বর্তমানে পৃথিবীর সব মানুষ একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের এক কোণায় থাকা একজন মানুষ কিংবা আমেরিকার একজন বিলিয়নিয়ার, দুজনেই একই প্রজাতি তথা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। আর গত প্রায় তিন লক্ষ বছর ধরে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে শাসন করছে মানুষের এই প্রজাতি। তবে কয়েক লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে শুধু হোমো সেপিয়েন্সই ছিলো না। বরং মানুষের অনেকগুলো প্রজাতি পৃথিবী চষে বেড়াতো। এখন থেকে মাত্র ১ লক্ষ বছর পেছনে গেলেই আমরা মানুষের অন্তত পাঁচটি প্রজাতিকে পেয়ে যেতাম। এদের কারও আকার মানুষের চেয়ে বড়, কেউ বা আবার আকারে ছোট, কারো মাথার খুলির আকার বড়, কেউ বা একটা ছোট দ্বীপে আটকে রয়েছে।
এরকম একটা বৈচিত্র্যময় সময় পেরিয়ে শুধুমাত্র হোমো সেপিয়েন্স’রাই টিকে থাকতে পেরেছে। মানুষের বাকি প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র কেন হোমো সেপিয়েন্স’রা টিকে গেলো তা নিয়ে নানা ধরণের হাইপোথিসিস আছে। সে আরেক বিশাল ঘটনা। তবে আজ আমরা আলোচনা করবো মানুষের হারিয়ে যাওয়া এক আত্মীয় সম্পর্কে। হ্যাঁ,মানুষের নতুন এক প্রজাতি সম্পর্কে, যারা মাত্র ৫০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি চীনে প্রাপ্ত কিছু জীবাশ্ম থেকে তাদের পরিচয় বের করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস ও যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল নৃতত্ত্ববিদের যৌথ গবেষণায় হোমিনিন প্রজাতির নতুন এই সদস্যদের আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। আদিম মানুষের নতুন এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে ‘হোমো জুলুয়েনসিস (H. juluensis)’। নেচার কমিউনিকেশনস অ্যান্ড প্যালিওএনথ্রোপলজি সাময়িকীতে নতুন এই প্রজাতি’র আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। মূল নিবন্ধ’টি এখানে¹। এই প্রজাতির মানুষের খুলির আকার হোমো সেপিয়েন্স’দের তুলনায় বড় হওয়ায় এদের নাম দেওয়া হয়েছে হোমো জুলুয়েনসিস। ‘জুলুয়েনসিস’ শব্দের অর্থ বড় মাথা। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া মানুষের অন্যান্য প্রজাতি তথা অন্যান্য হোমিনিন প্রজাতির থেকে বেশ পার্থক্য রয়েছে নতুন এই মানবপ্রজাতির। এদের করোটির আকার ১০৩ থেকে ১০৯ ঘনইঞ্চি। যেখানে নিয়ান্ডারথালদের করোটির আকার গড়ে ৮৮ ঘন ইঞ্চি এবং আধুনিক মানুষদের গড়ে ৮২ ঘন ইঞ্চি। এছাড়াও এদের ফসিলের আশেপাশে বিভিন্ন প্রাণীর হাড়গোড় দেখে ধারণা করা হয় এরা দক্ষ শিকারী ছিল! চীনের জুজিয়াও অঞ্চল থেকে এই প্রজাতির মানুষের ১৬টি ফসিল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ৩ লাখ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে জুলুয়েনসিস প্রজাতির মানুষের বসবাস ছিল। গবেষকেরা মনে করেন, এই প্রজাতি হিমশীতল ঠান্ডায় বেঁচে থাকার জন্য বন্য ঘোড়া, পাথরের তৈরি হাতিয়ার ও প্রক্রিয়াজাত পশুর চামড়া ব্যবহার করত। তবে হঠাৎ করে ৫০ হাজার বছর আগে কেন এরা বিলুপ্ত হয়ে গেল তা নিয়ে গবেষকদের মাঝে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
এখন থেকে প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে আধুনিক বুদ্ধিমান মানুষের(হোমো সেপিয়েন্স) পূর্বপুরুষের উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকায়। এরপর তারা খুব দ্রুতই আফ্রিকা ছেড়ে দিয়ে ইউরোপ এবং এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। নৃতাত্ত্বিক’রা সাধারণত মানুষের নানা ধরণের প্রজাতির উদ্ভব এবং ছড়িয়ে পড়া নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানেই উঠে আসে নতুন এই প্রজাতির তথ্য। ৭ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ বছর আগ পর্যন্ত মানুষের অনেকগুলো প্রজাতি পৃথিবীতে বাস করতো। এদের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের হোমো হেইডেলবারজেন্সিস এবং মধ্য চীনের হোমো লঙ্গি প্রজাতিগুলো অন্যতম। এদের ‘মধ্য প্লেইস্টোসিন হোমো’ বা ‘আদিম হোমো’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া’য় নতুন নতুন মানুষের প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে।
নতুন এই প্রজাতি সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক’রা আরো আগেই জানতে পেরেছিলেন। ২০২৪ সালের মে মাসে ‘প্যালিওএনথ্রোপলজি’ জার্নালে এদের সম্পর্কে খবর ছাপা হয়। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ ‘ক্রিস্টোফার জে বে’ এবং চীনের ‘ইনস্টিটিউট অফ প্যালিওএনথ্রোপলজি’র প্রফেসর ‘জিওজি ও’ এই গবেষণার প্রধান গবেষক ছিলেন। তাদের মতে এই প্রজাতির সাথে ডেনিসোভান’দের অনেক মিল রয়েছে। এছাড়াও এখন থেকে ৩-৫ লক্ষ বছর আগে এরা পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন এই প্রজাতির কোনো নাম দেওয়া না হলেও ২ নভেম্বর প্রকাশিত নিবন্ধে এদের নাম দেওয়া হয় হোমো জুলুয়েনসিস। ১৯৭৪ সালে চীনের জুজিয়াও অঞ্চলে খোঁড়াখুঁড়ি’’র সময় ১০ হাজার পাথরের সরঞ্জাম ২১ টি হোমিনিন এর জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়। সেখান থেকে ১৬ টি জীবাশ্মের বৈশিষ্ট্য একইরকম ছিল। পরবর্তীতে এদের আলাদা করা হয় এবং নামকরণ করা হয় ‘বড় মস্তিষ্কের মানব’ হিসেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে নতুন এই প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল। তবে প্রজাতির নামকরণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে এখন বিতর্ক চলছে।
গত কয়েক বছর ধরে মানুষের বিবর্তনীয় বৃক্ষে নতুন নতুন সদস্য যুক্ত হয়েছে। প্রতিটি সদস্য যেন পাজলের এক একটি টুকরা। প্রায় প্রতিনিয়তই পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন মানবপ্রজাতির হদিস। ২০০৩ সালে ইন্দোনেশিয়া’য় মানুষের ক্ষুদ্রতম প্রজাতি হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস’দের আবিষ্কার করেন নৃতাত্ত্বিক’রা। এরপর ২০০৭ সালে ফিলিপিনে খোঁজ পাওয়া যায় আরো এক প্রজাতি হোমো লুজুনেন্সিস’দের। তারপর ২০১০ সালে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ডেনিসোভান’দের নতুন ডেরার সন্ধান পাওয়া যায়। ২০২১ সালে আবিষ্কার হয় হোমো লঙ্গি নামক মানুষের আরেক প্রজাতির। এভাবেই প্রতিনিয়ত মানুষের বিবর্তন নামক পাজলের বিভিন্ন টুকরা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ধীরে ধীরে উদঘাটন হচ্ছে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কিত সকল রহস্যের। একদিন হয়তো এই রহস্যের পুরোটা জানতে পারবো আমরা!
তথ্যসূত্র-
Making sense of eastern Asian Late Quaternary hominin variability | Nature Communications
Leave a Reply