পরমাণুর অাভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ
মূল: আইজ্যাক আসিমভ
অধ্যায়-১: পদার্থ
অনুচ্ছেদ-৪: পরমাণুর বাস্তবতা
পারমাণবিক তত্ত্ব যতোই ভালোভাবে কাজ করুক কিংবা যতোই দক্ষতার সাথে এর উন্নতি ঘটানো হোক কিংবা যতোই এটি নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকবর্তিকা দিক না কোন, একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা শেষ পর্যন্ত রয়েই যায় আর তা হচ্ছে পরমাণু কেউই দেখতে পায়নি কিংবা কেউ কোনোভাবে শনাক্ত-ও করতে পারে নি। পরমাণুর যাবতীয় সাক্ষ-প্রমাণই পরোক্ষভাবে অর্জিত। আপনি হয়তো পরমাণু ধরে নিলে আপনার অমুক পরীক্ষা ব্যাখ্যা করতে পারছেন কিংবা তমুক পর্যবেক্ষণের ভিত্তি দিতে পারছেন কিন্তু পুরো বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে ভুলও হতে পারে। পারমাণবিক তত্ত্ব মোটের উপর একটি চিত্র দেয় যা ঠিকঠাক কাজ করে বলে দেখা যায়, কিন্তু এটি হয়তো বা খুব সরলীকৃত একটি মডেল যার প্রকৃত বিষয়টি অত্যন্ত জটিলও হতে পারে। এই বিষয়টিকে পোকার খেলার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পোকার খেলার শুরুতে নির্দিষ্ট পরিমান টাকার বিনিময়ে পোকার চিপ কিনতে হয় যে চিপগুলো খেলার মধ্যে টাকা হিসেবেই বিবেচিত হয়। খেলার মাঝে যাবতীয় লেনদেন সেই চিপের সাহায্যেই করা হয়, এবং লাভ ক্ষতির হিসেবও সেই চিপের সাহায্যে যথার্থভাবেই রাখা যায় কিন্তু আদতে পোকার চিপ কিন্তু টাকা নয়। পোকারের বাইরে সেগুলোর আর কোনো মূল্য নেই। সেগুলো কেবল টাকার একধরনের প্রতীক মাত্র।
এখন, মনে করুন, পরমাণুর ধারনাও রসায়ন নামক খেলায় পোকারের চিপের মতোই। যেখানে পরমাণু হয়তো এমন কোনো কিছুর প্রতীক যা আসলে খুবই জটিল এবং পরমাণু শুধুমাত্র সেসব জটিল বিষয়ের আংশিক প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এমনকি ডাল্টনের সময়ের শতবর্ষ পরেও এমন কয়েকজন বিজ্ঞানী ছিলেন যারা এই বিষয়ে খুবই সাবধান ছিলেন এবং তাঁরা পরমাণু ধারনাটিকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণের বিষয়ে অন্যদের সতর্ক করে দেন। তাঁরা বলেন, পরমাণুর ধারনা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করো, কিন্তু এটা মনে কোরো না যে সত্যিই পরমাণু অতি ক্ষূদ্র গোলগাল বিলিয়ার্ড বলের আকৃতির মতো বস্তু। এই বিজ্ঞানীদের মাঝে একজন ছিলেন রাশিয়ান-জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ উইলহেম অসওয়াল্ড (Friedrich Wilhelm Ostwald, ১৮৫৩-১৯৩২)।
পরমাণু তত্ত্ব সংক্রান্ত এই সমস্যার সমাধানে কিন্তু এরই মাঝে অনেক অগ্রগতি হয়ে এসেছিলো। এবং এই অগ্রগতি এমন একটি মাধ্যম থেকে এসেছে যার সাথে পরমাণু গবেষণার সম্পর্ক নেই বললেই চলে এবং এমন একজন বিজ্ঞানীর হাত ধরে তা এসেছে যিনি পরমাণু নিয়ে খুব সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছেন।(এটি মনে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, জ্ঞানের প্রতিটি শাখাই পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং আপাতদৃষ্টি সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি বিষয়ও কাকতালীয় ভাবে এবং ঘটনাক্রমে পরষ্পরের সাথে গভীর সম্পর্ক যুক্ত হিসেবে আবিষ্কার করা যেতে পারে)।
১৮২৭ সালে স্কটল্যান্ডের উদ্ভিদবিদ রবার্ট ব্রাউন (Robert Brown, ১৭৭৩-১৮৫৮) একটি মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পানিতে ভাসমান পরাগরেণুর গতি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি লক্ষ করেন যে, প্রতিটি পরাগরেণুই পানিতে হালকাভাবে এবং অত্যন্ত খামখেয়ালি ও বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। সেগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কনকনে পানিতে ঠান্ডায় কম্পমান। তিনি নিশ্চিত হলেন যে, পানির স্রোত, কিংবা পানির বাস্পীভবনজনিত গতি এই ঘটনার জন্য দায়ী নয়। তিনি উপসংহার টানলেন এই ভেবে যে ভিন্ন কোনো কারনে এই ঘটনাটি ঘটছে।
ব্রাউন এরপর ভিন্ন ধরনের পরাগ নিয়ে চেষ্টা করলেন এবং দেখলেন প্রতি ক্ষেত্রেই রেণুগুলো একইভাবে কম্পমাণ, দেখে মনে হয় যেন সেগুলো জীবন পেয়েছে। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য শতবছরের পুরনো মৃত রেণু নিয়ে পরীক্ষা করলেন; ফলাফল একই। তিনি এরপরে ভিন্ন ধরনের ক্ষূদ্র বস্তু নিয়ে পরীক্ষা করলেন যেগুলোতে প্রাণের উপস্থিতি থাকার কোনো সুযোগ নেই যেমন: ঘাসের গুচ্ছ, কয়লা কিংবা ধাতু প্রভৃতি এবং এদের সবগুলোই একই ভাবে গতিশীলতা প্রদর্শন করল। এই বিশেষ ধরনের গতির নাম দেওয়া হলো ব্রাউনীয় গতি, এবং এই ঘটনার ব্যাখ্যা করার মতো কাউকে তখন পাওয়া গেলো না।
১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে স্কটিশ গণিতবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell, ১৮৩১-১৮৭৯) গ্যাসের অণু এবং পরমাণুগুলোর বিভিন্ন আচরণ ব্যাখ্যা দেওয়া্র চেষ্টা করলেন এটা ধরে নিয়ে যে, অণু-পরমাণুগুলো সার্বক্ষণিকভাবে গতিময় অবস্থায় আছে। এই ধরনের গতির বিষয়ে পূর্ববর্তী অনেক রসায়নবিদ অনুমান করেছিলেন কিন্তু ম্যাক্সওয়েল সর্বপ্রথম গাণিতিকভাবে তা দেখাতে সক্ষম হন। যেভাবে অণু-পরমাণুগুলো গতিশীল অবস্থায় থেকে পরস্পরের সাথে এবং যেই পাত্রে তাদের রাখা হয় সেই পাত্রের দেয়ালের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তা ম্যক্সওয়েলের গাণিতিক মডেল অনুযায়ী গ্যাসের আচরণকে খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে। উদাহরণস্বরূপ: এটা বয়েলের সূত্রকে ব্যাখ্যা করতে পারে। ম্যাক্সওয়েলের গবেষণা তাপমাত্রা সম্পর্কেও নতুন ভাবে ভাবতে শেখায় এবং ধারনা দেয় যে তাপমাত্রা হচ্ছে অণু-পরমাণুর বেগের একধরনের গড় পরিমাপ যা শুধু গ্যাসের নয় বরং তরল এবং কঠিনের জন্যও প্রযোজ্য। এমনকি কঠিন অবস্থায় যখন অণু-পরমাণুগুলো একস্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমন করে না তখনও নিজেদের জায়গায় থেকে কম্পমান থাকে এবং সেই কম্পনের গড় মানই তাপমাত্রা হিসেবে পাওয়া যায়।
১৯০২ সালে সুইডিশ রসায়নবিদ থিওডোর সিয়েদবার্গ (Theodor Svedberg, ১৮৮৪-১৯৭১) খুঁজে বের করে দেখান যে, ব্রাউনীয় গতিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যদি কোন বস্তুর উপর বিভিন্ন দিক থেকে পানিতে গতিশীল পানির অণুর সংঘর্ষের প্রভাব হিসেবে কল্পনা করা যায়। সাধারণভাবে গড়ে সবদিক থেকে এই সংঘর্ষের প্রভাব সমান হয়, এই কারনে বস্তু কোনো এক দিকে না গিয়ে স্থির অবস্থায় থাকে। পানিতে ভাসমান একটি বস্তু যদি যথেষ্ট বড় হয় তাহলে বিভিন্ন দিক থেকে আগত সংঘর্ষের প্রভাব হয়তোবা প্রশমিত হয়ে যায়। যদিও-বা কোনো একদিক থেকে দু’একটি অণুর সংঘর্ষ অপর দিকের অণুর চেয়ে প্রবলতরও হয় (কয়েকলক্ষ কোটির মধ্যে দু-তিনটি) তার পরেও তুলনামূলক বড় বস্তুটি সহজে স্থানান্তরিত হয় না।
কিন্তু যদি পানিতে ভাসমান বস্তুটি যথেষ্ট পরিমান ক্ষুদ্র হয় তাহলে এই বস্তুর চারদিকে গতিশীল পানির অনুসমূহের ধাক্কা যদি সামান্য পরিমান অসম হয়ে থাকে তাহলে তা সেই ক্ষূদ্র বস্তুটির উপর তুলনামূলকভাবে অধিক পরিমান প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। এবং সার্বিকভাবে বস্তুটি একটি ধাক্কা অনুভব করবে। যার ফলে বস্তুটি ধাক্বা বরবার কিছুটা সরে যাবে। নতুন স্থানে গিয়ে সে হয়তো অন্য আরেক দিকে ধক্কা অনুভব করবে এবং দিক পরিবর্তন করে সেদিকে ছুটে যাবে। এভাবে বারবার বিভিন্ন দিক থেকে ধাক্কা খেতে খেতে বস্তুটি বিক্ষিপ্তভাবে এবং ইতস্ততঃভাবে বিভিন্ন দিকে ঘুরে বেড়াবে।
সিয়েদবার্গ শুধুমাত্র ধারনা প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু ১৯০৫ সালে জার্মান-সুইস গণিতবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein, ১৮৭৯-১৯৫৫) ব্রাউনীয় গতির ঘটনাটিকে ম্যাক্সওয়েলের গাণিতিক তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে দিলেন।
১৯০৮ সালে জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ট পের্যাঁ (Jean Baptiste Perrin, ১৮৭০-১৯৪২) আইস্টাইনের গাণিতিক সমীকরণকে প্রকৃত পর্যবেক্ষণের সাথে সূক্ষভাবে মিলিয়ে দেখার উদ্যোগ নিলেন। তিনি গাম রেজিনের গুঁড়াকে পানিতে ছেড়ে দিলেন। যদি পানির অণুর সাথে গামরেজিনের কোন সংঘর্ষ না ঘটার থাকে তাহলে সেগুলো পানিতে ডুবে গিয়ে তলায় জমার এবং সেখানেই অবস্থান করার কথা। যদি সংঘর্ষ হয় তাহলে কিছু কিছু কণা নিচের দিক থেকে ধাক্কা অনুভব কারনে অভিকর্ষের বিরূদ্ধে উপরের দিকে একটি বল অনুভব করবে। একসময় হয়তেো সেগুলো নিচের দিকে নামতে থাকবে কিন্তু মাঝখানে কোনো এক সময় আবার ধাক্কা খেয়ে সামান্য উপরের দিকে উঠে আসতে পারে। এভাবে বারবার ধাক্কা-ধাক্কি চলতে থাকবে। একটি নির্দিষ্টি সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমান কণা পানির অনেক গভীরে অবস্থান করবে, অপর কিছু কনা তার চেয়ে একটু উপরে অবস্থান করবে এবং আরেকটি অংশ তার চেয়েও উপরে অবস্থান করবে এবং এভাবেই বিন্যাস্ত হতে থাকবে।
আইনস্টাইনের গাণিতিক সমীকরণ থেকে দেখা যায় নির্দিষ্ট আকৃতির গুড়ার জন্য কি পরিমান কণা কোন গভীরতায় অবস্থান করবে এবং কি পরিমান ধাক্কা তারা অনুভব করবে। পের্যাঁ, আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী কণার পরিমান গভীরতার সাথে মিলিয়ে দেখেন এবং আইস্টাইনের সূত্রের যথার্থতা উপলব্ধি করেন। এখান থেকে তিনি হিসেব করেন পানির অণুর আকার কেমন হতে হবে এবং সেখানে পানির পরমাণুর আকারই-বা কেমন হতে হবে।
১৯১৩ সালে পের্যাঁ তাঁর ফলাফল প্রকাশ করেন। তাঁর গণনা অনুযায়ী পরমাণুর আকার ছিলো এক সেন্টিমিটারের একশ’ মিলিয়ন ভাগের একভাগ। অন্যভাবে লিখলে, ১০০ মিলিয়ন পরমাণুকে পাশাপাশি বসালে তাদের দৈর্ঘ্য হবে এক সেন্টিমিটার। এটিই ছিলো পরমাণু শনাক্তকরণের সবচেয়ে ফলপ্রসু পরীক্ষা। পরমাণু যদি দেখা সম্ভব না-ও হয় পরমাণুর সংঘর্ষ দেখা কিন্তু সম্ভব এবং তাদের প্রকৃত আকারও তাই বের করা সম্ভব। সবচেয়ে নাক-উঁচু বিজ্ঞানীটিকেও এই বিষয়টি মেনে নিতে হবে। এমনকি অসওয়াল্ড নিজেও পরমাণুকে বাস্তব হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন এবং বুঝলেন পরমাণু শুধুই ধরে নেওয়া মডেল নয়।
১৯৩৬ সালে জার্মান পদার্থবিদ এরভিন উইলহেম মুলার (Erwin Wilhelm Mueller, ১৯১১-১৯৭৭) একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের কৌশল পেলেন যাতে একটি সূঁইয়ের মাথাকে এতটাই বিবর্ধিত করা যায় যে তার ছবি তোলা যায় এবং সেখানে অবস্থিত পরমাণুগুলোকে উজ্জ্বল বিন্দু হিসেবে সনাক্ত করা যায়। ১৯৫৫ সাল নাগাদ সত্যিই এইধরনের পদ্ধতিতে পরমাণুকে দেখা সম্ভব হলো।
অদ্যাবধি মানুষ পারমানবিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে কেননা এটি হচ্ছে বিজ্ঞানের বিশাল ব্যাপ্তির একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মানচিত্র, যা পরমাণুর অস্তিত্ত্বকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। মানে রাখবেন, একটি তত্ত্ব কোনো অনুমানধর্মী কিছু নয়, এবং একজন প্রাজ্ঞ ও দক্ষ বিজ্ঞানী পরমাণুর অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করতে পারেন না।(পরমাণু তত্ত্বটি যেমন সত্যতার উপর ভিত্তি করে নির্মিত, তদ্রুপ সত্যতা প্রযোজ্য বিজ্ঞানের অন্য তত্ত্বগুলোর ব্যাপারেও। তত্ত্ব শব্দটি বাস্তবতাকে অনিশ্চিত বোঝাতে ব্যবহৃত হয় না এমনকি যখন কোন তত্ত্বের খুঁটিনাটি বিতর্কিত অবস্থায় থাকে তখনও। এটি বিশেষভাবে সত্য বিবর্তন তত্ত্বের বিষয়ে যা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞ এবং অশিক্ষিত ব্যক্তিদের আক্রমনের শিকার হচ্ছে, কিংবা তারচেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো গোষ্ঠীর আক্রমনের শিকার হচ্ছে যারা নিজের অন্ধবিশ্বাসকে জ্ঞান ও যুক্তিতর্কের উপরে স্থান দেয়)।
Leave a Reply