সমুদ্র সৃষ্টির আদ্যোপান্ত 


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

এত বড় পৃথিবীর প্রায় পুরোটাই তো সমুদ্র। তাই যৌক্তিকভাবে মেনে নেওয়া যায় যে, সমুদ্র সৃষ্টির রহস্যের সাথে পৃথিবী সৃষ্টির রহস্যের ওতোপ্রোত বন্ধন জড়ানো। সত্যি বলতে, পৃথিবী এবং সমুদ্রের সৃষ্টির একটি অসাধারণ সুন্দর গল্প আছে। এই গল্পটি বলার আগে ছোট পাদটীকা-

তত্ত্ব এবং প্রস্তাবনা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। আজ আমরা পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে যা জানি তা দেড় শ বছর আগের কোনো জ্ঞানী মানুষকে বললে সে হয়ত ভ্রূ কুঁচকে তাকাতো। একইভাবে, এখন থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পর হয়ত মহাবিশ্ব সৃষ্টির মৌলিক গল্পটা সম্পূর্ণ নতুনভাবে আলোচিত হবে। 

প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে! “সময়” এবং “স্থান” এর জন্ম হয়। আমরা এই ঘটনাকে “বিগ ব্যাং” নাম দিয়েছি [1]। “বিগ ব্যাং” এর আগে কী হয়েছিল, কে কোথায় ছিল, সময় কীভাবে পার হতো – এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা নারাজ। আমরা যা দেখি (এবং দেখি না) তার সবই পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মধ্যে পরে। দুই ট্রিলিয়ন এর বেশি গ্যালাক্সি, যার প্রতিটিতে কয়েকশ বিলিয়নের বেশি সূর্য (তারা), সেই প্রতিটি সূর্যের চারদিকে অনেকগুলো গ্রহ, উপগ্রহ – মহাবিশ্বের এই গল্প এক অনুচ্ছেদে লেখার সাহস দেখানোও কম কথা নয়। 

তাই আমরা সরাসরি আমাদের মনোযোগ নিয়ে আসবো মহাবিশ্বের “সাম্প্রতিক” সময়ে। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে। পরোক্ষভাবে, আজকের পৃথিবী এবং তার সকল সমুদ্রের সূত্রপাত এক সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে [2]! এই বিস্ফোরণের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় ধূলিকণা ও ঘন কুয়াশা মেঘ (নেবুলা)। সৌরজগৎ তখনও সৃষ্টি হয়নি। এখানে সেখানে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ঠান্ডা কণা। সময়ের সাথে সাথে তারা মহাকর্ষ বলের কারণে একত্রিত হতে শুরু করে। মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মতে মহাকর্ষ বল হলো একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যা দ্বারা সব বস্তু একে অন্যকে আকর্ষণ করে। মহাকর্ষ বলের সকল ধূলিকণাকে একত্রে পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছে। প্রথমবারের মতো সৌরজগৎ তার আকার এবং গতিবিদ্যা প্রকাশ করছে। এই সময়টাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন পরিবৃদ্ধি দশা (accretion phase) [3]।

গ্রহ, উপগ্রহ, এবং গ্রহাণুরা এই মেলবন্ধনের ফসল। তাদের মৌলিক উপাদানগুলো আসলে বহু আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো তারার । এমনি আমরাও তারার ধূলিকণা! আমাদের শরীরের মৌলিক উপাদান প্রথম সৃষ্টি হয় সূর্যের হৃদয় কোটর থেকে। আমাদের হাড়, মস্তিষ্ক, ত্বক সবকিছু আমাদের সূর্যের গর্বিত অংশীদার। এবং আজকের সুর্যও এসেছে অতিপ্রাচীন কোনো তারার মৃত সমাধি থেকে। দার্শনিকভাবে, আমাদের অণু পরমাণু সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো সুপ্রাচীন কোনো অজানা তারার প্রথম একীভবন (ফিউশন) বিক্রিয়ায়, সৌরজগৎ সৃষ্টিরও বহু, বহু আগে। 

ছবিঃ শিল্পীর কল্পনায় সোলার নেব্যুলা। সৌরজগৎ তখন সৃষ্টি হচ্ছে। সূর্য তখন কেন্দ্রে। প্রচণ্ড ধূলিময় চারপাশ। এই ধূলিকণাই পরবর্তীতে জমা হয়ে সৃষ্টি করবে সকল গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, এবং ধূমকেতু। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ নাসা। 

দার্শনিকতা থেকে এক পা পিছিয়ে চলে আসি আমাদের ঘটনাবহুল সৌরজগতে। পৃথিবী তখন তার জন্মলগ্নে। পৃথিবী তখন ঠিক আজকের পৃথিবী না। জন কোলাহল, সমুদ্রের ঢেউ, পূর্ণিমার চাঁদ, রিমঝিম বৃষ্টি, কিংবা খরগোশের ছোটাছুটি – কোনোকিছুই এই পৃথিবীতে নেই। বরং, এই গ্রহটি এই পর্যায়ে ছিল একটি অতি উত্তপ্ত গলিত ধাতব গোলক। তার ওপর, ক্ষণে ক্ষণে ধূমকেতু, গ্রহাণু, এবং অন্যান্য মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষের আঘাতে আর ঘর্ষণে এই গোলোকের উপরিভাগ এর ঠান্ডা হওয়া যেন এক অসম্ভব ব্যাপার [4]। প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর ধরে চলে এই ধ্বংসযজ্ঞ উল্লাস। 

তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে আজকের পৃথিবী এতোটা ভিন্ন? এর উত্তরটা সুন্দর, তবে এই উত্তরটা পেতে পৃথিবীর নিজেরও আরও প্রায় চার বিলিয়নেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা জানি যে কোনো তরল মিশ্রণে অধিক ভারী এবং ঘন পদার্থ নিচে পরে যাবে এবং উপরে ভেসে থাকবে হালকা দ্রব্য। একইভাবে, মাধ্যাকর্ষণ বল উত্তপ্ত গলিত শিশু পৃথিবীর ভারী ধাতুগুলোকে (লোহা, নিকেল, জিংক, তামা) নিচে নিয়ে যায় এবং উপরিপৃষ্ঠে পরে থাকে হালকা ধাতু এবং খনিজ, যেমন, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম, ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে ঠান্ডা হতে হতে, এরাই তৈরি করে আজকের ভূত্বক। এই ঘটনাকে বলা হয় ঘনত্ব স্তরবিন্যাস বা density stratification [5]।

accretion-nature.jpg
ছবিঃ শিল্পীর তুলিতে প্রাথমিক যুগে পৃথিবীর গঠন। তখনো সৌরজগৎ জুড়ে গ্রহাণুরা ছোটাছুটি করে যাচ্ছে। শিশু পৃথিবীর জন্য প্রচণ্ড ধাক্কা এবং বিশাল বিস্ফোরণ ছিল নিত্তনৈমত্তিক ঘটনা। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ নেচার পাবলিকেশন। 

ঠিক সময়টায় আরেকটি আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটে! জন্ম গ্রহণ করে চাঁদ। তরুণ পৃথিবী তখনও ঠান্ডা হচ্ছে। তার পৃষ্ঠদেশ তখনও জমাট বাঁধছে। তবে নিরবচ্ছিন্নভাবে তা হওয়ার সুযোগ রইলো না। একদল বিজ্ঞানীর মতে, এই সময়টায় প্রায় মঙ্গল গ্রহের আকারের একটি বস্তু পৃথিবী পৃষ্ঠে সজোরে আঘাত করে। এই আঘাত এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে শুধু তা পৃথিবীর পৃষ্ঠকেই পরিবর্তন করেননি বরং ততদিনে সৃষ্টি হওয়া পৃথিবীর ঘনত্ব স্তরবিন্যাসকে ভেদ করে অভ্যন্তরীণ গলিত ধাতুর একটি বড় অংশ ছিটকে বেরিয়ে আসে। সজোরে তা নিক্ষেপিত হয় মহাশূন্যে! কিন্তু তা বাঁধা পরে তরুণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলয়ে। সেই গলিত ছোট বল সময়ের সাথে সাথে ঠান্ডা হয়। সৃষ্টি হয় আজকে চাঁদ [6]। আজও তাই চাঁদ এর অভ্যন্তরে সেইসব ধাতব পদার্থের সন্ধান আমরা পাই যা একসময় তরুণ পৃথিবীর অভ্যন্তরে ছিল। 

সূর্যের ভূমিকা কিন্তু এখনি শেষ হয়ে যায়নি! বরং তা মাত্র যেন শুরু হলো। একটা মজার ব্যাপার এখানে বলে রাখা যায়। পৃথিবী এবং সূর্যের বয়স কিন্তু প্রায় একই! সৌরমণ্ডলের মহাজাগতিক ধুলো (নেবুলা) পুঞ্জীভূত হতে হতেই কালক্রমে তাদের জন্ম। তরুণ এবং পরাক্রমশালী সূর্য মহাকাশে প্রতিনিয়ত ছুঁড়ে ফেলছিল প্রবল শক্তিশালী সৌরবিকিরণ! এই বিকিরণ প্রাথমিকভাবে সৃষ্টি হওয়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলে। তবে, তরুণ পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরে জমে থাকা গ্যাস পরবর্তীতে কয়েক হাজার বছর পরে দ্বিতীয় বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি করে। ক্রমাগত অগ্ন্যুৎপাতের ফলে শুধু যে পৃথিবী পৃষ্ঠের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য গুরত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ধাতু বের হয়ে আসতো তা নয়, বরং প্রচুর পরিমাণে পানির বাষ্পও নির্গমিত হতো। এই বাষ্প উদ্বায়ী। তবে যত উপড়ে উঠত, তা ঠান্ডা হতো। সৃষ্টি করতো আজকের মেঘ [7]।

ছবিঃ শিশু পৃথিবীর সাথে সম আকারের এক গ্রহের মহাসংঘর্ষের (Giant Impact Hypothesis) এর কল্পচিত্র। প্রচণ্ড জোরে ভূ-অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে চাঁদ। ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মানাসি ভাগ।

তারপরেও প্রশ্ন রয়ে যায় এই গলিত ধংসযজ্ঞ পূর্ণ এক গোলোক এতো বিপুল পরিমাণে তরল পানি কীভাবে সঞ্চয় করলো? কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা পরিবৃদ্ধি দশাতেই সৌরমণ্ডলের নেব্যুলাতে বিশালাকার পানির মজুদ ছিল। এছাড়াও, সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা [8] দেখিয়েছে যে, পৃথিবী তার সৃষ্টিলগ্নে বেশ কয়েকটি বড়সড় বরফপূর্ণ ধূমকেতুর সাক্ষাৎ পেয়েছিল যাদের প্রত্যেককে পৃথিবীর তার মহাকর্ষ টানে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলো।  

কৌতূহলী পাঠকরা এখানে প্রশ্ন করবেনঃ হুম, তা না হয় বোঝা গেলো, তবে এখনো একটা সমস্যা রয়ে যায়। আমরা এখনো আছি প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে এবং তখনও পৃথিবী ছিল এক চুল্লি (আক্ষরিক অর্থেই, কারণ তখন পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৭০০° সেলসিয়াস)! তাহলে “তরল” পানি কীভাবে সংগৃহীত হলো? উত্তর হলো, পৃষ্ঠে আসলেই কোনো তরল পানি ছিল না। তবে বায়ুমণ্ডলে পানির বাষ্প এতোটাই বেশি ছিল যে সূর্যের আলোও এই পুরু মেঘকে ভেদ করে আসতে পারতো না। সময়ে পরিভ্রমণকারী কোনো এক মুসাফির যদি সেই সময়ে (৪.৪ বিলিয়ন বছর আগে) দূর থেকে পৃথিবীর কাছাকাছি আসতো, সে অবাক হয়ে খেয়াল করতো যে, এক অদ্ভুত ঘন কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত গ্রহ প্রতি মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকানো খেলা দেখাচ্ছে! এই অতুলনীয় দৃশ্যপট স্থায়ী হয় আরও কয়েক মিলিয়ন বছর। ধীরে ধীরে মেঘ ঠান্ডা হয়। জমা হতে থাকে কিছু পানির বিন্দু। তারা ভারী হতে থাকে। একসময় এতোটা ভারী হয়ে যায় যে মেঘ তাদের কোলে ধরে রাখতে পারে না। তারা নিচে নেমে আসে। তরুণ পৃথিবীর বুকে প্রথম প্রকৃত বৃষ্টির ফোঁটা [9]। এই বৃষ্টি ঠিক আজকের বৃষ্টির মতো। এই বৃষ্টিকে নিয়েই লেখা শত শত কবিতা, হাজারো গান, এবং লক্ষ প্রেমিক যুগলের অমূল্য স্মৃতি।  

ছবিঃ প্রথম বৃষ্টি ছিল সহস্র বছর ধরে। কৃতজ্ঞতাঃ স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন।

 তবে পৃথিবীপৃষ্ঠ তখনও সম্পূর্ণরূপে ঠান্ডা হয়ে যায়নি। এবং সেই বৃষ্টির ফোঁটারাও ছিল বেশ উত্তপ্ত। যেই মুহূর্তে তারা মাটিতে পরত, কিছু সময়ের মাঝেই তারা টগবগিয়ে ফুটে আবার বাষ্পীভূত হয়ে যেতো। ফিরে যেতো মেঘের দেশে। যত সময় যাচ্ছিলো, মাটি ততই ঠান্ডা হচ্ছিলো। কারণ ঘন মেঘ সূর্যের আলোকে সরাসরি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে বাঁধা দিত। বৃষ্টির পানিও ঠান্ডা হচ্ছিলো। ধীরে ধীরে তারা জমা হতে থাকে পাথুরে জমির কোনাচে কানাচে [10]। বিপুল পরিমাণ পানি মিশে যায় খনিজ পাথরের কণার সাথে। সেই পানি আবার বাষ্পীভূত হয়। উড়ে যায় আকাশে। পিছে ফেলে যায় খনিজ (মিনারেল)। পানি বৃষ্টি হয়ে আবারো ফিরে আসে। তার স্বাদ বদলে যায়। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে, তবে নিশ্চিতভাবেই সৃষ্টি হয় আজকের সমুদ্র।  

তথ্যসূত্র

লেখাটি 30-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading