আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হাজার রকমের মিথ (myth) এবং এগুলোর একটি বিশাল অংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত। এগুলোর কিছু কিছু এতোটাই প্রচালিত যে এমনকি বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতেও সেগুলো ছড়িয়ে আছে সমান ভাবে। সেই মিথগুলোর যুক্তিখন্ডন এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যই এই সিরিজটির অবতারণা করা হয়েছে। এখানে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মিথ বা অপব্যাখ্যার প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে।
১: মানুষ মস্তিষ্কের ৫ থেকে ১০% ব্যবহার করে, কেউ কেউ এর চেয়ে কিছুটা বেশি করে।
ব্যাখ্যা: মানুষ সম্পূর্ণ মস্তিষ্কই ব্যবহার করে। মস্তিষ্কের যেকোন প্রসেস আসলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের একযোগে ক্রিয়াকান্ডের ফসল। ১০% মিথের উৎপত্তি হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। ১৯০৮ সালে উইলিয়াম জোন্স লিখেন “আমরা আমাদের সম্ভাব্য মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতার একটা ক্ষুদ্র অংশ ব্যবহার করি”। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে সংগঠিত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে এই মিথ সবচেয়ে বেশী প্রচলিত হয়। কার্ল ল্যাসলে ইঁদুরের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সের বিশাল একটা অংশ সরিয়ে ফেলার পরও দেখা গেলো ইঁদুরের কর্মকান্ড স্বাভাবিক ভাবেই চলছে।সেই থেকে ১০% ব্যবহারের ধারনা চালু হয়ে গেছে। কিন্তু এই পরীক্ষায় যেই পর্যবেক্ষণ অনুপস্থিত ছিলো সেটি হচ্ছে ইঁদুরের আচরণ অনুধাবণ করার ক্ষমতা। আমরা যদি একই পরীক্ষা মানুষের জন্য করি তাহলে দেখা যাবে, পরীক্ষাকৃত মানুষের স্বাভাবিক অভ্যাসজনিত আচার-আচরণ, স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি এইসব আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে, যেটা ইঁদুরের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ সম্ভব ছিলো না। বর্তমানে আধুনিক ইমেজিং এবং ম্যাপিং প্রযুক্তির বদৌলতে গবেষকগণ বুঝতে পারছেন মানুষ মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ অংশই ব্যবহার করে।
সূত্র: ১. http://www.scientificamerican.com/article.cfm?id=people-only-use-10-percent-of-brain
২. http://en.wikipedia.org/wiki/Ten_percent_of_brain_myth
২. বিশেষ উপযোগী পোশাক ছাড়া মহাশুন্যে গেলে মানুষ ফুলে ফেটে যায়
এই মিথ সম্ভবত চালু হয়েছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং হলিউডের মুভি থেকে। এটা সত্য মানুষ যেই বায়ুমন্ডলে বাস করে তা মানুষের প্রতিবর্গমিটার পৃষ্ঠে প্রায় ১০ টনের মত চাপ দিচ্ছে (প্রতি ইঞ্চিতে সাড়ে সাত কেজি)। কিন্তু এই পরিমান চাপ এতো বেশি নয় যে মহাশুন্যের চাপহীন অঞ্চলে গেলে শরীর ফুলতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে ফেটে যাবে। প্রকৃতপক্ষে জীবের টিস্যুকে এইভাবে চাপ প্রয়োগ বা হ্রাস করে সংকুচিত বা প্রসারিত করাও যায় না। বরং মানুষ যদি মহাশুন্যে যায় তাহলে যা ঘটে তাহলো নিন্মচাপে দেহাভ্যন্তরস্থঃ পানি খুব সহজে বাস্পীভুত হয়ে যায় (আমরা ছোটোবেলায় পড়েছিলাম সুউচ্চ পর্বতে রান্না করা দুরুহ পানি দ্রুত বাস্পীভূত হয়ে যায় বলে!)। ভুপৃষ্ঠে বায়ুমন্ডলের গড় চাপ ৭৬০ মিমি পারদ চাপ। যখন বাহ্যিক চাপ ৪৭ মিলিমিটার পারদ চাপের নিচে নেমে যায় অর্থাৎ স্বাভাবিক বায়ুমন্ডলীয় চাপের ২০ ভাগের ১ ভাগ হয় তখন এই জলীয় বাস্প চামড়া ভেদ করে বাইরে চলে আসে এবং বাস্পীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমান সুপ্ততাপ শরীর থেকে গ্রহণ করে বের করে দেয় যার ফলে তাপমাত্রার আকস্মিক অবনমণ ঘটে এবং মানুষ মারা যায়্।
সূত্র: Mcgraw/Hill Encyclopedia of Astronomy
৩. বিবর্তনের মাধ্যমে জীবের উন্নতি ঘটে
বিবর্তন আসলে সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত একটি প্রক্রিয়া। তাই এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। সেটা উন্নতি বা অবণতি কিংবা নিরপেক্ষও হতে পারে। সেই পরিবর্তনকে আমরা উন্নত বলতে পারি কেবল তখনই যখন তা তার পরিবেশের সাপেক্ষে তাকে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা দেয়। এবং কোনো একটা বিশেষ সময়ে কোনো বৈশিষ্ট্যকে যদি উন্নত মনে করা হয়, পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সেটা হয়তো ক্ষতিকর বৈশিষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। ডাইনোসর যেই ঘটনায় বিলুপ্ত হয় সেই ঘটনা কিন্তু সেই সময় ইঁদুর জাতীয় প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করতে পারে নি। একই কারনে বলা যায় মানুষের সাথে অন্য প্রাইমেটদের খুব বেশী পার্থক্য নেই। কিছু কিছু প্রাইমেটের এমন কিছু ক্ষমতা আছে যা মানুষের নেই এবং vice versa। যেমন, শিম্পাঞ্জী মিলিসেকেন্ডের জন্য দেখা কোনো ঘটনা হুবহু মনে রাখতে পারে। যেই ছোট দু’একটা ক্ষমতার কারনে মানুষ এখন প্রকৃতিকে শাসন করছে তা হলো মানুষ এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে অভিজ্ঞতা স্থানান্তর করতে পারে এবং মানুষ তার চারটি আঙ্গুলকে বৃদ্ধাঙ্গুলের বিপরীতে বাঁকাতে পারে যার ফলে হাতিয়ার ব্যবহার সহজ হয়। এভাবে অভিজ্ঞতা স্থানান্তর করতে করতেই মানুষ এখন একটি জ্ঞানী প্রজাতি। কিন্তু মানুষকে যদি জন্মলগ্ন থেকে বন্য পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তার সাথে অন্য প্রাইমেটদের খুব বেশী পার্থক্য থাকে না।
সূত্র: http://listverse.com/2008/02/19/top-15-misconceptions-about-evolution/
৪. স্নায়ুকোষের (neuron) পুনরুৎপাদন হয় না, যদি কোনো স্নায়ুকোষ ধ্বংস হয় তাহলে তার আর প্রতিস্থাপন হবে না
নব্বইয়ের দশকের একটি গবেষণা হতে প্রমাণ হয়েছে মানুষের মস্তিষ্ক স্টেমসেল ধারন করে। স্টেমসেল হচ্ছে সেই ধরনের কোষ যেগুলো প্রয়োজনের সময় যেকোনো কোষে পরিণত হতে পারে। যখন আঘাতজনিত বা অন্যকোনো কারনে মস্তিষ্কের কোনো কোষ কার্যকারিতা হারায় তখন এই স্টেমসেলগুলো স্নায়ুকোষে পরিণত হয়ে ক্ষয় পূরণ করে। পিপড়া যেখাবে সারিবদ্ধভাবে এগোয় নতুন স্নায়কোষগুলো এভাবই স্থানান্তরিত হয়ে নির্দষ্ট যায়গায় পৌঁছে যায় এবং পুর্বতন কোষগুলোর সাথে এক্সন ও ডেনড্রাইটের মাধ্যমে সংযোগ তৈরি করে। এই কারনে মস্তিষ্কে নিজের ক্ষতি মেরামত করতে পারে। প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় নিউরোজেনেসিসের মাধ্যমে নতুন নতুন নিউরণ তৈরি হচ্ছে এবং নিউরণসমূহের মধ্যে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হচ্ছে।
সূত্র: ১. http://www.sciencedaily.com/releases/2006/08/060814133621.htm
২. http://www.sciencedaily.com/releases/2006/12/061223092924.htm
৫. বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়
এটাও একটা ভুল তথ্য। আগের পয়েন্টে যা বলেছিলাম, প্রতিনিয়ত নিউরণসমূহের মধ্যে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এই কারনে বৃদ্ধবয়সে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধ বয়সে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধিরও এটা একটা কারন। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ পরিবেশ থেকে আরো বেশী তথ্য গ্রহণ করতে পারে যার কারনে খুব সহজেই আমরা পারিপার্শিক ঘটনার দ্বারা বিরক্ত বোধ করতে পারি। যেমন উচ্চ ভলিউমে গান বাজা, গোলমাল পর্যবেক্ষণ করা এসব তখন চাইলেও উপেক্ষা করে থাকা যায় না। তবে মাঝে মাঝে যেমন দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতি বিলোপ ঘটছে, কিংবা চিন্তাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে বা মানুষ অপ্রকৃতিস্থ আচরণ করছে সেগুলো আসলে বিশেষ বিশেষ রোগের কারনে ঘটে থাকে যেগুলোর একটা বড়ো অংশ বংশগত। আর তাছড়া শারিরীক অক্ষমতার সাথে অনেক সময় চিন্তাগত ক্ষমতা ঠিক খাপখায়না বলে কিছু অস্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
অর্থাৎ বাস্তবতা হলো বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক অক্ষমতার বিপরীতে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি এবং বিশ্লেষণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। মানুষের বয়স যতোই বাড়তে থাকে ততোই তার মস্তিষ্কে নতুন নতুন নিউরন এবং সেগুলোতে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হয়। এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। সবকিছুর সমন্বয়ের মাধ্যমে বয়স্ক মানুষ অন্যদের চেয়ে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম
সূত্র: ১. http://www.medicalnewstoday.com/releases/176740.php
Leave a Reply