খাবারে কী আছে,তা নিয়ে আমরা প্রায়ই চিন্তা করি। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকলেও,অনেক সময় আমরা জানিই না যে খাবারের সঙ্গে ক্ষতিকর উপাদানও শরীরে প্রবেশ করছে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, কৃত্রিম, রাসায়নিক, অতিরিক্ত চিনি ও লবণযুক্ত খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে আপনার প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে অদৃশ্য প্লাস্টিকও প্রবেশ করছে? শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আমাদের গ্রহণ করা খাদ্যের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছেন। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো দেখিয়েছে যে, এটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। তাহলে, এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলো কোথা থেকে আসে এবং আমাদের শরীরের ওপর কী প্রভাব ফেলে তা পর্যালোচনা করে দেখি।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কী?

মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো ৫ মিলিমিটারের কম আকারের ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা,যা বিভিন্ন প্লাস্টিক সামগ্রী ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়। এটি মূলত দুই ধরনের হয়। প্রথমত, প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা প্রসাধনী সামগ্রী (স্ক্রাবার ও টুথপেস্ট), শিল্পজাত প্লাস্টিক পণ্য ও প্লাস্টিক প্যালেট থেকে তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, সেকেন্ডারী মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, কাপড় ইত্যাদি ক্ষয় হয়ে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয় এবং পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্র, নদী, মাটি ও বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে, যা পরবর্তীতে আমাদের খাবারে প্রবেশ করছে।
খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে আসে?
মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের খাবারে বিভিন্ন উপায়ে প্রবেশ করতে পারে। সমুদ্রের পানি ও জীববৈচিত্র্যের উপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, ঝিনুক ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া প্লাস্টিক কণা গ্রহণ করে। ফলে, আমরা যখন এই খাবার গ্রহণ করি, তখন মাইক্রোপ্লাস্টিকও আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। শুধু সামুদ্রিক খাবারই নয়, আমাদের পানীয় জলের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে বোতলজাত ও কলের পানিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এটি সরাসরি আমাদের পানীয়তে প্রবেশ করছে।

প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবারেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। প্লাস্টিক মোড়কের খাবার দীর্ঘ সময় থাকলে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা এতে মিশে যেতে পারে। বিশেষ করে, প্লাস্টিকের মোড়কে থাকা চিপস, নুডলস, চকোলেট ও দইয়ের মতো খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া, গবেষণায় দেখা গেছে যে সামুদ্রিক লবণের প্রায় ৯০% নমুনায় প্লাস্টিক কণা রয়েছে, যা লবণের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। শুধু খাবার ও পানীয় নয়, শাকসবজি ও ফলের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। উদ্ভিদের শিকড় মাটিতে থাকা প্লাস্টিক কণাকে শোষণ করতে পারে, যা পরবর্তীতে আমাদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমনকি বাতাসের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবারে জমতে পারে, যা রান্না বা সংরক্ষণ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে।
এসব কারণে, প্রতিদিন অজান্তেই আমরা বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছি, যা আমাদের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব
মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করলে এটি বিভিন্নভাবে ক্ষতি করতে পারে। খাদ্য থেকে আগত প্লাস্টিক কণা অন্ত্রে জমে গেলে তা হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং পেটের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়াও প্লাস্টিক কণার সাথে অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক যুক্ত থাকে, যা ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করলে অন্ত্রে প্রদাহ তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেহের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। প্লাস্টিক কণাগুলোতে বিপিএ (BPA) ও থ্যালেটস (Phthalates) থাকে, যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিসফেনল এ বা বিপিএ হলো এক ধরনের রাসায়নিক, যা সাধারণত প্লাস্টিক ও রেজিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি খাদ্য ও পানীয়ের প্লাস্টিক বোতল, ক্যানের আবরণ এবং অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্যগুলোর মধ্যে থাকতে পারে। বিপিএ শরীরে প্রবেশ করলে এটি হরমোন ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, বিশেষ করে এস্ট্রোজেনের কার্যকারিতার সঙ্গে হস্তক্ষেপ করে, যা প্রজনন সমস্যা হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। থ্যালেটস হলো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যা প্লাস্টিককে নমনীয় ও টেকসই করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি এন্ডোক্রাইন সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটায়, যা প্রজনন সমস্যা, হরমোনজনিত অসুস্থতা ও শিশুদের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, থ্যালেটস শরীরে প্রবেশ করলে এটি ক্যান্সার, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্যাপী মাইক্রোপ্লাস্টিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করছেন। ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানব রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করেছেন, যা প্রমাণ করে যে এই কণা আমাদের দেহে শোষিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয় যে বোতলজাত পানিতে প্রতি লিটারে গড়ে ৩২৫টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা থাকতে পারে। ২০২০ সালে ইতালির গবেষকরা গর্ভবতী মায়েদের অমরায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০১৬ এবং ২০২৪ সালের মৃত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের নমুনা পরীক্ষা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। গড়ে, মস্তিষ্কের নমুনায় প্রায় ৭ গ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা একটি প্লাস্টিকের চামচের সমান। এছাড়া, ডিমেনশিয়া রোগীদের মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় ৫ গুণ বেশি পাওয়া গেছে।

কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচা সম্ভব?
আমরা চাইলে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের খাদ্য থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক কমাতে পারি। যেমনঃ বোতলজাত পানির পরিবর্তে কলের পানি ফিল্টার করে পান করা। প্লাস্টিকের প্যাকেজিং এড়িয়ে কাঁচ বা স্টিলের পাত্র ব্যবহার করা। ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কম খাওয়া। প্রাকৃতিক ও অর্গানিক খাবার বেশি গ্রহণ করা। প্লাস্টিক বর্জ্য কমিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার করা।
আশা করি উপর্যুক্ত আলোচনায় বোঝা গেলো, কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার একটি বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। এটি ধীরে ধীরে আমাদের দেহে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করছে। যদিও গবেষণা এখনো চলছে, তবুও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের সচেতনতা এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাসই পারে আমাদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে।
তথ্যসূত্র-
- The Impact of Medication Cost on Dialysis Patients – PubMed
- WHO calls for more research into microplastics and a crackdown on plastic pollution
- The Impact of Medication Cost on Dialysis Patients – PubMed
- Microplastics and Nanoplastics in Foods | FDA
- Researchers found a spoon’s worth of nanoplastics in human brains — the latest evidence that plastic is accumulating in our bodies
Leave a Reply