সূর্য ঢলে পড়েছে। একটু পরেই ডুবে যাবে। বাও আঙুল তুলে গোনা শুরু করলো। সে বাবার কাছে শিখেছে সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ অন্ধকার নামার আগ অবধি সময় কীভাবে গুনতে হয়। চারদিকে শুনশান নীরবতা। শুধু সমুদ্র থেকে সৈকতে সশব্দে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ। বাও গোনার ফাঁকে উত্তর আকাশে তাকায়। ধ্রুবতারা মিটমিট করছে। সেই ধ্রুবতারায় চোখ বুলিয়ে এক ঝাঁক পাখি তাদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার এই সময়ে সাধারণত প্রতিবেশীদের কোলাহল থাকে। আজ কেউ নেই। সত্যি বলতে বাওদের গ্রামে তারাই শেষ পরিবার। বাকি সবাই সাহুল এর পথে রওয়ানা দিয়েছে কয়েকদিন আগেই। বাও এবং তার পরিবার থাকে সুন্দা অঞ্চলে। খাদ্যের খুব সংকট চলছে এখন। কিছু দিন আগে জঙ্গলে আগুন লেগে তাদের জমানো খাবারের গুদাম নিঃশেষ। অনেক বাড়িও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এরই মধ্যে পাশের গ্রাম থেকে শক্তিশালী একদল যুবক এসে তাদের পাকড়াও করে। মাছ, শুকনো মাংস, এবং ফলের ঝোলা যতখানি পেরেছে নিয়ে গেছে। সেই সাথে নির্দয়ভাবে কিছু মানুষকে মেরে ফেলে গেছে।
অন্য গ্রাম থেকে আসা যুবকদের লুটপাট এই প্রথম নয়। খুব ছোট বয়স থেকেই বাও প্রতিনিয়ত ক্ষণে ক্ষণে আসা রোগ ব্যাধি, এবং বখাটেদের হামলা দেখে অভ্যস্ত। সে খুব চায় যোদ্ধা হতে। তার গ্রামের মানুষদের রক্ষা করতে। তাদের গ্রামের সর্দার হতে। কিন্তু বাও এখন অনেক ছোট। তার বয়স মাত্র ছয় বছর। সে এখন কিছু করতে পারবেনা। তার মা তাকে নিয়ে ভয় পায়। বাও এর মনে পড়ে, যখনই বাইরের গ্রাম থেকে হামলা আসতো, তখন তার মা বাবা তাকে ঘরের পিছনে মাটির নিচে এক গর্তে লুকিয়ে রাখতো।
বাও এর বাবা একজন সাহসী যুবক। তার নাম সিদাদ। বাও তার বাবার মতো হতে চায়। এই গ্রীষ্মে অনেক কান্নাকাটি করে শরীরে উলকি আঁকিয়ে নিয়েছে সে। গেরুয়া নকশা। দেখে মনে হবে সারা গায়ে জায়গায় জায়গায় চুন মাখা। মা’কে অনুরোধ করে মাথায় বাঁধার ফিতা নিয়েছে। বাও শিখেছে কীভাবে শরীরের কোথাও কেটে গেলে বড়ো লাল পিঁপড়ার দাঁত বসিয়ে সেলাই এর কাজ করে নিতে হয়। বাবার কাছে শিখেছে পাঁচ রকমের ভিন্ন ভিন্ন গিঁট বাঁধার কৌশল। খুব দ্রুত গাছে উঠতে পারে সে। বিষাক্ত মাশরুম চিনতে পারে। সুন্দার ঘুঘু এবং ফর্কটেইল পাখির ডাক নকল করতে পারে। বাও মাকে আশ্বাস দিয়ে বলে, সে যেন ভয় না পায়। তার ছ’বছরের সন্তান তাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে।
এই গ্রামবাসীর সাহুল এ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই সেখানে লোকজন পরিবার সমেত স্থানান্তরিত হয়েছে। পথেই বেশ কয়েক দলের মারা যাওয়ার ঘটনা শোনা গেছে। এক দুই জন ফিরে এসেছে, বেশিরভাগই ফিরে আসেনি। যারা ফিরে এসেছে তারা এক অদ্ভুত প্রাণীর গল্প বলে। বাও চোখ বড় বড় করে তাদের গল্প শোনে। দুই পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা এক বিশাল প্রাণী। ডিম দেয়না, তবে বাচ্চাকে নিজের পেটের ঝোলায় রেখে বড় করে। শোনা যায়, মানুষের উপস্থিতিতে এই প্রাণীটি খুবই কৌতূহলী হয়েছে। মানুষ দূর থেকে তাদের দেখে, তারাও দূর থেকে মানুষকে দেখে। কেউ কারোর কাছে যায়না।
সুন্দাতে বড় হওয়া বাও এর খুব শখ সেও সাহুল এ যাবে। সেখানে নাকি একেকটি বাঁদুরের সাইজ জলহস্তীর মতো। আবার ইঁদুরের মতো একটি প্রাণীর সাইজ বড় ঘোড়ার মতো! পেখম বিছানো স্বর্গরাজ্যের দূত এর মতো এক অদ্ভুত পাখি যেমন আছে, তেমনি জাগুয়ারকে দৌড়ে হারিয়ে দেয়ার মতো দুই পায়ে চলা পাখিও আছে। বাও চিন্তা করে, কেন তার জঙ্গলে এই প্রাণীগুলো নেই। তার গ্রামেও তো ঘন জঙ্গল আর বিশাল গাছ আছে। প্রতিদিন জোয়ার ভাটা হয়। ঘন ঘন বৃষ্টি হয়। প্রকৃতিমাতা কেন সুন্দাকে এমন কোনো জিনিস দেয়নি যা সাহুলকে দুই হাত ভরে দিয়েছে?
সিদাদ অনেকক্ষণ ধরেই বাওকে চিন্তা করতে দেখছে। সে জানে তার সন্তান ভাবুক প্রকৃতির। তাই সে খুব একটা দুশ্চিন্তা করেনা। তার দুশ্চিন্তার সময় নেই আসলে। সারাদিন ধরে অনেকগুলো বাঁশ সংগ্রহ করেছে সিদাদ। সেগুলো কেটে আকার দিয়েছে। শুকনো গাছের লতি দিয়ে দড়ি পাকিয়েছে। আজ রাতের মাঝেই তাকে ভেলা বানাতে হবে। এক দিনের মাঝেই ভেলা বানানোর কাজ শেষ করা সিদাদ তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে। কিছু খড় জোগাড় করতে হবে। শুকনো খড় যা ছিল সেসব ক’দিন আগে আগুনে পুড়ে গেছে। খড় না থাকলে শুকনো বাকল বা নলখাগড়া লাগবে। ওদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। একটু পরেই প্রচণ্ড ঠান্ডা শুরু হবে। ভেলা হয়ত আজকে বানানো সম্পূর্ণ হবেনা। সিদাদকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে।
সিদাদ একজন দক্ষ মাঝি। সে সবসময় তার প্রিয় দুই বন্ধুর সঙ্গে মাছ ধরতে বের হতো। এই তিনজন একসাথে ভেলায় পাড়ি দিলে গ্রামের লোকজন আশ্বস্ত হত। তারা জানতো যে শুধু ভেলা ভর্তি মাছই আসবেনা, মাঝারি সাইজের হরিণ কিংবা শুকরও নিয়ে আসবে তিন বন্ধু মিলে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই দুই বন্ধুর বাড়িই পুড়ে গিয়েছে গত সপ্তাহের আগুনে। তারা পরিবারসমেত সাহুলে রওয়ানা দিয়েছে। দুই ভেলায় দুই পরিবার। সিদাদ জানেনা তার বন্ধুরা ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা।
ঘর থেকে কাতরানোর শব্দ শোনা যায়। সিদাদের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে। তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তাকে ডাকছে। বাও ছুটে যায় মায়ের কাছে। মাটির কৌটায় তাকে পানি দেয়। যেকোনো সময় পানি ভাঙতে পারে। ক’দিন পরেই সিদাদের ঘর আলো করে আসবে নতুন সন্তান। তাই সে বন্ধুদের সাথে রওয়ানা হয়নি। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করেছে। কিন্তু সে অপেক্ষায় কিছু মেলেনি। খাদ্য প্রায় শেষের দিকে। তাছাড়া গ্রামে তারাই শেষ পরিবার। ভোরের আগে গ্রাম না ছাড়লে বড় বিপদ। সিদাদ চোয়াল শক্ত করে আবারো কাজে লেগে পড়ে।
ভোরের আগে ভেলা সম্পূর্ণ হয়। ভেলা দেখে সিদাদ এর পরিতৃপ্তি আসে না। কিছু একটা ভুল হয়েছে। সে এর থেকে অনেক ভালো ভেলা পূর্বে বানিয়েছে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ তার বানানো ভেলায় সাগর পাড়ি দেয়ার সাহস দেখায়। সাধারণত ভেলা বানানোর বিনিময়ে সিদাদ মাটির কৌটা, শুকনো বীজ, খাদ্য সংরক্ষণের বস্তা ইত্যাদি গ্রহণ করে। তার স্ত্রীর শামুক এবং ঝিনুকের খোলের প্রতি ভীষণ আগ্রহ। তাই অনেক সময় সে এগুলোকেও বিনিময়ের প্রথা হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে অন্য গ্রামের লোকদের জন্য যখন সে ভেলা বানাত, তখন বিনিময়ে নতুন নতুন বাণিজ্যপথ এর রাস্তা চিনে নিতো তাদের কাছ থেকে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতো। একবার এক বৃদ্ধকে তার সন্তানের জন্য একটা বর্শা বানিয়ে দিয়েছিল সিদাদ। বিনিময়ে বৃদ্ধের কাছে তিনটা রূপকথার গল্প শুনতে চেয়ছিল সে!
ছোট্ট বাও ভেলায় উঠে বসেছে। তার কোমরে জালের মতো এক ঠোঙা বাঁধা। সেখানে সে কিছু বাদাম, গাছের শিকড়, বন্য আলু, এবং ঘাস রেখেছে। ভেলায় ঠিক মধ্যখানে পানির পাত্রটি রাখা। মাটির তৈরি পাত্র। সিদাদ সেখানে পানির সাথে কিছু খাবারের বীজ মিশিয়ে রেখেছে। তার ঠিক পাশেই একটি বর্শা। যাত্রাপথে কিছু মাছ শিকার করতেই হবে। তার স্ত্রী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাহিল। সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। দুঃস্বপ্নের চেয়ে তার জন্য এখন বাস্তবতা আরও বেশি আতঙ্কজনক। নতুন সন্তান এখনো পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেনি। ভয়ে সে সিদাদকে প্রশ্ন করতে পারেনা তারা ঠিক কত সময়ের জন্য যাত্রা শুরু করেছে।
ভেলা চলতে শুরু করলো। সূর্য তখনো উঠি উঠি করছে। আকাশ রক্তাভ লাল। বাও শেষবারের মতো তার প্রিয় সৈকতকে দেখছে। পাখিরা তাদেরও আগে জেগেছে। বেশ কিছু বানর এর চিৎকারও শোনা গেলো। বনের অনেক গভীরে জায়গায় জায়গায় এখনো আগুনের হলকা। আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে কালো ধোঁয়া। আস্তে আস্তে তারা দ্বীপ থেকে দূরে চলে আসছে। পাহাড়ের খাদে ছোট্ট গুহার মতো জায়গাটি শেষবারের মতো চোখে পড়ে বাও এর। কাল সন্ধ্যায় সে সেখানে তার হাতের ছাপ রেখে গেছে। গাছের গুড়ির কয়লা এবং ছাই এ মাখানো কালি। কোনোদিন সুন্দায় আবার ফিরে সবার প্রথমে সে ওই ছাপের সাথে মিলিয়ে দেখবে তার হাত কত বড় হয়েছে।
শীতের সকাল। এখনো সামান্য কুয়াশা। বাও চিন্তা করে তারা ঠিক কতদিন এই খাবার ও পানি নিয়ে পাড়ি দিতে পারবে। এই অঞ্চলের সমুদ্রে প্রচুর পরিমাণ সোনালি অরোয়ানা মাছ পাওয়া যায়। তার বাবা খুব সহজেই এই মাছ ধরতে পারে। তাই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু দূরের গভীর সমুদ্রে যদি এই মাছ না পাওয়া যায়? বাও এর কপালে ভাঁজ পড়ে। তার মা তাকে কাছে ডাকে। তার কাছে একটি কাঁচা ডাব। সেখান থেকে কিছু ডাবের পানি সে বাও এর সারা গায়ে মাখিয়ে দেয়। শরীরটা সিক্ত থাকুক। সূর্যের আলো ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠবে। তৃষ্ণা এবং ভয় যমজ বোনের মতো একসাথে খেলতে থাকবে তাদের ভেলায়।
সিদাদ জানেনা কতক্ষণ ধরে সে ভেলা বাইছে। সে শুধু জানে তার দক্ষিণ-পূর্বে যাওয়া লাগবে। আশেপাশে দ্বীপ পেলে সামান্য থেমে আবারও যাত্রা শুরু করা যেতো। তার স্ত্রীর ক্লান্তি বাড়ছে। বাও তার মার কাছে এগিয়ে আসে। তাকে রূপকথার গল্প শোনায়। সেই রূপকথাগুলো যা সিদাদ তাকে শুনিয়েছিল অনেক মাস আগে। সিদাদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে বাও তার গল্পে নতুন চরিত্র নিয়ে আসছে। সেই চরিত্ররা ঠিক তাই করে যা তার মা পছন্দ করে। সিদাদ এর বুক গর্বে ভরে উঠলো। তার পরিবার তার কাছে সবকিছু। এই সমুদ্রযাত্রা তাকে সফল করতেই হবে।
সিদাদের ভেলা গভীর সমুদ্রে চলে আসে। যেদিকে দু-চোখ যায় শুধু পানি। পাথুরে দ্বীপ, লম্বা গাছের সারি, অকারণে উড়তে থাকা আলবাট্রস পাখি — কিছুই নেই। সিদাদ জানে এই পথ বেশি দূরের নয়। কয়েক শত কিলোমিটার এর পথ পাড়ি দিতে সিদাদের মতো দক্ষ নাবিকের চার পাঁচ দিনের বেশি লাগার কথা নয়। তবে পথে আছে নানান প্রতিকূলতা।
সিদাদ জানে জলোচ্ছ্বাস কিংবা ঝড়ো বাতাস তার ভেলাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে। সে জানে ভোরের ঘন কুয়াশা পটু নাবিকের চোখকেও প্রতারিত করে। নানা স্থানে কৌতূহলী হাঙ্গরের তাড়া। দলবেঁধে ছোট তিমির দলের ভেলা ভেঙ্গে দেয়ার কাহিনি শুনে সে বড় হয়েছে। এতো সব বাইরের বিপদ – এছাড়াও আছে মাথার উপড়ে তীব্র রোদ। প্রচণ্ড পিপাসায় এবং ভয়ে মানুষ অলীক সামুদ্রিক দানব দেখে। লবণ পানির সাথে প্রতিনিয়ত সংস্পর্শে ত্বক ফেটে যায়। শরীর ভেঙ্গে আসে যুদ্ধ শেষে এক রাজ্য হারিয়ে ঘরে ফিরে আসা ব্যর্থ যোদ্ধার ক্লান্তিতে।
পর পর দুই দিন চলে যায়। খাবার প্রায় শেষের দিকে। অবসন্ন তিনটি শরীর। ক্লান্ত-জীবিত চারটি জীবন। অপেক্ষা করে কখন সূর্য নিচে নামবে। কারণ দিনের আলো শেষ হয়ে এলে রাতের সহজ স্তিমিত যাত্রা। তারার আলো দেখে সিদাদ পথ চলতে জানে। তারা সঠিক দিকেই এগুচ্ছে। হয়ত আর দুই সকাল পরে তারা সাহুলের মাটি দেখবে দূর থেকে। কে জানে, হয়ত জোরে চিৎকার করলে তার বন্ধুরাই এগিয়ে আসবে তাদের নতুন ভূমিতে আমন্ত্রণ করতে। নতুন আশায় সিদাদ বুক বাঁধে।
নীরব রাত। শুধু ভেলায় আছড়ে পড়া ঢেউ এর মৃদু ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। পূর্ণিমার চাঁদ, সাথে আকাশ ভরা উজ্জ্বল তারা। হঠাৎ সিদাদ তার ভেলাযর দিকে তাকায়। যেখানে বর্শাটি রাখা ছিল তা নেই। বাঁশের বেশ কয়েকটি গিঁট খুলে গেছে। বাঁশগুলি অনেকটাই আলাদা হয়ে গিয়েছে। সেই ফাঁক দিয়েই বর্শাটি পড়ে গেছে। সিদাদ কাঁপা কাঁপা হাতে অন্য গিঁটটি ছোঁয়। সেটাও খুলে গেছে বেশ আগেই। সিদাদের মনে পরল এখন। ভেলায় চার জায়গায় গিঁট দেয়ার কথা। তাড়াহুড়োয় সে দুই জায়গায় দিয়েছিলো। বাও এর দিকে তাকায় সে। নিশ্চিতে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তাদের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছা করল না সিদাদের। পূর্ণিমার আলোয় তার স্ত্রী-সন্তানকে কতই না সুন্দর লাগছে!
লেখকের কথা
শত সহস্র বছর ধরে মানুষের সাথে সমুদ্রের সখ্যতা। প্রায় ৫৫ হাজার বছর আগে আদিবাসীদের (aborigines) পূর্বপুরুষরা সমুদ্রগামী ভেলায় সুন্দা (আজকের দিনের জাভা, সুমাত্রা, বালি, ইন্দোনেশিয়া) থেকে সাহুল (আজকের পূর্ব-অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি) এর দিকে যাত্রা শুরু করে [1]। এই যাত্রা ছিল অবর্ণনীয় কঠিন। অসম্ভব সাহস, ধৈর্য, সংকল্প ব্যতীত আপাত দৃষ্টিতে এই অবিশ্বাস্য কীর্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা না। তবে অদম্য যোদ্ধারা এই বাঁধাও পাড়ি দিয়েছে। প্রথম সমুদ্রযাত্রীর সংক্ষিপ্ত তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে।
তবে ভৌগোলিকভাবে তাদের যে ব্যাপারটি সাহায্য করেছিলো তা হলো, সুন্দা ও সাহুল দুই অঞ্চলেই সমুদ্রপৃষ্ঠ অনেক নিচে নেমে গিয়েছিলো। আজকের দিনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে সমুদ্রের পানি যতটুকু উপরে, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে পানি তার থেকে প্রায় চারশ ত্রিশ ফিট নিচে ছিল। উন্মুক্ত হয়ে পরেছিল কয়েক মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার স্থান। সেখানকার দ্বীপ ও উপদ্বীপে অনেক আদিবাসীদের বসবাস ছিল। তবে ক্রমান্বয়ে খাদ্য সংকট, বিভিন্ন দাবানল, কিংবা অন্যান্য পরিবেশগত ঝুঁকির জন্য আদিবাসীদের একটি অংশ সাহুলে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় [4]। মোটামুটি চার থেকে সাত দিনের পরিকল্পিত সমুদ্রযাত্রায় সুন্দা থেকে সাহুলে পৌঁছানো সম্ভব ছিল।
তারপরেও একটি প্রশ্ন রয়ে যায় – সুন্দা ও সাহুল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের মাঝে এতোটা ভিন্নতা কেন? প্রাণীদের (এমনকি পাখিরাও!) ছোটখাটো সমুদ্র সাঁতরে পাড় হয়ে অন্য এলাকায় স্থানান্তরের ঘটনা নতুন নয়। তবে আজও এমন অনেক প্রাণী অস্ট্রেলিয়াতে দেখা যায় যারা ঐতিহাসিকভাবে কখনোই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কিংবা সিঙ্গাপুরে বিচরণ করেনি। এই কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেই ভেবেছেন। তবে, সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন স্যার আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩)। ব্রিটিশ এই ভদ্রলোক ছিলেন একজন উৎসাহী প্রাণীবিজ্ঞানী। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে মালায় দ্বীপপুঞ্জ, বিশেষ করে বালি এবং লম্বক দ্বীপের আশেপাশের বাস্তুসংস্থান পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন যে উত্তরপশ্চিম অঞ্চলের প্রাণীরা হুট করেই দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের প্রাণীদের থেকে আলাদা। শুধু প্রাণীই নয়, গাছপালা, গুল্ম, এমনকি দুই প্রান্তের চরাঞ্চলের জলজ উদ্ভিদরাও সম্পূর্ণ আলাদা। এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি একটা কাল্পনিক দাগ প্রস্তাব করলেন যা অঞ্চলটিকে দুটি স্বতন্ত্র প্রাণীজগতে বিভক্ত করে; এই দাগটাকেই আজ আমরা ওয়ালেস লাইন হিসেবে চিনি [5]। সহজ ব্যাখ্যা এই যে, সুন্দা ও সাহুলের মাঝে একটি সামুদ্রিক খাঁজ ছিল যা এতোটাই গভীর যে কোনো বন্য প্রাণীর পক্ষে এই স্থানান্তর সম্ভব হয়নি।
তথ্যসূত্রঃ
- [1] Deep time history of Australia | 2.2 Big Idea 1: Scientists believe that the first Australians came from somewhere else
- [2]Adams, J. A quick background to the last ice age. Oak Ridge National Laboratory. Retrieved January 14, 2025.
- [3] A 50,000-Year History of Current Flow Yields New Climate Clues – Eos
- [4] Australian Aboriginal Migration | Cultural Survival [5] Rocky Road: Alfred Russel Wallace
Leave a Reply