আজ যে বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করব বলে ঠিক করেছি একে সবাই CP-Violation বলে । আমি যখন এই নামটির সাথে প্রথম পরিচয় হই তখন আমার খালি ফ্রাইড চিকেনের কথা মনে পড়তো । অনেকের চোখ নিশ্চয় এতক্ষণে কপালে উঠেছে । তারা হয়তো ভাববে ফ্রাইড চিকেনের সাথে CP-Violation এর আবার কি সম্পর্ক ? আসলে কোনই সম্পর্ক নাই কিন্তু নামটাই আমার কাছে যত বিপত্তির কারণ হয়ে দারিয়ে ছিল । আমার বাসা হতে ৫মিনিট হাঁটলে CP নামের ফ্রাইড চিকেনের একটি ফাস্টফুডের শপ । সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা বন্ধুরা মিলে CP এর পাশে বসে আড্ডা দিতাম কারনে-অকারনে ঐ ফাস্টফুড হতে খাওয়া হতো তাই বলতে পারেন ঐ ফাস্টফুডের শপটা আমার কাছে অনেক প্রিয় ছিল । আমি নিশ্চিত আপনারা যদি ঢাকায় থাকেন তাহলে অবশ্যই এই ধরনের CP ফাস্টফুডের একটার না একটার দেখা পেয়েছেন । তবে আপনারা আবার CP-Violation শুনে আমার মত ফ্রাইড চিকেনের কথা মনে করবেন না নিশ্চয় । এবার মূল কথায় ফিরে আসি আসলে এই CP-Violation ব্যাখ্যা করে কেন মহাশূন্যে প্রতিকণা হতে কণার পরিমান অনেক বেশি । CP-Violation ব্যাখ্যা করার আগে আমাদের প্রতিসাম্য বা Symmetry সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত ।
প্রতিসাম্য বা Symmetry কি ?
Symmetry বাংলায় যাকে বলে প্রতিসাম্য (প্রতি= বিপরীত, সাম্য= সমান) । দুইটি বস্ত সব দিক দিয়ে সমান কিন্তু কোন একদিক দিয়ে পরস্পর বিপরীত ধর্ম প্রদর্শন করে । যেমন আমারা যদি আয়নার সামনে দাড়াই তাহলে দেখব আমাদের প্রতিবিম্ব, সবই আমাদের মত কিন্তু আমাদের বাম হাত হবে প্রতিবিম্বের ডান হাত । কণা পদার্থ বিজ্ঞানে প্রতিসাম্য বা Symmetry বলতে বুঝায় প্রতিটি কণারই বিপরীত চার্জযুক্ত কণা আছে (পদার্থবিজ্ঞানে প্রতিসাম্যের বিষয়টি অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয় এবং শুধু প্রতিসাম্যের উপরই অনেক বই আছে তবে কণা পদার্থবিজ্ঞানের CP-Violation সম্পর্কে সহজে বুঝার জন্য আমি এতটুকুই বললাম ) । যেমন ইলেকট্রন এর প্রতিকণা হচ্ছে পজিট্রন ( প্রতিকণা সম্পর্কে জানতে চাইলে এখানে যেতে পারেন ) ।
১৯৫৬ সাল অবধি বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল পদার্থবিদ্যার সুত্রগুলা তিনটি পৃথক প্রতিসাম্যের প্রত্যেকটিকে মেনে চলে আর এই তিনটি প্রতিসাম্যের নাম হচ্ছে C,P এবং T-প্রতিসাম্য ।
C প্রতিসাম্যের বা Conjugate charge Symmetry এর অর্থ হচ্ছে: পদার্থবিদ্যার সুত্রগুলা কণা এবং প্রতিকণার জন্য একই রকম । কি জটিল হয়ে গেল? আচ্ছা অন্য ভাবে বলি । ধরেন আপনার নাম রহিম এবং আপনার আকার একটা কণার মত হয়ে গেল তাহলে আপনার বিপরীত কণাকৃতির আরেকজন মানুষ আছে যার নাম প্রতিরহিম । আপনার আর প্রতিরহিম এর সব কিছুই এক অর্থাৎ ভর , শক্তি ইত্যাদি একই শুধু চার্জটা বিপরীতমুখী ( আবার কেউ এটা ভাববেন না যে চার্জটা বিপরীতমুখী বলে প্রতিরহিম মেয়ে এই জন্য পরস্পর আকর্ষণ অনুভব করবেন) । মজা করার জন্য একটা কথা বলি । আপনার নাম যদি সত্যি রহিম হয় আর আপনি কোন মতে আপনার প্রতিমানুষ অর্থাৎ যার নাম আমরা দিয়েছি প্রতিরহিম তার অবস্থান জানতে পারলেন তাহলে ভুলেও কিন্তু তার কাছে যাবার চিন্তা করবেন না কারন তাহলে আপনারা দুইজন আইনস্টাইনের বিখ্যাত সুত্র E=mc2 এর শিকার হবেন । কি বুঝতে পারেন নাই ? আপনারা দুইজন অদৃশ্য হইয়া যাবেন আর আপনাদের ভর বিপুল পরিমাণ শক্তিতে রুপান্তর হবে । যাইহোক মূল কথা হচ্ছে , বিজ্ঞানীরা আগে মনে করতেন রহিমের উপর পদার্থ বিজ্ঞানের যে সুত্র প্রযোজ্য প্রতিরহিমের উপর সেই একি সুত্র প্রযোজ্য হবে ।
P প্রতিসাম্যের বা Parity Symmetry এর অর্থ হচ্ছে: পদার্থবিদ্যার সুত্রগুলা যেকোনো পরিস্থিতি এবং তার দর্পণ প্রতিবিম্বের ক্ষেত্রে একই হবে । আবার রহিম এর কাছে যাই । ধরেন রহিম দর্পণের বা আয়নার সামনে দারিয়ে প্রতিবিম্বের সাথে হাত মিলানোর জন্য ডান হাত বাড়াল , কিন্তু প্রতিবিম্ব কিন্তু তার বাম হাত বাড়াবে । পদার্থবিদরা মনে করতেন এই রহিম এবং প্রতিরহিমের জন্য পদার্থবিদ্যার সুত্রগুলা একই হবে । একটা কণা বাম-হাতের নিয়ম মেনে চললে দর্পণে তা ডান-হাতের নিয়ম মেনে চলবে । যেমন সব নিউট্রিনো হচ্ছে বাম-হাতের নিয়ম মেনে চলে আর সব প্রতি-নিউট্রিনো হচ্ছে ডান-হাতের নিয়ম মেনে চলে ।
T প্রতিসাম্যের বা Time Symmetry এর অর্থ হচ্ছে: আপনি যদি কণা ও প্রতিকণার গতি বিপরীতমুখী করে দেন , তাহলে System টি অতীতকালে যা ছিল সে অবস্থায় ফিরে যাবে । আমরা যেমন ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করা অংশ forward করলে যেমন, ঘটনা সামনের দিকে চলে আবার backward করলে উলটো দিকে ঘটতে থাকে । রহিমের বিকল্প নাই , ধরা যাক রহিম CP ফাস্টফুডের শপ হতে ১০ মিনিট আগে ফ্রাইড চিকেন খেয়ে একটি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াল , এখন যদি প্রতিরহিম কে ঐ বাসস্ট্যান্ডে দাড়করিয়ে সময়ের গতি বিপরীতমুখী করে দেই তাহলে ১০ মিনিট পরে CP ফাস্টফুডের শপে বসে ফ্রাইড চিকেন খাওয়ার কথা ( কিন্তু দেখা গেল সে ফ্রাইড চিকেন না খেয়ে চটপটি খাচ্ছে কারণ সে T প্রতিসাম্য মেনে চলে না ) ।
CP-Violation কি ?
উপরের এই তিনটি প্রতিসাম্যে পদার্থবিদ্যার সুত্রগুলা মেনে চলে নাই বলেই কিন্তু এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে । আর যদি মেনে চলত তাহলে মহাশূন্যে শক্তি ছাড়া আর কোন কিছুই সৃষ্টি হতো না ।
চিত্রে সাদা পাখি গুলোকে একটি চার্জ ধরলে কালো পাখি গুলোকে বিপরীত চার্জ ধরতে হবে ।
১৯৫৬ সালে Tsung-Dao Lee এবং Chen Ning Yang নামে দুইজন আমেরিকান পদার্থবিদ প্রস্তাব করেন যে , দুর্বল বল P প্রতিসাম্য মেনে চলে না । অর্থাৎ দুর্বল বল তার দর্পণ প্রতিবিম্বকে যেভাবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল মহাবিশ্ব কে অন্য ভাবে বিকশিত করাবে । সে বছরেই Chein Shiung Wu নামের একজন সহকর্মী তাঁদের এই ভবিষ্যৎ বাণীর সত্যতা প্রমাণ করেন । পরের বছরেই Tsung-Dao Lee এবং Chen Ning Yang তাঁদের এই কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার পান । আরো দেখা গিয়েছিল যে দুর্বল বল C প্রতিসাম্য মেনে চলে না । অর্থাৎ প্রতিকণা দিয়ে গঠিত মহাবিশ্বের আচরণ আমাদের মহাবিশ্ব হতে ভিন্ন হবে । দুর্বল মিথস্ক্রিয়াতেই কেবল এক ফ্লেভারের কোয়ার্ক বা লেপ্টোন, যথাক্রমে অন্য ফ্লেভারের কোয়ার্কে বা লেপ্টোনে রুপান্তর হতে পারে । এই রুপান্তরে একটি কোয়ার্ক এক একক ইলেকট্রন চার্জ পরিবর্তনের অনুমোদন দেয় । কারণ কোয়ার্ক এবং লেপ্টোন পরিবর্তন হতে পারে দুর্বল মিথস্ক্রিয়া দ্বারা , আমাদের মহাবিশ্বের চারপাশে স্থায়ী কণাগুলোর মধ্যে একমাত্র হালকা কোয়ার্ক এবং লেপ্টোনরা অন্তর্ভুক্ত । আর ভারী কণাগুলো অবক্ষয়ের (Decay এর) মাধ্যমে অন্য এক বা একাধিক হালকা কণায় রুপান্তর হয় ।
যাইহোক বিজ্ঞানীরা আশা করেছিলেন দুর্বল বল হয়তো CP এর যুক্ত প্রতিসাম্য মেনে চলবে । কিন্তু আশা ঘুরে বালি দিল ,১৯৬৪ সালে জে ডব্লিউ ক্রোনিন এবং ভ্যাল ফিচ্ নামক দুইজন আরো দুইজন আমেরিকান পদার্থবিদ তারা আবিস্কার করল K-meson নামক কণাগুলি CP প্রতিসাম্য মেনে চলেনা । এই জন্য ১৯৮০ সালে তারা নোবেল পান ।
একটা গাণিতিক উপপাদ্য অনুসারে যে তত্ত্ব কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিক তত্ত্ব মেনে চলে , সে তত্ত্বকে সব সময়ই CPT –এর সংযুক্ত প্রতিসাম্য মেনে চলতে হবে । অর্থাৎ কণাগুলোর স্থলে যদি প্রতিকণা স্থাপন করা যায় এবং তার দর্পণ প্রতিবিম্ব নেওয়া হয় আর সময়ের অভিমুখ বিপরীতমুখী করা হয় তাহলে মহাবিশ্বের আচরণ একই রকম থাকবে । কিন্তু ক্রোনিন এবং ফিচ্ প্রমাণ করেন যে কণাগুলোর স্থলে যদি প্রতিকণা স্থাপন করা যায় এবং এটা যদি দর্পণ প্রতিবিম্বের রুপ গ্রহণ করে কিন্তু সময়ের অভিমুখ বিপরীতমুখী না হয় তাহলে মহাবিশ্বের আচরণ অভিন্ন হবে না । তাই সময়ের অভিমুখ বিপরীত হলে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী । তাই T প্রতিসাম্য মেনে চলে না ।
Big Bang শুরু একটি বিন্দু হতে এবং সময় বাড়ার সাথে সাথে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে থাকে T প্রতিসাম্য মহাবিশ্ব মেনে চলে না যদি সময় কে আবার পিছনের দিকে চালনা করা হয় তাহলে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হবে কিন্তু এমন একাধিক বল আছে যারা T প্রতিসাম্য মেনে চলে না , সেজন্য মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গেই এই বলগুলো যে সংখ্যায় ইলেকট্রনগুলো প্রতিকোয়ার্কে রুপান্তরিত হয় তার তুলনায় অনেক বেশি প্রতিইলেকট্রন কে কোয়ার্কে রুপান্তর করবে । তারপর যখন মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের পর শীতল হবে তখন প্রতিকোয়ার্ক , কোয়ার্কের সাথে ধ্বংস হবে কিন্তু কোয়ার্কের সংখ্যা প্রতিকোয়ার্ক হতে বেশি তাই কিছু পরিমাণ কোয়ার্ক অবশিষ্ট থাকবে আর তাই দিয়েই আমাদের এই মহাবিশ্ব এবং আমরা গঠিত হয়েছি । আর এই কারনেই মনে করা হয় মহাশূন্যে কণার তুলনায় প্রতিকণার পরিমাণ বেশি ।
সূত্র:
১.CP-Violation উইকি
২. A Briefer History of Time by Stephen Hawking
Leave a Reply