আপেক্ষিকতায় যথার্থ সময়


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

[আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত অধ্যাপক রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বই ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ একটি উঁচু মানের বই। সমস্যা হল আমার কাছে সেটার যে কপিটা আছে তার ছাপা ও বাঁধাই ঠিক সম পরিমাণে নিকৃষ্ট। যার ফলে এই বইটি ডেস্ক রেফারেন্স হবার বদলে বইয়ের তাকের কোন এক কোণায় অবহেলায় পড়ে থাকে। অধ্যাপক রঞ্জন proper time এর বাংলা করেছেন দেখলাম যথার্থ সময়। যথার্থ সময়টি কি জিনিস? আর time interval-কে বলেছেন কালিক অন্তর, ভাষাটা ইন্টারেস্টিং না? ]

ধরা যাক কোন একটা জাড্য কাঠামোয় (inertial reference frame) দুটি ঘটনা একই স্থানে ঘটেছে, কিন্তু একই সময়ে নয়। অর্থাৎ তাদের মাঝে কালিক (বা কালের অর্থাৎ সময়ের) অন্তর আছে। যেমন প্রথম ঘটনাটা হতে পারে আমি হাত থেকে একটা বল ছেড়ে দিলাম, দ্বিতীয় ঘটনা হল বলটা মাটিতে আঘাত করল। ধরা যাক এই দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের পার্থক্য হচ্ছে $\Delta t_0$। যদি বলটার মাটিতে পড়তে ১ সেকেন্ড সময় লাগে তবে $\Delta t_0 =$ ১ সেকেন্ড। যে কাঠামোয় আমি এই বল পড়ার ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করছি তার তুলনায় আমি স্থির আছি। সেটা আমার বাড়ির একটা ঘর হতে পারে। এই কাঠামোটাকে আমরা বলব আমার স্থিত বা প্রকৃত কাঠামো।

এখন ধরা যাক কাকতালীয় ভাবে ঐ বলটা মাটিতে পড়ার সময় আমার বন্ধু স্বাতী একটি দ্রুত গতির যানে বসে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এবং ঘরের জানালা দিয়ে এই ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করল। (স্বাতী ভিনগ্রহের অধিবাসী, স্বাতী তারার কাছের এক সৌরমণ্ডল থেকে এসেছে বলে আমি তাকে স্বাতী নাম দিয়েছি।)

সেই হাইটেক যানের গতি ছিল বেশ, ধরা যাক তা হল $u$। পরে স্বাতীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম সেই সময়ে তার আকাশযানের গতি ছিল আলোর গতির অর্ধেক। আলোর গতিকে যদি আমরা $c$ দিয়ে চিহ্নিত করি, তবে $u = 0.5c$। আমার ঘরের প্রকৃত কাঠামোর তুলনায় স্বাতী সমবেগে চলছিল, অর্থাৎ তার কোন ত্বরণ ছিল না। সেই ক্ষেত্রে বলা যায় আমার জাড্য কাঠামোর মত স্বাতীর জন্যও তার আকাশযান একটা জাড্য কাঠামোর ভূমিকা পালন করেছে।

যাইহোক স্বাতীর সঙ্গে পরদিন দেখা। সে বলল, “কাল তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। দেখি তুমি একটা বল নিয়ে খেলছ।” আমি বললাম, “বলটা কতক্ষণে মাটিতে পড়ে তাই মাপছিলাম।” স্বাতী জিজ্ঞেস করল, “কেন?” আমি বললাম, “মাধ্যাকর্ষণ জনিত ত্বরণ, $g$-এর মান জানতে ঐ সময়টা লাগবে।”

স্বাতী বলল, “খুব ভাল। তা কত সময় নিল?”

আমি বললাম, “এক সেকেন্ড।”

স্বাতী বলল, “আমার আকাশযানের যান্ত্রিক চোখ থেকে কিছু এড়ায় না। সেটার হিসেবে তোমার বল পড়তে সময় লেগেছে ১.১৫৪৭ সেকেন্ড।”

আমি বললাম, “তা বটে। তোমার গতি ছিল আলোর গতির অর্ধেক। স্বাভাবিক ভাবেই তোমার কাঠামোতে সময়ের প্রসারণ হয়েছে। আমার $\Delta t_0 =$ ১ সেকেন্ড হচ্ছে যথার্থ বা প্রকৃত সময়, কারণ বল ছাড়া ও বলের মাটিতে আঘাত করা এই দুটো ঘটনাই আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মেপেছি। কিন্তু তুমি এই দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন জায়গা থেকে মেপেছ। তাই তোমার কালিক অন্তর যথার্থ নয়। তোমার কালিক অন্তর যদি $\Delta t$ হয়, তবে আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী

$\Delta t = \dfrac{\Delta t_0}{\sqrt{1-\frac{u^2}{c^2}}}= \dfrac{1}{\sqrt{1-\frac{(0.5c)^2}{c^2}}}= \dfrac{1}{\sqrt{1-0.25}} = 1.1547$ সেকেন্ড

অর্থাৎ তোমার বেগসম্পন্ন কাঠামোতে সময়ের প্রসারণ হয়েছে। এক অর্থে তোমার কাঠামোতে সময় শ্লথ হয়ে গিয়েছে। তুমি বলটাকে আমার থেকে আস্তে পড়তে দেখেছ।”

আমি যদি আরো জোরে যেতাম তাহলে বলটাকে তো আরো আস্তে পড়তে দেখতাম,” স্বাতী বলে।

তা বটে,” আমি বলি, “আর দেখ তোমার জন্য এই গ্রাফগুলো আমি আগেই বানিয়ে রেখেছিলাম।” এই বলে আমি নিচের ছবিগুলো স্বাতীকে দেখাই।

এখানে $x$-অক্ষে আলোর ভগ্নাংশে স্বাতীর গতিবেগ দেখানো হয়েছে। $0.2$ মানে আকাশযানের গতি হচ্ছে $0.2c$ বা আলোর গতিবেগের ২০%, $0.8$ হচ্ছে $0.8c$ বা আলোর গতিবেগের ৮০% $y$-অক্ষে দেখানো হয়েছে কালিক অন্তর। $y$-অক্ষের একক হচ্ছে সেকেন্ড। দেখাই যাচ্ছে বল পড়ার কালিক অন্তর স্বাতীর কাঠামোর গতিবেগের ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ সেটা হল গতিবেগের ফাংশান। আকাশযানের গতিবেগ যত বেশী হবে সময়ের অন্তর তত বাড়বে, স্বাতী দেখবে বলটা পড়তে বেশী সময় নিচ্ছে। আলোর গতিবেগের ৮০%-এ বলটা পড়তে সময় নেবে প্রায় ২.৮ সেকেন্ড।

আর তুমি আলোর গতিবেগের যত কাছাকাছি যাবে কালিক অন্তর তত বেড়ে যাবে,” আমি বলি। “নিচের গ্রাফটা দেখ।”

তুমি যদি আলোর গতিবেগের ৯৯.৯৯৯৯৯% বা $0.9999999c$-তে ভ্রমণ করতে তবে তোমার কাছে ঐ কালিক অন্তরটা হত ৫x১০ বা ৫,০০০,০০০ সেকেন্ড। অর্থাৎ পাঁচ মিলিয়ন বা পঞ্চাশ লক্ষ সেকেন্ড। যা কিনা প্রায় ৫৮ দিন বা দু’মাসের সমান।

আর আলোর গতিবেগে ভ্রমণ করলে সময় তোমার জন্য স্তব্ধ হয়ে যেত। বলটা ওপরেই আটকে যেত, আমার হাত থেকে আর পড়ত না।”

যে কালিক অন্তর একই জায়গায় নির্ণীত হচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে যথার্থ সময়। শুধুমাত্র আমার ঘড়িই আমার কাঠামোর তুলনায় স্থির আছে। কিন্তু স্বাতীর কাঠামো আমার তুলনায় গতিশীল ছিল বলে তার ঘড়ি আমার কাঠামোর তুলনায় স্থির ছিল না। কাজেই তার সময় যথার্থ সময় নয়। তাই তার সময়কে আমার তুলনায় মাপতে হবে, সেই সময় শ্লথ হবে।

সত্যিই কি তাই? আমার সময় যথার্থ আর স্বাতীর সময় যথার্থ নয়? বিষয়টিকে একটু পরিষ্কার করতে হলে আর একটু ভাবনা চিন্তার দরকার আছে।


পরের পর্ব পড়ুন এখানেঃ

লেখাটি 753-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. দীপেনদা, ক্লাসরুমে বসে পড়লাম। স্বাতীর সাথে আলাপ ভালো লাগছে। আপেক্ষিকতার কিছু ধারণা বোঝার আশা রাখি।

  2. বিজ্ঞান ব্লগে লেখায় ধন্যবাদ। পরের লেখার অপেক্ষায় আছি।

  3. দীপেনদা, ভালো লেগেছে । বাংলাতে সিরিজ আকারে লিখে বই করা করা যায়না??

  4. অত্যন্ত জটিল একটি বিষয় অতি সাধারণভাবে সবার বোঝার উপযোগী করে প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ। যারা বলে বাংলাভাষায় আর যাই হোক বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয় তাদের জন্য এটা একটা চপেটাঘাত! এ চর্চা এগিয়ে যাক…

    1. স্যার, আপনার বাঁধ বিষয়ক লেখাগুলো বিজ্ঞানব্লগে পোস্ট করে দিন।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading