এমন ঘটনা বার বার আসে না। গত আটবছর আগে সে এসেছিলো। আবার আসবে শতাধিক বছর পর।
আগামী ৫/৬ জুনে পৃথিবী সেই জায়গাতে অবস্থান নেবে ওই ঘটনা দেখার জন্য। কোন ঘটনা? শুক্র গ্রহের ট্রানজিট। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই দুর্লভ ঘটনা ২১১৭ সালে আবার দেখা যাবে — তার মানে পর্যবেক্ষণের জন্য এইবারই শেষ সুযোগ আমাদের। চলুন জেনে নেয়া যাক বিরল ট্রানজিট সম্পর্কে।
ট্রানজিট কি?
শুক্রের কক্ষপথ পৃথিবীর চাইতে ছোট – কারণ সে সূর্যের অনেক কাছে। তার ২২৫ দিনে একবছর। তারমানে ২২৫ দিনে সে সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসে। সে হিসেবে বছরে অন্তত একবার শুক্রগ্রহ সূর্য আর পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে আসার কথা। সূর্যগ্রহণে যেমন হয়, চাঁদ সূর্য আর পৃথিবীর মাঝামাঝি চলে আসে। তেমনই শুক্রগ্রহ পৃথিবী আর সূর্যের মাঝামাঝি চলে আসে – কিন্তু সে যেহেতু চাঁদের তুলনায় পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, তার ছায়া সূর্যকে ঢাকতে পারে না। তাই এই ঘটনাটাকে শুক্র–গ্রহণ বলা হয় না। বলা হয় ট্রানজিট। এসময় সূর্যের গায়ে কালো বিন্দুর মতো শুক্রকে দেখা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন প্রতিবছর এই ট্রানজিট হয় না? আসলে পৃথিবী আর শুক্রের কক্ষপথ ঠিক একই তলে নয়। শুক্রগ্রহের কক্ষপথ পৃথিবীর সাপেক্ষে প্রায় ৩ ডিগ্রি বাঁকা। তাই প্রতিবছরই সূর্য, শুক্র আর পৃথিবী এক
সরলরেখায় আসতে আসতেও আসে না – কাছাকাছি এসেই পালিয়ে যায় আবার। ব্যতিক্রম ঘটলেই সৌরজগতে এই দূর্লভ ঘটনা ঘটে, ট্রানজিটের কুশীলবেরা এক সরলরেখায় আসেন।
এই জ্যামিতি একটা মজার নিয়ম মেনে চলে। ৮ বছর পর পর দুইটি ট্রানজিট পর পর হয়। পরবর্তী জোড়া ট্রানজিট ঘটে শতাধিক বছরের দুরত্বে। সর্বশেষ এরকম জোড়া ঘটেছিলো ১৮৭৪/১৮৮২ সালে। আমরা অপেক্ষা করছি ২০০৪/২০১২ সালের জোড়ার জন্য। পরের জোড়া আসবে ২১১৭/২১২৫ সালে! পারমাণবিক যুদ্ধ কিংবা পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে যদি বিলুপ্ত না হয়ে যাই, তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সভ্যতা ওই ঘটনা পর্যবেক্ষন করবে।
২০০৪ সালের ট্রানজিট দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। তখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি, অনুসন্ধিৎসু চক্র (সংক্ষেপে অচ) মুগদা শাখার সদস্য। অচ আয়োজন করেছিলো এই ট্রানজিট পর্যবেক্ষণ ক্যাম্পের। কমলাপুরে অবস্থিত মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ছিলো আমাদের ক্যাম্প। সাধারণ মানুষকে দেখানো ব্যবস্থা ছিলো। একটি সৌর ফিল্টার ব্যবহার করে কোন বিবর্ধন ছাড়াই শুক্রকে সূর্যের গায়ে একটি কালো বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছিলো।
ইতিহাসে এই ট্রানজিট ব্যবহার করে সৌরজগতের আকার মাপা হয়েছিলো। ১৬০০ সালের দিকে গ্রহগুলোর দূরত্ব মাপা হতো সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে একক ধরে নিয়ে। সে হিসেবে শুক্রের দূরত্ব ছিলো ০.৭ একক, আর বৃহস্পতি ছিলো ৫ এককের মতো। কিন্তু সূর্য থেকে পৃথিবীর কক্ষপথের দৈর্ঘ্য যে আসলে কতো, সেটা জানা ছিলো না!
এই আধুনিক যুগেও বিজ্ঞানীরা ট্রানজিটকে অনুসন্ধানের কাজে ব্যবহার করবেন। ধরা যাক আমরা খুঁজতে চাই সৌরজগতের বাইরে অন্য কোন তারার কোন নিজস্ব গ্রহ আছে কি না। এখন তার যদি কোন গ্রহ থাকে, তাহলে সে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের টেলিস্কোপ আর তারার মাঝে চলে আসবে। তখন তারার থেকে আসা আলোর তীব্রতা একটু হলেও কমে যাবে। এই পদ্ধতিকে আরো নিখুঁত করার জন্য হাবল টেলিস্কোপ চাঁদের আলোর উপর ট্রানজিটের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে। আমরা জানি যে চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই, সূর্যের আলোকেই সে প্রতিফলিত করে। শুক্রের ট্রানজিট চাঁদের এই আলো ধার করার পরিমাণ কমিয়ে দেবে। তাই চাঁদ একটু হলেও অনুজ্জ্বল হবে। এর সাথে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো বিজ্ঞানীরা শুক্রের আবহাওয়া সম্পর্কেও ধারণা পেতে চাচ্ছেন। অসাধারণ, তাই না?
আরো কিছু তথ্য জানা যাক। ট্রানজিট যে কেবল সূর্যের সাথে পৃথিবীরই মধ্যেই হবে এমন কোন কথা নেই। এ বছর ডিসেম্বর মাসে শুক্র শনি এবং সূর্যের মধ্য দিয়ে যাবে। ক্যাসিনির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাটা দেখতে চান। হাবল হয়তো আগামী ২০১৪ সালে বৃহস্পতি আর সূর্যের মধ্য থেকে পৃথিবীর ট্রানজিটকেও পর্যবেক্ষণ করবে! দেখবে, সূর্য আর বৃহস্পতি গ্রহের মধ্য দিয়ে পৃথিবী চলে গেলে কি হয় আসলে!
ট্রানজিট খালি চোখে দেখা নিরাপদ নয়, সৌর–ফিল্টার ব্যবহার করতে হবে। ট্রানজিট দেখবেন কিভাবে, এ নিয়ে শীঘ্রই একটি পোস্ট আসছে বিজ্ঞান ব্লগে। এছাড়া যোগাযোগ করতে পারেন অনুসন্ধিৎসু চক্রের সাথেও।
এই লেখাটি আমার না। মূল লেখা এখানে। আমি কেবল ভাষান্তর করেছি।