অ্যান্ট-ম্যানের ‘মিনিচুরাইজেশন প্রযুক্তি’ কতদূর (পর্ব-২)

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত। এরা আমাদের কাছে পরিচিত ‘পরমাণু’ নামে। মিনিচুরাইজেশন অর্জন করতে এই পরমাণুগুলোকে সম্পূর্ণ বাগে আনা, অর্থাৎ এগুলোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। ফ্যান্টাসিক ভয়েজ বইয়ে আইজ্যাক আসিমভ বস্তুর আকার সংকোচনের তিনটি সম্ভাব্য কৌশলের কথা তুলে ধরেছিলেন—     

আইজ্যাক আসিমভের মতে মিনিচুরাইজেশন অর্জনের তিনটি উপায়

হাইপোথিসিসগুলো যথেষ্ট যৌক্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এদের কোনটাকেই কি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব? চলুন একে একে বিশ্লেষণ করা যাক….     

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, পরমাণুরা অতিশয় ক্ষুদ্র। এদের আকার ন্যানোমিটার স্কেলে। এই ক্ষুদ্র পরিসরেই বিচরণ করে ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রনসহ চেনা-অচেনা হরেক রকম অতিপারমাণবিক কণারা। প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্র, নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত থাকে প্রোটন এবং নিউট্রন। প্রথমটি ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট, আর অন্যটি আধান নিরপেক্ষ। অন্যদিকে, নিউক্লিয়াসের ঠিক বাইরে ঘূর্ণায়মান থাকে ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রনরা। সৌরজগতে গ্রহগুলো যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে, অনেকটা সেই রকম। পরমাণুর আকার নির্ধারিত হয় এই ইলেকট্রনদের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ দ্বারা। স্বাভাবিক অবস্থায় যে কোন মৌলিক পদার্থের পরমাণুতে সর্বদা সমান সংখ্যক ইলেকট্রন ও প্রোটনের অস্তিত্ব থাকে।

আচ্ছা, একটু ভাবুন তো, বিপরীতধর্মী আধান তো সবসময় পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সেই মতে, নিউক্লিয়াসের গহিনে থাকা প্রোটনগুলোর উচিত বাইরে ঘূর্ণায়মান থাকা ইলেকট্রনদের টেনে ভেতরে আসা, তাই না? কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটতে দেখা যায় না। এমনটা হবার কারণ কি? আসলে ইলেকট্রনরা যদি নির্দিষ্ট গতিপথে ঘূর্ণায়মান থাকার পরিবর্তে এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই প্রোটনদের আকর্ষণে এদের শেষ গন্তব্য হতো পরমাণুর কেন্দ্র। পৃথিবী ও চাঁদের গতিপথ বিশ্লেষণ করলেই এই কথার তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যাবে। এই দুই মহাজাগতিক বস্তু একে অন্যকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। চাঁদের তুলনায় অনেক ভারী হওয়ায় অনুমিতভাবেই পৃথিবীর টানের শক্তিমত্তা বহুগুণ বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও উপগ্রহটি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে না। কারণ এটি এমন এক দূরত্ব বজায় রেখে সুনির্দিষ্ট গতিবেগে পথ চলে, যা কিনা মূল গ্রহের মহাকর্ষজনিত টানকে নাকচ করে দিতে পারে। পরমাণুর গহিনে ইলেকট্রনরাও ঠিক একই কৌশলে, অর্থাৎ অনুমোদিত উপবৃত্তাকার কক্ষপথে নির্দিষ্ট বেগে চলমান থেকে প্রোটনদের তীব্র আকর্ষণ ফাঁকি দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে।  

যা-ই হোক, মাত্রই পরমাণুর যে ছবি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হলো, তার উৎস মূলত দুইটি। প্রথমটি নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফর্ডের প্রস্তাবিত পরমাণু মডেল। এটিকে সাজানো হয়েছিল আমাদের অতি পরিচিত সৌরজগতের সাথে মিল রেখে। অন্যদিকে দ্বিতীয় উৎস তথা পরমাণু মডেলের প্রবক্তা ড্যানিশ পদার্থবিদ নীলস বোর। রাদারফোর্ডের মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল এটিকে। তবে এটিও ত্রুটিমুক্ত ছিল না। যেমনঃ এতে পরমাণুর গহিনে ইলেকট্রনদের গতিপথ কল্পনা করে নেয়া হয়েছিল পুরোপুরি বৃত্তাকার। পরবর্তীতে জার্মান পদার্থবিদ আর্নল্ড সমারফিল্ডের হাত ধরে মডেলে যুক্ত হয় উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতা দেখালেও বোর-সমারফিল্ডের যৌথ প্রয়াসও পরমাণুর অদ্ভুতুড়ে জগত ব্যাখ্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আধুনিক যুগে পরমাণুর পূর্ণাঙ্গ চিত্র যে মডেলের বদৌলতে অঙ্কিত হয়েছে, তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল প্রায় এক শতাব্দী আগে, ১৯২৬ সালে। ‘কোয়ান্টাম-মেকানিক্যাল মডেল’ বা ‘ইলেক্ট্রন-ক্লাউড মডেল’ নামে খ্যাত এই তত্ত্বটি মূলত তিনজন অসামান্য প্রতিভাবান পদার্থবিদের সমন্বিত অবদান। তারা হলেন— অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ এরভিন শ্রোডিঙ্গার, জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং ফরাসি পদার্থবিদ লুইস ডি ব্রগলি। পরমাণুর রহস্য ব্যাখ্যায় এটিতে ব্যবহার করা হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে অদ্ভুত শাখা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স।

ইলেক্ট্রন-ক্লাউড মডেল অনুসারে, সুনির্দিষ্ট কোন উপবৃত্তাকার কক্ষপথ নয়, বরং পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনরা নিউক্লিয়াসের চারদিকে মেঘসদৃশ এলাকা জুড়ে গতিশীল থাকে। সেখানে এদের পুঙ্খানুপুঙ্খ অবস্থান আমরা কখনোই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে নির্ধারণ করতে পারবো না। কেবল নির্দিষ্ট দূরত্বে খুঁজে পাওয়ার গানিতিক সম্ভাব্যতা হিসাব করতে পারবো। যে দূরত্বের জন্য কোন ইলেকট্রনকে খুঁজে পাওয়ার মান সর্বোচ্চ, সেটাই বিবেচিত হবে পরমাণুর ‘ব্যাসার্ধ’ হিসেবে। অর্থাৎ পরমাণুর সম্ভাব্য ব্যাসার্ধ নির্ভর করবে বেশ কিছু রাশি, যেমনঃ ইলেকট্রনের ভর, এটির আধান, নিউক্লিয়াসে উপস্থিত ধনাত্মক আধান তথা প্রোটন সংখ্যা এবং ‘প্ল্যাংক ধ্রুবক’ নামে পরিচিত মহাবিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সংখ্যার উপরে। এই ধ্রুবকটি সম্পর্কে সামনের অধ্যায়গুলোতে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। আপাতত এটুকু জেনে রাখাই যথেষ্ট যে, এটির সাংখ্যিক মান ৬.৬৩ × ১০-৩৪ জুল-সেকেন্ড এবং ইলেকট্রনের ভর বা আধানের মত এটিও একটি অপরিবর্তনীয় সংখ্যা। মোট কথা, পরমাণুর ব্যাসার্ধ নির্ধারণকারী এক গাদা রাশির কোনটাই পরিবর্তনযোগ্য নয়!

পরমাণুর ক্ল্যাসিক্যাল মডেল বনাম কোয়ান্টাম-মেকানিক্যাল মডেল

ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ ২: ডেস্টিনেশন ব্রেইন বইতে কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভ মিনিচুরাইজেশন অর্জনের মূল কৌশল হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন মাত্রই বর্নিত প্ল্যাংক ধ্রুবকের মানে তারতম্য আনাকে। এক কথায় বলতে গেলে, সেই আইডিয়াটি ছিল দুর্দান্ত! এটির মান মাত্র ১০ গুণ কমাতে পারলেই পরমাণুর সামগ্রিক আকার নেমে আসবে স্বাভাবিক অবস্থার ০.০১ শতাংশে। অর্থাৎ তখন খুব সহজেই যে কোন বস্তুকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে ‘লিলিপুট’ স্কেলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাস্তব পৃথিবীতে এই ধ্রুবকের মান তিল পরিমাণ নড়চড় কোন মেকানিজমই অদ্যবধি আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি। সামনে যে হবে, তার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আসলে প্ল্যাংকের ধ্রুবক, আলোর গতিবেগ, ইলেকট্রনের আধান ইত্যাদির মতন প্রাকৃতিক সংখ্যাগুলোতে পরিবর্তন আনার সুযোগ থাকলে গোটা মহাবিশ্বটাই হতো অন্যরকম। তাই মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পরমাণুর ব্যাসার্ধ ছোট করে মিনিচুরাইজেশন অর্জনের চেষ্টাকে বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা ভিন্ন অন্য কোন উপায় নেই।

এবারে আসা যাক দ্বিতীয় সম্ভাব্য উপায়— বস্তু থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরমাণু সরিয়ে ফেলা প্রসঙ্গে। প্রিয় পাঠক, শুরুতেই একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি কখনও একদম প্রথম দিকে তৈরি করা কম্পিউটারগুলো সামনাসামনি বা ছবিতে দেখেছেন? যদি দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই জানা আছে যে এদের সাথে বর্তমানের আধুনিক সংস্করণগুলোর পার্থক্য আক্ষরিক অর্থেই যেন আকাশ-পাতাল। যেই পার্থক্যটি সবচেয়ে প্রকট হিসেবে সকলের চোখে ধরা দেয়, তা হলো আকার। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে একদিকে যেমন যন্ত্রগুলোর শক্তিমত্তা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে, তেমনি অন্যদিকে এদের আকার ক্রমশ কমেছে। অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বেলায় একই বস্তুকে আগের চেয়ে কম উপকরণ (পরমাণু) ব্যবহারে তৈরি করা সম্ভব। এতে কিন্তু বস্তুটির কর্ম পরিধি মোটেই কমে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়। এই নিয়মটি অবশ্য জটিল জৈবিক বস্তুদের বেলায় একদমই খাটে না। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অংশ তথা পরমাণু অপসারনে এই ধরণের বস্তুতে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। এক ধাক্কায় ৬ ফুটের কোন মানুষকে ৬ ইঞ্চিতে রূপান্তর করার অর্থ হলো, উচ্চতা প্রায় ১২ গুণ কমানো। ত্রি-মাত্রিক জীব বলে এই সময়ে একই মাত্রায় সংকুচিত হবে মানুষের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থও। ফলে মিনিচুরাইজেশন অর্জনের পথে শরীরের প্রতি ১৭২৯টি পরমাণুর মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে ১৭২৮টিকেই! পুরো কাজটি দেহের সর্বত্র সুষমভাবে সম্পাদন করা হলেও ফলাফলস্বরূপ সকল সজীব কোষের কার্যক্রমই নিশ্চিত আংশিক বা সম্পূর্ণ থমকে যাবে।

সহজে বোঝার জন্য মানব মস্তিস্কে থাকা নিউরনগুলোর কথাই ভাবুন। এদের গতানুগতিক প্রশস্ততার মান ১ সে.মি. এর হাজার ভাগের প্রায় ১ ভাগের সমান। প্রাণিভেদে এই কোষগুলোর আকার আকৃতি মোটামুটি একই রকম থাকে। প্রকৃতিতে প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি নিউরনের আকার নয়, বরং নির্ভর করে মস্তিস্কে এদের মোট সংখ্যা এবং এদের মধ্যকার আন্তঃসংযোগের উপরে। দেহের সিংহভাগ পরমাণু অপসারণ করে মিনিচুরাইজেশন অর্জনের চেষ্টা করলে অন্য অনেক কিছুর সাথে অবধারিতভাবে বহুগুণে কমে আসবে মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যাও। ফলাফল কি হবে তা অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়ই? অর্থাৎ আইজ্যাক আসিমভের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পদ্ধতিটিও বাস্তবে অকার্যকর।  

এবারে তৃতীয় ও সর্বশেষ কৌশল— বল প্রয়োগের মাধ্যমে পরমাণুদের খুব কাছে আসা। এই প্রক্রিয়ায় মূলত চেষ্টা করা হবে বস্তুর ঘনত্ব বৃদ্ধি করার। এমনটা করা কিন্তু মোটেও অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। আমরা জানি, পদার্থ মোটা দাগে তিনটি আলাদা ভৌত অবস্থায় থাকতে পারে। কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়। কঠিন অবস্থায় বস্তুতে পরমাণুগুলো খুব কাছাকাছি থাকে। তাপ প্রয়োগ করলে এদের গতিশক্তি বেড়ে যায়। তখন এরা ক্রমশ পরস্পর থেকে দূরে সরতে শুরু করে। পর্যাপ্ত পরিমাণ দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে, অর্থাৎ ঘনত্ব কমলে কঠিন বস্তু রূপান্তরিত হয় তরল অবস্থায়। যদি তাপশক্তি প্রয়োগ অব্যাহত থাকে, তাহলে পরমাণুদের মধ্যবর্তী দূরত্ব পাল্লা দিয়ে বেড়ে এক সময়ে তরল বস্তু পরিণত হবে গ্যাসে। বিপরীতক্রমে আমরা যদি তাপ অপসারণ করি, তাহলে গ্যাসীয় বস্তুর পরমাণুরা দূরত্ব কমিয়ে তথা ঘনত্ব বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে ফেরত আসবে তরল ও কঠিন অবস্থায়। মিনিচুরাইজেশন অর্জন করতে হলে এহেন স্বাভাবিক তারতম্যের গন্ডি পেরিয়ে আমাদের ঘনত্ব পরিবর্তন করতে হবে অকল্পনীয় মাত্রায়।  

প্রকৃতির নিয়মেই সিংহভাগ কঠিন বস্তুতে পরমাণুরা খুব সুসজ্জিত অবস্থায় থাকে। এরপরেও এদের সজ্জার মধ্যে বেশ খানিকটা ফাঁকা স্থানের অস্তিত্ব থেকেই যায়। কানায় কানায় পূর্ণ এক বাক্স মার্বেলের কথা ভাবুন। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভেতরে নতুন কোন সদস্য প্রবেশ করানোর অবকাশ না থাকলেও পাশাপাশি সংস্পর্শে থাকা মার্বেলগুলোর মাঝে ঠিকই কিছু ফাঁকা রয়েছে। কঠিন পদার্থে পরমাণুগুলোও অনেকটা একই রকমভাবে সজ্জিত থাকে। সমস্যা হলো, বাহ্যিক বল প্রয়োগ বা অন্য কোন কৌশলে পরমাণুদের কাছে এনে এই ফাঁকা স্থানগুলো পূরণ তথা ঘনত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে মিনিচুরাইজেশন অর্জন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ এই সময়ে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থানরত ইলেকট্রনরা। খুব কাছে আসতে গেলেই আলাদা আলাদা পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনরা পরস্পরকে প্রচণ্ড শক্তিতে বিকর্ষণ করতে শুরু করবে। যতই কাছে আনার চেষ্টা করা হবে ততই পাল্লা দিয়ে বাড়বে এই বল। একে অতিক্রম করে পরমাণুদের কাছে আনতে গেলে যে শক্তির দরকার পড়বে, তা এক কথায় অকল্পনীয়। অর্থাৎ আইজ্যাক আসিমভের প্রস্তাবিত তৃতীয় পদ্ধতিটিকে আকাশ কুসুম কল্পনা আখ্যা দিলে বিন্দু মাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না।                 

অধিকাংশ কঠিন পদার্থে (প্রায় ৯০ শতাংশ) বামে দেখানো সজ্জার মতন করে পরমাণুরা সুসজ্জিত থাকে; অবশিষ্টগুলোতে ডানে দেখানো ছবির মতন খানিকটা অনিয়মিত সজ্জা পরিলক্ষিত হয়। তবে এগুলো বাড়তি থাকা ফাঁক-ফোকরও মিনিচুরাইজেশন অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়;

এতোক্ষণের আলোচনা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। বাস্তবে মিনিচুরাইজেশন অর্জন করা থেকে এখনও আমরা যোজন যোজন দূরে। আচ্ছা, প্রযুক্তিটির নাগাল পাওয়া যদি এতোটাই কঠিন হয়ে থাকে, তাহলে অ্যান্ট-ম্যান কমিক বইয়ের পাতায় এটির আবির্ভাব কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন লেখকরা? দ্য ম্যান ইন দ্য অ্যান্ট হিল বইতে দেখা যায়, বহু সাধনার পরে বায়োকেমিস্ট ডক্টর হেনরি পিম দুটি পোশন বা সিরাম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। একটি নিমিষেই মানুষকে ‘লিলিপুটে’ পরিণত করতে পারে, আর অন্যটি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে স্বরূপে। পরবর্তীতে কমিক বইয়ের লেখকরা তরল পোশনকে স্থলাভিষিক্ত করেন সহজে গিলে ফেলা যায় এমন এক ধরণের ট্যাবলেট দিয়ে। এখানেই শেষ নয়। জৈবিক দেহের পাশাপাশি অ্যান্ট-ম্যানের সাথে থাকা হরেক রকম জড়বস্তু, যেমনঃ হেলমেট, পোশাক ইত্যাদি কিভাবে তাল মিলিয়ে সংকুচিত হয়ে যায়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অচিরেই কাহিনীতে আরেক দফা পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন তারা। এবারে সামনে আনা হয় এক রহস্যময় কণার কথা। এটির নাম দেয়া হয় ‘পিম পার্টিক্যাল’। জীব-জড় নির্বিশেষে এটি সকল বস্তুর আকার পরিবর্তনে সক্ষম। রহস্যময় পিম পার্টিক্যাল, পোশন বা ট্যাবলেট— এরা কীভাবে কাজ করে সে ব্যাখ্যা কখনোই দেয়ার চেষ্টা করেন নি অ্যান্ট-ম্যান চরিত্রের স্রষ্টারা। এদেরকে ‘অতিমানবীয় ক্ষমতা’-এর কাতারে রেখে সব সময় নিজেদের মুখ রক্ষা গিয়েছে তারা। এজন্য অবশ্য তাদের খুব একটা দোষ দেয়া চলে না। অন্তত এখন পর্যন্ত মানবজাতির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সে কথাই বলে!

টীকা

১.হাইড্রোজেন ব্যতীত। এগুলোতে শুধুমাত্র একটি প্রোটনের অস্তিত্ব থাকে।

২. উল্টোটা, অর্থাৎ প্রোটনদের ইলেক্ট্রনের দিকে ছুটে যাওয়া এক রকম অসম্ভব। এটির অন্যতম কারণ হলো, এরা তুলনামূলক ভারী এবং নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে অমিত শক্তিশালী সবল নিউক্লিয়ার বল দ্বারা খুব কাছাকাছি দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে।

৩. আমাদের সমাজে অতি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো, মানুষ নাকি নিজের মস্তিষ্কের সক্ষমতার মাত্র ১০% ব্যবহার করে। কল্পকাহিনী ভিত্তিক সিনেমা থেকে উৎসারিত এহেন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতি কখনোই এতো বিশাল মাত্রায় অপচয় বরদাস্ত করে না। যদি কম নিউরনেই মস্তিষ্কের সব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে যেত, তাহলে লক্ষ লক্ষ বছরের পরিক্রমায় বহু আগেই অলস বসে থাকা নিউরনগুলো নিশ্চিত বিলুপ্ত হয়ে যেত।

৪. মানিব মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যা আনুমানিক ৮৬ বিলিয়ন। অন্যদিকে পিঁপড়ার মস্তিস্কে এদের উপস্থিতি মাত্র আড়াই লাখের কাছাকছি। পার্থক্যটা অনুধাবন করতে পারছেন নিশ্চয়ই।

একটা মজার তথ্য দেই। হাতির মস্তিস্কে নিউরনের মোট সংখ্যা ২৫৭ বিলিয়ন। অর্থাৎ মানুষের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি! বিজ্ঞানীদের ধারণা, বুদ্ধিমত্তার জন্য অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালনকারী বিশেষ ধরণের কর্টিক্যাল নিউরনের সংখ্যা অনেক কম থাকায় এই অতিকায় প্রাণিগুলো মানুষের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে।        

৫. জটিলতা পরিহার করার জন্য পদার্থের চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থা— প্লাজমা এবং বোস-আইন্সটাইন কনডেনসেট নিয়ে আপাতত মাথা না ঘামালেও চলবে।

তথ্যসূত্র-

দ্য ফিজিক্স অফ সুপারহিরোস, জেমস কাকালিওস

    

লেখাটি 16-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading