত পৃথিবী জীবন্ত (living organism)। পৃথিবীর কোন একটি অংশ আঘাত পেলে অনেক দূরের কোনো অংশও তার প্রতিফলন দেখাবে। আর্কটিক মহাসাগর পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ একটি উপাদান বটে, তবে এই আর্কটিক মহাসাগরই বর্তমানে সবচেয়ে ভঙ্গুর। সমগ্র পৃথিবী একসূত্রে এমনভাবে গাঁথা যে আমাদের মাঝে মাঝে এটা ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয়! তবে আশার কথা হলো, আর্কটিক মহাসাগর নিয়ে গবেষণার পৃষ্টপোষকতা এবং বিশ্বব্যাপী আর্কটিক মহাসাগর নিয়ে সম্মেলন অনেক বেড়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিরাপদ আর্কটিক এলাকার আয়তন ৫.৬% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১% (যা প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকা)। বিভিন্ন দেশের সরকার আর্কটিক মহাসাগরের গুরুত্ব বুঝে সেই অনুপাতে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। আমরা আজ পৃথিবীর সাথে কী করি তার নিগূঢ় প্রতিদান পাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। একজন বৈজ্ঞানিক হিসেবে তাই আমার দায়িত্ব বর্তমান অবস্থাকে সবার সামনে তুলে ধরা। আমাদের সম্মিলিত বোধোদয়ের জন্যই হয়তোবা আমাদের সন্তানেরা আমাদেরকে ধন্যবাদ জানাবে।
Leave a Reply