[প্রথম পর্ব দেখুন এখানে]
স্বাতীর সঙ্গে বলটার ব্যাপারে আমার মতের মিল হল, কিন্তু এর পরেই একটা ব্যাপারে আমাদের দুজনের তর্ক লেগে গেল। আমি বললাম, “তুমি তো আমার জানালার পাশ দিয়ে আলোর গতিবেগের অর্ধেক গতিতে (u = 0.5c) বেড়িয়ে গেলে। আমি দুরবিন দিয়ে দেখলাম তুমি ৩,০০,০০০ (তিন লক্ষ) কিলোমিটার দূরত্ব ২ সেকেন্ডে পার হয়ে গেলে। আলো যেহেতু সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার যায়, তাই তোমার যান ঐ দূরত্ব পার হতে আমার ঘড়িতে ২ সেকেন্ড সময় নিয়েছে। তোমার ঘড়িতে তখন ক’টা বাজে?”
স্বাতী বলল, “আশা করছি তুমি যে ২ সেকেন্ড সময় নির্ধারণ করেছ সেটা আমার আকাশযান যে তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হয়েছে সেই খবরটা আবার তোমার কাছে আসতে যতটুকু সময় নিয়েছে সেটা বাদ দিয়েই মেপেছ।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তা তো বটেই। তাছাড়া আমি এমন একটা জাড্য কাঠামো ব্যবহার করছি যেখানে কিছু পথ অন্তর একটা করে ঘড়ি রয়েছে, সবগুলো ঘড়ি আবার একই সময়ে সমলয় (synchronize) করা আছে। তুমি যখন আমার জানালার পাশ দিয়ে গেলে আমার ঘড়ি যদি শূন্য সেকেন্ড দেখায় তাহলে তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরে আমি যে ঘড়ি রেখে দিয়েছি “সেই মুহূর্তে” সেটাও শূন্য সেকেন্ড দেখাবে। তুমি যখন সেই তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরের ঘড়ির পাশ দিয়ে গেলে তখন সেই ঘড়ি দু সেকেন্ড সময় দেখিয়েছে।”
আমার জাড্য ফ্রেমে এক গাদা ঘড়ি সমলয় (synchronize) করা আছে। নিচের বাঁ কোণার ঘড়িটা আমার হলে, তিন লক্ষ দূরে আর একটি ঘড়ি আছে। ২ সেকেন্ড পরে স্বাতী সেই ঘড়ির পাশ দিয়ে যাবে।
“তাহলে আমি বলি আমার দিকটা,” স্বাতী বলে, “দুটি ঘটনা ঘটেছে। এক, আমি তোমার জানালার পাশ দিয়ে উড়ে গেছি। দুই, আমি তোমার তিন লক্ষ মিটার পার হয়েছি।”
“আমার তিন লক্ষ মিটার বলছ কেন?” আমি জিজ্ঞেস করি, “সেটা কি তোমারও নয়?”
“দাঁড়াও,” বলে স্বাতী, “ভাবনাগুলি একটু গুছিয়ে নিই। প্রথমতঃ এই দুটি ঘটনা তোমার কাঠামোয় দুটি ভিন্ন জায়গায় ঘটেছে। কিন্তু আমার আকাশযানের কাঠামোয় তারা একই জায়গায় ঘটেছে। তাই এক্ষেত্রে আমার কালিক অন্তর হচ্ছে যথার্থ বা প্রকৃত সময়, কারণ তোমার জানালার পাশ দিয়ে যাওয়া ও তোমার তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হওয়া এই দুটো ঘটনাই আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মেপেছি। কিন্তু তুমি এই দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন জায়গা থেকে মেপেছ। তাই তোমার কালিক অন্তর যথার্থ নয়। তোমার কালিক অন্তর যদি $\Delta t =2$ সেকেন্ড হয়, তবে আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী আমার কালিক অন্তর হবে,
$\Delta t_0 = \Delta t \sqrt{1 – \frac{u^2}{c^2}} = 2 \sqrt{1 – \frac{(0.5c)^2}{c^2}} = 2 \sqrt{1- 0.25} = 1.73$ সেকেন্ড
তাই তুমি যখন তোমার দুটো ঘড়ির মাধ্যমে ২ সেকেন্ড সময় দেখছ, আমি ১.৭৩ সেকেন্ড সময় দেখছি।”
“তাহলে তুমি যখন তোমার ঘড়িতে ১.৭৩ সেকেন্ড সময় দেখছ, আমি আমার ঘড়িতে ২ সেকেন্ড দেখব।” আমি স্বাতীকে বলি।
“এখানেই যত ঝামেলা। উত্তরটা হচ্ছে না।” স্বাতী উত্তর দেয়।
“কি বলছ তুমি?” আমি একটু রেগেই যাই স্বাতীর ওপর।“একটু আগেই না বললে আমি যখন ২ সেকেন্ড মাপবো, তুমি ১.৭৩ সেকেন্ড মাপবে। তাহলে তুমি যখন ১.৭৩ সেকেন্ড মাপবে, আমি কেন ২ সেকেন্ড মাপবো না।”
“না, আমি তা বলি নি,” শান্ত স্বরে উত্তর দেয় স্বাতী, “প্রথম ক্ষেত্রে তুমি যখন দেখছ আমার আকাশযান দ্রুত বেগে আকাশে ছুটে যাচ্ছে, তুমি এক জায়গায় বসে আমার সময় ও দূরত্ত্ব নির্ধারণ করতে পারবে না, তোমাকে সেই এক গাদা সিনখ্রোনাইজড (সমলিত) ঘড়ির সাহায্য নিতে হবে। আমি যখন তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হব সেই দূরত্ত্বে বসানো একটা ঘড়ি তখন দেখাবে ২ সেকেন্ড, কিন্তু আমার আকাশযানের ঘড়ি বলবে মাত্র ১.৭৩ সেকেন্ড পার হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে তুমি নিজে ২ সেকেন্ড সময় মাপো নি, বরং তোমার কাঠামোতে এক গাদা ঘড়ি ব্যবহার করে নির্ধারণ করেছ যে আমার দু সেকেন্ড সময় লেগেছে তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হতে। যেহেতু দুটো ঘটনা তুমি দুই জায়গা থেকে মেপেছ তোমার মাপাটা “যথার্থ” বা proper নয়, সেটা হবে $\Delta t$। এখানে আমার সময়টা হচ্ছে যথার্থ সময় $\Delta t_0$।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হচ্ছ উলটো। এখন আমি ১.৭৩ সেকেন্ড মাপছি এক জায়গায় বসে নয়, বরং দু–জায়গায়। তুমি কিন্তু একই জায়গায় বসে সময় দেখছ। এখন তোমার সময় হবে যথার্থ।”
“দাঁড়াও,” আমি বলে উঠি, “আমি এটা বুঝতে পারছি তুমি যখন ভীষণ গতিতে ভ্রমণ করছ তোমার সময়ের প্রসারণ হচ্ছে যার ফলে আমার ২ সেকেন্ড তোমার ১.৭৩ সেকেন্ড হচ্ছে। এবং যেহেতু তুমি একই জায়গায় বসে তোমার সময় নির্ধারণ করছ তাই তোমার সময়কে যথার্থ সময় বলা হচ্ছে।”
“ঠিক, স্বাতী বলে। এখন আমাদের দেখতে হবে প্রশ্নটা কাকে করা হচ্ছে। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় – স্বাতী, তুমি যখন তোমার ঘড়িতে ১.৭৩ সেকেন্ড দেখবে তখন দ.র ঘড়িতে কত সময় দেখাবে, তাহলে আমি বলব আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক কার সময় এখানে যথার্থ। যেহেতু এই ক্ষেত্রে আমাকে আমার কাঠামোতে ১.৭৩ সেকেন্ড মাপতে হবে সেহেতু আমাকে আমার কাঠামোতে এক গাদা সিনক্রোনাইজড ঘড়ির সাহায্য নিতে হবে, এবং সেই ক্ষেত্রে তোমার সময় হবে যথার্থ। আমি দেখব তুমি আমার থেকে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছ এবং তুমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমার সময় মাপছ। এই ক্ষেত্রে আমার কালিক অন্তর হবে $\Delta t =$ ১.৭৩ সেকেন্ড, এবং তোমার অন্তর হবে,
$\Delta t_0 = \Delta t \sqrt{1 – \frac{u^2}{c^2}} = 1.73 \sqrt{1 – \frac{(0.5c)^2}{c^2}} = 1.73 \sqrt{1- 0.25} = 1.5$ সেকেন্ড
“এই ক্ষেত্রে প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি আমি,” স্বাতী বলে, “এবং আপেক্ষিকতার বোধ অনুযায়ী এবার তুমি আমার কাছ খুব দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছ। এবং ১.৭৩ সেকেন্ড পরে আমি তোমাকে ১.৭৩২০৫ সেকেন্ড পূরণ ১,৫০,০০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড = ২,৫৯,৮০৮ কিলোমিটার পেছনে দেখব। আমি বলব যে তোমার ঘড়ি শ্লথ চলছে এবং সেই ঘড়িতে মাত্র ১.৫ সেকেন্ড পার হয়েছে।”
আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
স্বাতী বলতে থাকল, “ঠিক আছে, আমি বরং একটা চার্ট বানাই। আমার আকাশযানের গতিবিধি দেখে তুমি (দ.) বলব, স্বাতী ৩,০০,০০০ কিলোমিটার দূরত্ত্ব পারি দিয়েছে ২ সেকেন্ডে। এদিকে আমি (স্বাতী) বলব, তুমি যাকে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার বলছ সেটা পারি দিতে আমার (স্বাতীর) সময় লেগেছে ১.৭৩ সেকেন্ড, কিন্তু আমি (স্বাতী) ৩,০০,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করি নি, বরং দ. আমাকে ছেড়ে ২,৫৯,৮০৮ কিলোমিটার পেছনে চলে গেছে। আর দ.র ঘড়িতে তখন বাজবে ১.৫ সেকেন্ড।
আমি | স্বাতী (যথার্থ সময়) | অতিক্রান্ত স্থান |
২ সেকেন্ড | ১.৭৩ সেকেন্ড | ৩,০০,০০০ কি.মি. |
আমি (যথার্থ সময়) | স্বাতী | অতিক্রান্ত স্থান |
১.৫ সেকেন্ড | ১.৭৩ সেকেন্ড | ২,৫৯,৮০৮ কি.মি. |
“এই জনেই কি এর নাম আপেক্ষিকতা?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“সে তোমরা ভাল জানো। আমি তো আর পৃথিবীর লোক নই,” স্বাতী হেসে বলে, “তবে আপেক্ষিকতায় তোমার জন্য যা সত্যি আমার জন্য তা নয়, তোমার আর আমার ঘটনা যুগপৎ বা simultaneous নয়।”
Leave a Reply