পৃথিবীতে পানির পরিমাণ
সময়টা গোধুলি। সূর্য অস্ত যাবে যাবে। আকাশ রক্তিম। সম্পূর্ণ রক্তিম না। হলুদ, কমলা, এবং লালেরা মিলে একটি ছবি আঁকছে। সেইন্ট মার্টিনের সৈকতে দাঁড়িয়ে আছে কিছু যুবক। তাদের পায়ে লেপটে আছে সৈকতের বালু। ঢেউ এসে পা ধুয়ে দিচ্ছে। এক পা আগাতেই আবারো দুই পা বালুময়। কোলাহল বিবর্জিত সন্ধ্যা। কিছু সামুদ্রিক বুবি পাখি ভরপেটে এখানে সেখানে টহল দিচ্ছে।
যুবকদল ক্লান্ত। তাদের মাঝে কেউ কেউ সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই কাছে বঙ্গোপসাগরের আলিঙ্গনের হাতছানি। অদৃশ্য মায়ায় সমুদ্র তাদের ডাকে। পরক্ষণেই সমুদ্রের গভীরতা তাদের ভয় পাইয়ে দেয়। তারা অবিচলিত, তবে কিছুটা পিছিয়ে আসে। জোয়ারের সময় চলে আসছে। সমুদ্র তার প্রবল দাপট বিস্তার করবে ঠিক এখনই। স্থলচর প্রাণীদের গর্বের সাথে মনে করিয়ে দিবে তার প্রতাপশালী সীমানার ব্যাপারে।
সমুদ্রের সীমানা বিস্তৃত। প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই বিস্তৃত জায়গায় প্রতি রাতে আকাশের খসে পড়া তারার প্রায় সবই চিরতরে হারিয়ে যায়। সমুদ্র এতোটা জায়গা জুড়ে আছে যে সমুদ্রের প্রায় ৯৫% প্রাণীকুলের ব্যাপারে আমরা আজও জানি না। সমুদ্রই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় “বাসযোগ্য” স্থান। তবে সমুদ্রের গভীরতা সব জায়গায় সমান না। কোনো জায়গায় কিছু মিটার গভীর – চাইলে দক্ষ সাঁতারু ঘুরে আসতে পারে। কিছু জায়গা কিলোমিটার দশেক গভীর – আলো কখনোই পৌঁছায়নি সেখানে।
নিচের ছবিটি খুবই চমকপ্রদ। তত্ত্বীয়ভাবে, পৃথিবীর সব পানি (হোক সমুদ্র, নদী, খাল, বিল, পুকুর, ঝরনা, এমনকি কুয়ো) যদি একসাথে বের করে নিয়ে এসে একটি গোলকে পরিণত করা যেতো, তাহলে তা দেখতে অনেকটা এমন হতো। তিনটি গোলক এখানে – সবচেয়ে বড়টি হলো পৃথিবীর সমস্ত পানি, মাঝেরটি হলো, শুধু স্বাদু পানি, এবং সবচেয়ে ছোটটি হলো শুধু নদী, হ্রদ, এবং খালের পানি। সম্ভবত আপনি অবাক হচ্ছেন এটা ভেবে যে গোলক তিনটির আকার এতো ছোট কেন। হ্যাঁ, আপনি সঠিক চিন্তাই করছেন।
পানির প্রধান উপস্থিতি পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠেই। তার নিচে পৃথিবী শুধুই একটি পাথুরে গ্রহ। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ্য প্রায় ছয় হাজার চারশ কিলোমিটার। পৃথিবীর পরিধি থেকে ভেতরের দিকে গড়ে মাত্র তিন থেকে চার কিলোমিটার বিস্তৃতি সমস্ত সমুদ্রের। সমুদ্রের পানির এই চিকন আস্তরণ শেষ হলেই মাটির বিভিন্ন স্তর শুরু হয়। বিশুদ্ধ পানির উপস্থিতি তাই অতি মূল্যবান। সেকারণেই সম্প্রতি অনেক গবেষক ধারণা করছেন, পরবর্তী যদি কোনো বিশ্বযুদ্ধ হয়, তা হবে বিশুদ্ধ পানির দখল নিজের আয়ত্তে আনার জন্য[1]। তবে আজকের এই লেখাটির উদ্দেশ্য শুধু লবণাক্ত পানি নিয়ে।
এতো লবণ কীভাবে এলো?
প্রথম কৌতূহলী (কিংবা বিপ্লবী!) মানুষটি যখন তার সমাজ থেকে একটু বিরতি নিয়ে সমুদ্রে পা রাখল তখন তার কিছুটা বিচলিত হওয়ার কথা। থমকে যাওয়ার কথা। নিশ্চয়ই তার দেখা নদী কিংবা হ্রদে এতো স্বচ্ছতা, গভীরতা, ও ব্যাপকতা ছিল না। আগ্রহ নিয়ে এই সমুদ্রের পানি পান করার পরে হয়ত সে আরও বেশি বিচলিত হয়েছে। কারণ এই পানি বেশি সময় মুখে রাখা যায় না। সে ফিরে গেছে তার লোকালয়ে। ঐতিহাসিকভাবে, সভ্যতা তাই সবসময়ই গড়ে উঠেছে মোহনাকে (Estuary) কেন্দ্র করে। স্বাদু পানির উপস্থিতি যেখানে বিলাসিতা নয়।
সাধারণত সমুদ্রের পানি প্রচণ্ড লবণাক্ত। প্রশ্ন হলো এই লবণ কীভাবে আসলো? নদী তো দিনশেষে সমুদ্রেই মিশে, তাহলে নদীর পানি লবণ কোথায়? যেই মিষ্টি বৃষ্টির পানি খালে বিলে ঝিলে আছড়ে পড়ে তা তো সমুদ্রেও মিশে, তাহলে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানিও কেনো স্বাদু নয়? মিষ্টতাকে আলিঙ্গন করতে তার বাঁধা কোথায়?
এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর বেশ সহজ। সমুদ্রে লবণের প্রধান উৎস মূলত দুইটিঃ ক) মাটি বয়ে আসা পানি এবং খ) গভীর সমুদ্র পৃষ্ঠের ফাটল নির্গত উপাদান। ব্যাপারটি এভাবে বুঝিয়ে বলা যায়ঃ পাথরে এবং মাটিতে প্রচুর মিনারেল (খনিজ) জাতীয় উপাদান জমা থাকে। বৃষ্টির (বা অন্যান্য উৎসের) পানি যখন তাদের ছুঁয়ে অন্য কোথাও গড়িয়ে পড়ে তখন সেই খনিজের একটা অংশ পানিতে মিশে যায়। বৃষ্টির পানি কিছুটা অম্লীয় বা এসিডিক (pH ৭ এর কম)।
এই অম্লীয় পানি যখন পাথরে পড়ে তখন তা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কিছুটা পাথর ক্ষয়ে দেয়। এই ক্ষয় কিছুটা ধাতব আয়ন মুক্ত করে দেয় যা পরবর্তীতে পানির স্রোতের সাথে সমুদ্রে গিয়ে মিশে। এই ধাতব আয়নের একটি বড় অংশ মূলত ক্যালসিয়াম (Ca2+) এবং সোডিয়াম (Na+)। বলে রাখা ভালো, সামুদ্রিক খোলসওয়ালা প্রাণীরা পুষ্টি উপাদান হিসেবে এই খনিজ আয়নগুলোর একটি অংশ গ্রহণ করে। বাকি খনিজগুলো সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়।
দ্বিতীয় উপাদান হলো সমুদ্রের গভীরের ফাটল থেকে নির্গত হওয়া প্রচণ্ড গরম তরল। আমরা জানি যে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ম্যাগমা আছে (চিত্র দ্রষ্টব্য)। ম্যাগমা হলো পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত প্রচণ্ড চাপে গলিত পদার্থের মিশ্রণ। এই মিশ্রণের প্রধান উপাদান হলো বিভিন্ন খনিজ ধাতু যেমন ম্যাংগানিজ, কোবাল্ট, লোহা, নিকেল, জিংক, কপার ইত্যাদি। প্রায়ই সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ নিঃসরণ (Hydrothermal vent) এবং অগ্ন্যুৎপাতের কারণে এই খনিজগুলো বের হয়ে আসে এবং সমুদ্রের পানির সাথে মিশে যায়। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, সমুদ্রের অভ্যন্তর একটি প্রচণ্ড সচল এবং গতিময় জায়গা। প্রতি মুহূর্তে এখানে হাজারের বেশি রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। মোট কথা, সমুদ্রের পানি উপর এবং নীচ, দুই জায়গা থেকেই লবণের জোগান পায়।
সব সমুদ্রই কি সমানভাবে লবণাক্ত?
এটি একটি চমৎকার প্রশ্ন। দ্রুত উত্তর হলোঃ না। পৃথিবীর পাঁচটি মহাসাগর সম্পর্কেই এই লেখায় আলোকপাত করবো। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে সমুদ্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর পানি লবণাক্ত [3]। প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলো হচ্ছেঃ অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, সোডিয়াম, এবং ক্লোরিন। বলা বাহুল্য, এই সোডিয়াম ক্লোরাইডই হলো সেই যৌগ যাকে আমরা খাবার লবণ হিসেবে ব্যবহার করি।
দৈর্ঘ্য (মিটার), তাপমাত্রা (ডিগ্রি সেলসিয়াস), সময় (সেকেন্ড) পরিমাপের মতো লবণাক্ততা পরিমাপেরও একটি একক আছে। বহুল ব্যবহৃত একটি একক হলো ppt (parts per thousands, বা প্রতি এক হাজার পানির অণুতে কত অণু লবণ মিশ্রিত)। সাধারণত, সমুদ্রের ppt ৩৩ থেকে ৩৭। তবে সমুদ্রভেদে এই মান কমবেশি হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত সাগর হলো লোহিত সাগর এবং পার্সিয়ান গালফ অঞ্চল যাদের লবণাক্ততা প্রায় ৪০ ppt। লবণাক্ত জলাশয়দের মধ্যে মৃত সাগর বা Dead Sea কে অন্যতম লবণাক্ত জলাধার হিসেবে ধরা হয়। ধারণা করা হয় এই সাগরে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন টন লবণ মজুদ আছে। মহাসাগরদের মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের লবণাক্ততা বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরের কম। এবং উত্তর এবং দক্ষিণ মহাসাগরের লবণাক্ততা বছর জুড়ে বেশ হেরফের করে। কিন্তু কেন?
প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর নিরক্ষরেখার বড় একটি অঞ্চল জুড়ে আছে। এই ট্রপিকাল অংশে সারাবছর ধরে বৃষ্টিপাত হতে থাকে [4]। বৃষ্টির পানি মিষ্টি। যার ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পানির উপরিভাগও অতোটা লবণাক্ত না। আটলান্টিক মহাসাগরের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি সামান্য পরিসরে সত্য তবে প্রশান্ত মহাসাগরের মতো এতো ঘটা করে সম্ভব হয় না। যে কয়টি কারণে আটলান্টিক মহাসাগরের লবণাক্ততা অনেক বেশি তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলোঃ ভূমধ্যসাগরের অতিরিক্ত বাষ্পীভবন এবং এই লবণাক্ত সাগরের পানির সরাসরি আটলান্টিকে প্রবেশ, সমুদ্র অভ্যন্তরীণ অগ্ন্যুৎপাত, অন্তর্পৃষ্ঠ ভেন্ট (seafloor vent), এবং লবণ ডোমের উপস্থিতি।
প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগর যখন একে ওপরের দেখা পায় তখন চমকপ্রদ দৃশ্য সৃষ্টি হয়। চিলির বেগাল চ্যানেল, ড্রেক প্যাসেজ, উত্তর মেরু ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় এই দুই মহাসাগরের পানি মিশ্রিত হয়। উপরের ছবিটি থেকে আমরা একটি ধারণা পাই যে লবণ এবং ঘনত্বের ভিন্নতার কারণে একই যৌগের দুই ভিন্ন বর্ণ এবং ধর্ম সৃষ্টি হয়। এই লবণের তারতম্যের কারণে এই দুই মহাসাগরের বাস্তুতন্ত্র এবং জলবায়ুর গঠনও ভিন্ন।
উত্তর এবং দক্ষিণ মহাসাগরের ক্ষেত্রে একটু অন্যরকম ব্যাখ্যা। এই দুই মহাসাগরই পৃথিবীর দুই মেরুতে। প্রায় সারাবছরই এরা বরফে ঢাকা থাকে। বরফ কম লবণাক্ত। কিন্তু গ্রীষ্মকালে যখন বরফগলা শুরু করে তখন সেই “মিষ্টি” বরফ পানির সাথে মিশে যেয়ে সমুদ্রের লবণাক্ততা কমিয়ে দেয়। তবে শীতে এই দুই সমুদ্রই তাঁদের স্বাভাবিক লবণাক্ততা আবার ফিরে পায়।
পানির তাপমাত্রা লবণের পরিমাণকে নিয়ন্ত্রিত করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সত্য। পৃথিবীর সকল সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা লবণের পরিমাণকে হেরফের করে দিচ্ছে। এবং সেই সাথে ঠিক এই মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পানির নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণাক্ততার উপরে সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য সমুদ্রের লবণাক্ততার পিছনের বিজ্ঞানকে আলোকপাত করা। পরবর্তী লেখায় আমি সমুদ্রের লবণাক্ততার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। বাংলাদেশ একটি সমুদ্র-সংলগ্ন কৃষিপ্রধান দেশ। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর সমুদ্রগুলোর গতিবিদ্যা যেভাবে বদলে যাচ্ছে, সেকারণে পৃথিবীর অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমরা আশা করি আমাদের অর্জিত জ্ঞান এবং সচেতনতা আমাদের অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়কে সম্পূর্ণ ঠেকাতে না পারলেও ক্ষতির হার অনেকাংশে কমিয়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply