এক্সোপ্ল্যানেট- বহিঃসৌরগ্রহের খোঁজে

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

এক্সোপ্ল্যানেট বা বাহ্যগ্রহ বলতে বোঝায় আমাদের সৌরজগতে আমরা যেসকল গ্রহদের চিনি তাদের বাইরের গ্রহ। অর্থাৎ সৌরজগতের বাইরের গ্রহ গুলোকেই বলা হয় এই এক্সোপ্ল্যানেট। লেখক ইশতিয়াক হোসেন চৌধুরী তার অসাধারণ লেখনীর সাহায্যে এক্সোপ্ল্যানেট: বহিঃসৌরগ্রহের খোঁজে বইটি লিখেছেন। বইটি লিখতে তিনি সাহায্য নিয়েছেন এলিজাবেথ টাস্কারের লেখা দ্য প্ল্যানেট ফ্যাক্টরি বই থেকে। তবে এটা একদম লাইন ধরে ধরে অনুবাদ নয়। এতে রয়েছে একটা গ্রহের জন্ম থেকে শুরু করে তার জীবনের শেষ পর্যন্ত চলার কাহিনি।

বইটি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। মানে এতে রয়েছে তিনটি মূল অধ্যায়। যথাক্রমে এক্সোপ্ল্যানেটের খোঁজে, মহাশূন্যে গ্রহদের জন্মরহস্য ও বিপজ্জনক গ্রহদের রাজ্যে। বর্তমান বিশ্বে মহাকাশ গবেষণার অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে বহিঃসৌরগ্রহ অনুসন্ধান। মহাবিশ্বের কোথাও আমাদের মতো আরেকটা পৃথিবী আছে কিনা এ নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেকদিনের। মহাকাশবিজ্ঞানীরা কি করে দূর মহাকাশে বহিঃসৌরগ্রহ খোঁজেন? এই বইয়ের প্রথমে আছে সেই কাহিনী। কিভাবে আবিষ্কার হলো প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট। সৌরজতের বাইরে কোনো নক্ষত্রকে ঘুরতে থাকা কোনো গ্রহ প্রথম আবিষ্কার করেন জ্যোতিঃপদার্থবিদ মাইকেল মায়োর। তিনি যে পদ্ধতিতে এই গ্রহ খুঁজে পান তার নাম হলো রেডিয়াল ভেলোসিটি ম্যাথোড।

লেখক ইশতিয়াক চৌধুরী

আমরা জানি, এই মহাবিশ্বে দুটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। একে বলে মহাকর্ষ। এই মহাকর্ষের কারণে কম ভরে বস্তু বেশি ভরের বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরে। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এরা ঘুরে এদের ভরকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে। আমাদের সৌরজতের সব গ্রহের ভর সূর্যের চেয়ে কম তাই এই ভরকেন্দ্র সূর্যের মধ্যেই পড়ে। যা দেখে মনে হয় গ্রহ গুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আর গ্রহের ভর যদি অনেক হয় তাহলে তার ভরকেন্দ্র নক্ষত্র থেকে বাইরে চলে আসে। যা ঐ নক্ষত্রের ঘূর্ণনে পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তন থেকেই বলা যায় গ্রহটা কেমন। এটাই রেডিয়াল ভেলোসিটি ম্যাথোড যা মাইকেল মায়োর ব্যবহার করেছিলেন গ্রহ অনুসন্ধানে। এই পদ্ধতির আবিষ্কারে একটা ইতিহাস আছে যা লেখক চমৎকার ভাবে বলেছেন। গ্রহ খুঁজতে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো ট্রানজিট ম্যাথোড। এছাড়া আরো নানা পদ্ধতির বর্ণনা পাবেন এই বইতে। এই রকম বাংলা ভাষায় আর নেই বলা যায়। খেয়াল করবেন এক্সোপ্ল্যানেটের নামগুলো একটু অদ্ভুতরে হয়। বইয়ে সুন্দর করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরকম অদ্ভুত নামকরণের কারণ। সঙ্গে উল্লেখ আছে কোন  নামের কি মানে। যা জানলে আপনি সামনে আর কোনো এক্সোপ্ল্যানেটের নাম দেখে চমকে যাবেন না।

এর পরের অধ্যায়ে আছে গ্রহদের জন্মকথা। এটা নিয়ে আমি বেশি কিছু বলবো না। এই অংশটা একটা আশ্চর্য জায়গা। পাঠক এই অংশ পড়ার সময় একদম সৌরজগতের জন্মের সময়ে চলে যাবেন। কারণ বাইরের গ্রহ বা অন্য সৌরজগতের জন্ম জানতে হলে আমাদের সৌরজগতের জন্মরহস্য উন্মোচন জরুরি। এই অংশে লেখক কীভাবে গ্যাস থেকে গ্রহ গুলো হলো তা বিস্তারিত বলেছেন। নানা রকমের থিওরি তারা কোন কোন অংশে ব্যর্থ আবার সেই ব্যর্থতা ঢাকতে অন্য থিওরির উদ্ভোব। এভাবেই এগিয়েছে এই অংশ যা পাঠককে অনেক অজানা জিনিস জানাবে। তবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে পৃথিবীতে পানি রহস্যের ব্যাপারটা। পৃথিবীতে পানি কীভাবে এলো এটা ব্যাখা করতে গিয়ে লেখক চলে গেছেন ধূমকেতুর কাছে। যা তাকে নিয়ে গেছে ওরট ক্লাউড ও কুইপার বেল্টের জগতে। এসমস্ত কিছু নিয়েই বিস্তরে জানা যাবে বইটি পাঠ করে।  

ধূমকেতু সম্পর্কে বলতে গিয়ে দুটো সাম্প্রতিক ঘটনা ওঠে এসেছে। একটা হলো রোসেটা মহাকাশযানের ধুমকেতু 67P এর কাছাকাছি পৌঁছা ও ২০১৪ সালে তা থেকে এটা রোভার ফিলেই প্রথমবারের মতো কোনো ধুমকেতুর কক্ষপথে নামা। আর অন্য ঘটনা হলো ২০১৪ সালে জাপানের পাঠানো হায়াবোসা-২ ও ২০১৬ সালে পাঠানো নাসার মিশন OSIRIX-REX। যা আলাদা আলাদা ধুমকেতুতে নেমে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। এই সম্প্রতি হওয়া ঘটনার বিবরণ বইটাকে আরো আপডেটেড করে তুলেছে। এই বইতে বর্তমান সময়ে চলমান অনেক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

এরের পরের অংশে রয়েছে নানারকম গ্রহদের গল্প। হরেক রকম গ্রহের মেলা বলা যায়। এদের মধ্যে আছে হট জুপিটারদের কথা। আছে সুপার আর্থদের কথা। শুধু তা-ই না এরা কেন এমন তারও ব্যাখা রয়েছে এই বইতে। এগুলো কেমন তা জানতে আপনাকে বইটি পড়তে হবে। আপনি জানবেন নানা থিওরি সম্পর্কে। আর মজার ব্যাপার হলো লেখক এসবের ব্যাখা দিতে আমাদের এদেশের নানা জিনিসের উদাহরণ দিয়েছেন। নানা সিনেমা আর বইয়েরও সাহায্য নিয়েছেন। আপনি “ফরেস্ট গাম্প” সিনেমার লাইন যেমন পাবেন তেমনি পাবেন “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেনি”- বই থেকেও উদাহরণ। ফলে মাঝেমধ্যে খানিকটা রসবোধের যোগানও হয়ে যাবে। 

এই বইয়ে আপনি পাবেন জোসেলিন বেলের গল্প। যিনি আবিষ্কার করেছিলেন পালসার। কিন্তু নারী হওয়ার কারনে তাকে নোবেল দেয়া হয়নি। নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে এক্সোপ্ল্যানেটের বইয়ে পালসার কেন? কারণ প্রথম যে এক্সোপ্লানেট আবিষ্কার হয়েছিলো তা একটি পালসারকে কেন্দ্র করে ঘুরছিলো। এইটা প্রথম আবিষ্কার করেন অ্যালেক্স ওলসম্যান ১৯৯২ সালে। কিন্তু তাকে কৃতিত্ব না দিয়ে দেয়া হয় মায়োরকে যিনি ১৯৯৫ সালে আবিষ্কার করেন। এই বৈষম্যের কারণ হলো মায়োরের প্ল্যানেট ছিলো আমাদের মতো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরা। এসব বৈষম্যের কাহিনি আছে এই বইয়ে। এছাড়া আছে মঙ্গলগ্রহের অদ্ভূত সব আচরণের কথা। 

এছাড়া জানা যাবে এক্সোমুন নিয়ে। সৌরজগতের বাইরে যেসব গ্রহ আছে তাদেরও অবশ্যই চাঁদ আছে। বিজ্ঞানীরা এখন সেই চাঁদ খোঁজার চেষ্টায় আছেন। তাঁরা এ জন্য ট্রানজিট টাইমিং ভেরিয়েশন বা TTV নামক একটা পদ্ধতির ব্যবহার করছেন যার কথাও এই বইতে পাবেন। এই বই আপনাকে নতুন এক জগতের সাথে পরিচয় করাবে।

কোনো কিছুই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তেমনি এই বইয়ের কিছু বিষয় নিয়েও একটু সমালোচনা করাই যায়। প্রথমেই আমার মনে হয়েছে পর্যাপ্ত ছবির অভাব। যেমন বিজ্ঞানীদের নামের সাথে তাদের ছবি দেয়া উচিত ছিলো। বইটাতে নানা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে যেমন ভ্যানডার ওয়ালস বল বা আরো অনেক যা এটা ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের মতো করেছে। এগুলোর আলাদা ব্যাখা বইয়ের শেষে দিলে ভালো হতো। এককথায় বলা যায় এমন বইয়েরই এখন বেশি দরকার। যা পাঠককে অনেকটা গভীরে নিয়ে যেতে ও আপডেট রাখতে সাহায্য করবে। বইটা আপনাকে এক্সোপ্ল্যানেটের সব তথ্যের সঙ্গে একটু হলেও পরিচিত করাবে। যা আপনার মনের জানালা খুলে দেবে আর ভাবতে বাধ্য করবে কত বিচিত্র আমাদের এই মহাবিশ্ব।

লেখাটি 61-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading