গত সপ্তাহে, আনুষ্ঠানিক ভাবে শনির ১২৮টি নতুন প্রাকৃতিক উপগ্রহ বা চাঁদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংঘ (IAU) নতুন এই ১২৮টি চাঁদকে স্বীকৃতি দিয়েছে তাইওয়ানের একাডেমিয়া সিনিকা-তে এডওয়ার্ড অ্যাশটনের নেতৃত্বে একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে। সূর্যের এই ষষ্ঠ গ্রহটি এখন মোট ২৭৪টি উপগ্রহের গর্বিত মালিক, যা সৌরজগতের অন্য যে কোনো গ্রহের তুলনায় বেশি।
কিন্তু এই আবিষ্কার অনেকগুলো প্রশ্ন তুলেছে। যেমন: উপগ্রহ চিহ্নিত করা হয় কীভাবে, এতদিন কেউ এগুলো দেখতে পেল না কেন? বৃহস্পতি না সবচেয়ে বেশি উপগ্রহের অধিকারী ছিলো? এই নতুন উপগ্রহগুলোর নাম কী রাখা হবে? আরও উপগ্রহ কি থাকতে পারে? এবং প্রকৃতপক্ষে, কোনো কিছুকে “উপগ্রহ” বলা হয় কেন বা কখন?

নতুন এই আবিষ্কারের কারণে সৌরজগতের উপগ্রহ প্রতিযোগিতায় শনি এখন শীর্ষস্থানে রয়েছে, কারণ তার নিশ্চিত উপগ্রহের সংখ্যা অন্যান্য সমস্ত গ্রহের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। তবে ইতিহাস জুড়ে সবসময় এমনটা ছিল না।
বৃহস্পতির চারটি বৃহত্তম উপগ্রহ— আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড এবং ক্যালিস্টো ছিল পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহকে প্রদক্ষিণরত প্রথম আবিষ্কৃত উপগ্রহ। এগুলো ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলেই প্রথম আবিষ্কার করেন। এর ৪৫ বছর পর, ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স শনির প্রথম পরিচিত উপগ্রহ, টাইটান আবিষ্কার করেন।

শনির এই ১২৮টি নতুন উপগ্রহ কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপের মাধ্যমে তোলা একাধিক ছবি একত্র করে শনাক্ত করা হয়েছে। শনির কিছু উপগ্রহ মহাকাশযানের অভিযানের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে, আবার কিছু “রিং-প্লেন ক্রসিং” নামক বিশেষ ঘটনার সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। যখন ভয়েজার ১ মহাকাশযান শনির পাশ দিয়ে উড়ে গিয়েছিল, তখন এটি এমন ছবি তোলে, যা থেকে নতুন উপগ্রহ অ্যাটলাস আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তী সময়ে, ক্যাসিনি মিশন শনির সাতটি নতুন উপগ্রহের সন্ধান দেয়।
রিং-প্লেন ক্রসিং হলো এমন একটি ঘটনা, যখন শনির রিং বা বলয় আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটি তখনই ঘটে, যখন শনি এমন কোণে অবস্থান করে যে আমরা ঠিক পাশ থেকে রিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, ফলে রিংগুলো একটি সরলরেখার মতো দেখায় আর মনে হয় যে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

টাইটান আবিষ্কৃত হয়েছিল এই রিং-প্লেন ক্রসিংয়ের সময়। এছাড় আরও ১২টি উপগ্রহ শনাক্ত হয়েছিল এই অবস্থায়। ২০২৫ সালে মার্চ ও নভেম্বর মাসে শনির রিং আবার এমনভাবে অবস্থান করবে, যা নতুন উপগ্রহ আবিষ্কারের সুযোগ এনে দিলেও দিতে পারে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বৃহস্পতি ও শনির মধ্যে একটা বেশ বড়সড় প্রতিযোগিতা চলে। প্রতিযোগিতাটি ছিলে “কার বেশি উপগ্রহ আছে” দৌড়ে প্রথম স্থান দখলের জন্য।
২০১৯ সালে শনির ২০টি নতুন উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়। ফলে তৎকালীন সময়ে শনি বৃহস্পতিকে ছাড়িয়ে প্রথম স্থান দখন করে নেয়। এতে শনির মোট চাঁদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ৮২, আর বৃহস্পতির ৭৯।
আবার ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বৃহস্পতির ১২টি নতুন উপগ্রহের সন্ধান পাওয়া যায়। যা আবার তার শীর্ষস্থান এনে দেয়, তখন শনির উপগ্রহের সংখ্যা ছিল ৮৩। এর কিছুদিন পর, ২০২৩ সালেই, একই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শনির চারপাশে ৬২টি নতুন উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। ফলে শনি আবারও নেতৃত্বে চলে আসে।
সৌরজগতে পৃথিবীর একটি, মঙ্গলের দুটি, বৃহস্পতির ৯৫টি, ইউরেনাসের ২৮টি এবং নেপচুনের ১৬টি উপগ্রহ আছে, যা যোগ করলে মোট ১৪২টি উপগ্রহ হয়। তো শনির চারপাশে যদি আরও ১০টি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়, তবে এর উপগ্রহের সংখ্যা এককভাবে অন্য সব গ্রহের মোট উপগ্রহের সংখ্যার দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
নতুন আবিষ্কৃত উপগ্রহগুলো সবই ছোট। প্রতিটি গড়ে মাত্র কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত। এত ছোট কিছু যদি উপগ্রহ হতে পারে, তাহলে আসলে কাকে উপগ্রহ বলা যায়?
নাসার সংজ্ঞা হচ্ছে, “প্রাকৃতিকভাবে গঠিত বস্তু যা গ্রহের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে, তাকে প্রাকৃতিক উপগ্রহ বা চাঁদ বলা হয়।” সে হিসেবে তো গ্রহাণুরও চাঁদ থাকতে পারে। আমরা তো ২০২২ সালে ডার্ট (DART) মিশনে একটি মহাকাশযান নিয়ে গ্রহাণুর চাঁদের ওপর আঘাত করেছিলাম। আবার পৃথিবীরও কিছু ক্ষণস্থায়ী চাঁদ (মিনি-মুন) ছিল, যেগুলোর কিছু মাত্র কয়েক মিটার আকারের, ওগুলোও তো উপগ্রহ হতে পারে সংজ্ঞা অনুযায়ী। তো কোনটা উপগ্রহ আর কোনটা উপগ্রহ নয়, তা নির্ধারণের সীমারেখা কিছুটা অস্পষ্ট।
সৌরজগতের গ্রহগুলোর চারপাশে প্রদক্ষিণকারী চাঁদ দুটি ভাগে বিভক্ত— “রেগুলার বা নিয়মিত” এবং “ইরেগুলার বা অনিয়মিত”। নতুন আবিষ্কৃত উপগ্রহগুলো সবই ইরেগুলার।

রেগুলার উপগ্রহ গঠিত হয় গ্রহ সৃষ্টির একই সময়ে। অন্যদিকে ইরেগুলার উপগ্রহগুলোকে সাধারণত ছোট গ্রহ (প্ল্যানেটেসিমাল) হিসেবে ধরা হয়, যেগুলো কোনো গ্রহ তার গঠনের শেষ পর্যায়ে এসে আকর্ষণ করে নেয়। পরে সংঘর্ষের মাধ্যমে এগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
রেগুলার উপগ্রহ সাধারণত তাদের গ্রহের চারপাশে সুন্দর, বৃত্তাকার কক্ষপথে এবং বিষুবরেখার (ইকুয়েটর) কাছাকাছি অবস্থান করে। অন্যদিকে, ইরেগুলার উপগ্রহগুলো সাধারণত অনেক দূরে বড় উপবৃত্তাকার কক্ষপথে বিভিন্ন কোণে প্রদক্ষিণ করে। শনির ২৪টি রেগুলার উপগ্রহ এবং ২৫০টি ইরেগুলার উপগ্রহ রয়েছে।
এই উপগ্রহ নিয়ে গবেষণা করলে আমরা জানতে পারব কীভাবে উপগ্রহ গঠিত হয়। এছাড়াও সৌরজগত কীভাবে সৃষ্টি ও বিকশিত হয়েছে, সে সম্পর্কে সূত্র পাওয়া যাবে।
শনির বলয় ছোট ছোট বরফ ও পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বলয় ধ্বংসপ্রাপ্ত ধূমকেতু, গ্রহাণু ও উপগ্রহের টুকরো থেকে গঠিত হয়েছে, যা শনির মহাকর্ষ শক্তির কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাই শনির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে, ইরেগুলার উপগ্রহগুলো আমাদের এর সুন্দর বলয়ের গঠনের বিষয়ে আরও তথ্য দিতে পারে।
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুগুলোর নামকরণ নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (IAU)। প্রাথমিকভাবে, সৌরজগতের সব উপগ্রহের নাম গ্রিক-রোমান পুরাণ থেকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উপগ্রহের সংখ্যা, বিশেষ করে শনির ও বৃহস্পতির উপগ্রহের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, IAU অন্যান্য পুরাণের দৈত্য ও দেবতাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করছে।
প্রথমে শনির সাতটি উপগ্রহকে নামের পরিবর্তে সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৪৭ সালে, জন হার্শেল উপগ্রহগুলোকে গ্রিক টাইটানদের নামে নামকরণ করেন। এরপর উপগ্রহের সংখ্যা বাড়ায় যখন পুরাণের দেবাতার নাম শেষ হয়ে যায়। তখন নামকরণ ব্যবস্থায় ইনুইট, গ্যালিক দেবতা ও নর্স দেবতকদের এনে তাঁদের নামে নামকরণ করা শুরু হয়।
আবিষ্কারকরা চাঁদের জন্য নাম প্রস্তাব করতে পারেন, এবং IAU সাধারণত তাদের প্রস্তাবিত নামকেই অগ্রাধিকার দেয়। এছাড়াও অতীতে বৃহস্পতি ও শনির নতুন উপগ্রহগুলোর নামকরণের জন্য প্রতিযোগিতাও হয়েছে।
শনির একসাথে ১২৮টি নতুন চাঁদ আবিষ্কার হওয়ার, IAU-এর নিয়ম অনুসারে তাদের নামকরণ করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। হতে পারে, আমরা নতুন কোনো পুরাণের অন্তর্ভুক্তিও দেখতে পাব। তবে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে, প্রতিটি চাঁদের একটি সংখ্যার ও অক্ষরের সমন্বয়ে তৈরি নাম রয়েছে, যেমন “S/2020 S 27” এর মতো।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি আরও চাঁদ খুঁজে পাব? আর পেলে সেটার শেষ কোথায়? – একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ কী, তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায়, আমরা কবে বা আদৌ সব উপগ্রহ খুঁজে পাব কিনা, তা বলা কঠিন। যদিও সবাই একমত যে শনির বলয়ের প্রতিটি ছোট পাথরের টুকরোকে চাঁদ বলা উচিত নয়, কিন্তু সেই সীমারেখা কোথায় টানতে হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্ভবত আর সীমিত সংখ্যক উপগ্রহকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী হবেন। নতুন উপগ্রহ আবিষ্কারের নেতৃত্বে থাকা এডওয়ার্ড অ্যাশটন মনে করেন, প্রযুক্তির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত খুব বেশি নতুন উপগ্রহ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আর নেই।
তথ্যসুত্র:
- Saturn has a whopping 274 moons ― scientists want to know why
- Recent MPECs
- 410 Years Ago: Galileo Discovers Jupiter’s Moons – NASA
- Titan: Exploration – NASA Science
- What the Cassini-Huygens mission discovered at Saturn
- Hubble Views Saturn Ring-Plane Crossing | HubbleSite
- Jupiter now has 92 moons, surpassing Saturn for record
- Moons.
- Double Asteroid Redirection Test (DART) – NASA Science
- Earth is getting a tiny new mini-moon. It won’t be the first (or the last)
- Retrograde predominance of small saturnian moons reiterates a recent retrograde collisional disruption
- Capture of Irregular Satellites during Planetary Encounters – ADS
- Saturn: Facts – NASA Science.
- A brief astronomical history of Saturn’s amazing rings
- Naming of Astronomical Objects | IAU
- The controversial origins of naming moons | Physics Today | AIP Publishing
- Titan | Names & Myth | Britannica
- Astronomers discover 128 new moons orbiting Saturn
Leave a Reply