টিকা-বিরোধী আন্দোলন : একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দিয়ে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে। বিজ্ঞানমনষ্কতা কেন জরুরী? এই প্রশ্নের যথার্থতা

হুপিং কাশি

আমাদের তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বাংলাদেশে জনগণের মাঝে বিজ্ঞানমনষ্কতা কম। বিপরীতভাবে, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে উন্নত দেশে জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানমনষ্কতা বেশি। উন্নতদেশে সাধারণ মানুষজন উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা পেয়ে থাকেন বলে যে তাদের বিজ্ঞানবোধও বেশি হবে – বিষয়টা এতো সরল নয়। প্রথমবিশ্বেও দরকার হয় বিজ্ঞান-জনপ্রিয়করণ এবং আধুনিক-কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন। তৃতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতী নেয়ার সময় পাঠ্যতে ঠিক এই প্রসঙ্গেরই একটা বাস্তব উদাহরণ দেখলাম। সেটাই এখন পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

 

 অভিভাবকেরা যখন টিকার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন

একটা সময়, হুপিং কাশি ভয়াবহ রোগ ছিলো। ছোট শিশুরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হতো। হুপিং কাশির নামই কেবল শুনেছি। কোন রোগী দেখি নি। সম্ভবত, আমাদের আগের প্রজন্মও, মানে আমাদের পিতামাতারাও এই রোগ দেখে নি। কারণ ভ্যাক্সিন বা টিকার আবিষ্কার। পাঠক খেয়াল করবেন, সরকারী টিকা দেয়ার ক্যাম্পেইনে ডিটিপি জাতীয় ভ্যাক্সিন শিশুকে দেয়া হয়। এই টিকার একটা অংশ হলো পার্টুসিস বা হুপিং কাশির টিকা। এখনো অনেক দেশে এই টিকা দেয়া হয় না বলে হাজার হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে।

হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হলে রোগী প্রথম প্রথম সাধারণ ঠান্ডার মতো উপসর্গ দেখাতো। রোগ জটিল হওয়ার সাথে সাথে বোঝা যেত, এটা সহজ কোন রোগ নয়। রোগী অত্যন্ত শ্বাসকষ্টে ভুগতো। তীব্র শুকনো কাশির দমকে দমকে বমিও বের হয়ে আসতো। এক নাগাড়ে কাশির ফাঁকের সময়ে রোগী দ্রুত বেশি শ্বাস নিতে গিয়ে এক ধরনের শব্দের সৃষ্টি করতো। ওই বৈশিষ্ট্যমূলক শব্দের থেকেই হুপিং কাশি রোগের নামকরণ। এই হুপিং কাশিই পরবর্তীতে অন্যান্য শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করতো – যার কোন উপশম থাকতো না। পরম আদরের সন্তানের এই পরিণতি কোন অভিভাবকই চান না।

তাই যখন ১৯৫০ সালের দিকে হুপিং কাশির ভ্যাক্সিন প্রচলিত হলো, উন্নত বিশ্বের অভিভাবক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন সোনার চাবি হাতে পেলেন। ছোট শিশুদের জন্য পার্টুসিস ভ্যক্সিন দেয়ার নিয়ম করে দেয়া হলো। ফলাফল আশানুরূপ। শিশুদের হুপিং কাশি হয়ে গেল ইতিহাস।

কিন্তু, একটা ঝামেলা রয়েই গেল।

এই ভ্যক্সিনটা শিশুর দেহে সামান্য প্রতিক্রিয়া তৈরি করতো। ২০ শতাংশ শিশু ব্যাথা এবং শারীরিক-অস্বস্তি অনুভব করতো। আর ০.১ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের তীব্র, নিরাময়ের অযোগ্য ক্ষতি হতে দেখা গেল। যদিও কোন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেলো না যে পার্টুসিস ভ্যাক্সিনের কারণেই মস্তিষ্কের এই ক্ষতি তৈরি হচ্ছে। হুপিংকাশি শিশুদের কতো ভয়াবহ রোগ তা সেই সময়ের অভিভাবক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দেখেছেন। তাই তারা শিশুদের এই ক্ষতির সম্ভাবনাটুকু মেনে নিতেন।

১৯৭০ সালের দিকে উন্নতদেশগুলো থেকে হুপিং কাশি প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেল। তখন চিকিৎসক, অভিভাবকরা এই পার্টুসিস টিকার উপসর্গগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন। এই টিকা ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রচারমাধ্যমগুলো জনমতকে টিকার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকলো। বিশেষ করে জাপানে এই টিকা-বিরোধী প্রচারণা তুঙ্গে উঠে গেল। চিকিৎসকরা তখন এই টিকা বর্জন করা শুরু করলেন। ১৯৭৬ সালে দেখা গেল জাপানে মাত্র ১০ শতাংশ শিশু পার্টুসিস ভ্যাক্সিন নিয়েছে। তারপরের কাহিনী অত্যন্ত করুন। ১৯৭৯ সালে জাপানে হুপিং কাশি মহামারী আকারে দেখা দেয়। সেখানে এক বছরে ১৩ হাজার রোগী হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হয়। মারা যায় ৪১ জন।

পার্টুসিস টিকাটির বিরুদ্ধে ঠিক একই দৃশ্যপট দেখা গেল  ইউরোপ ও তৎকালীন সোভিয়েই ইউনিয়নেও। প্রথমে টিকার বিরুদ্ধে আন্দোলন, টিকা বর্জন, পরিশেষে হুপিং কাশির মহামারী।  সবচাইতে তিক্ত বিষয়টা কি জানেন? শিশুদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে যে পার্টুসিস টিকা উঠিয়ে নেয়া হলো, তার ফলাফল অজস্র শিশুর মৃত্যু, অগণিত শিশুর মস্তিষ্ক সহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা।

আবার নব্বইয়ের দশকে টিকা-বিরোধী কিছু ফ্যানাটিক-গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কারণ তারা ৭০-এর দশকের পর বিশ বছর সময় পেয়েছিলো হুপিং কাশি মহামারী ভুলে যাওয়ার জন্য। তবে তারা খুব কম অভিভাবককেই ভূল পথে পরিচালিত করতে সফল হয়েছে – যেই পথে একটি নতুন প্রজন্মকে কষ্টকর শারীরিক জটিলতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হয়।

 

সুখের কথা, পরবর্তীতে এই রোগের বিরুদ্ধে ভ্যক্সিনটিকে আরো উন্নত করা হয়। পূর্ববর্তী সংস্করণের চাইতে এর উপসর্গ সামান্যই।

 

তথ্যসূত্র: Impact of the anti-vaccine movements on purtussis control: the untold story.

লেখাটি 221-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 906 other subscribers