কুকুরের সাথে মানব সহচর্যের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এ ইতিহাস কৃত্রিম নির্বাচনের। আজ থেকে

বহুশতাব্দী আগে কুকুর বলে কোন প্রাণী ছিলো না। আসলে বর্তমান কুকুরেরাএকটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে অনেক আগে আদিম নেকড়ে থেকে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের প্রক্রিয়াটা এরকম ধরা হয় – আদিম মানুষের শিকার স্থান আর বসতির আশেপাশে খাবার উচ্ছিষ্টের লোভে একদল নেকড়ে ঘোরাফেরা করতো। ওদের মধ্যে কেউ কেউ খানিকটা মানুষের সঙ্গলিপ্সু হয়ে ওঠে সহজ খাবার আর নিরাপত্তার লোভে। মানুষ দেখলো এদেরকে সাথে নিলে শিকারেও সুবিধা, আবার রাতে বিভিন্ন বিপদ সম্পর্কে ওরা সচেতনও করে দিতে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মানুষ ঠিক সেই সব নেকড়েদেরকেই নির্বাচিত করতো – যারা একটু কমবেশী পোষ মানানো, তেমন আক্রমণাত্মক নয়।
ঠিক কখন কিভাবে নেকড়ে থেকে কুকুরেরা আলাদা হয়ে গেলে এ নিয়ে জীববিজ্ঞানীদের মাঝে খুঁটিনাটি অনেক বিতর্ক আছে।

কিভাবে একদল নেকড়েরা আমাদের পোষমানানো দাঁতালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে এই প্রক্রিয়া বোঝার জন্য দিমিত্রি বেলায়েভকে ধরা যেতে পারে সবচাইতে সম্মানিত বিজ্ঞানী। অবশ্য বেলায়েভ কিন্তু কুকুর কিংবা নেকড়ে নিয়ে কাজ করেন নি। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন শেয়াল নিয়ে। কিন্তু, কিভাবে কুকুরেরা পোষা–সঙ্গী হলো এই প্রশ্নে শেয়াল আমাদের কি উত্তর দিতে পারে?
পোষা প্রাণীদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় – দেহের আকার, পশমের রঙ, প্রজননের সময় ইত্যাদির পরিবর্তন। দেহপশম একটু ঢেউ খেলানো হয়ে যায়, কান ঝুলে পড়ে আর লেজ হয়ে যায় ছোট বা বাঁকানো। বিশেষ করে পোষা কুকুরের ঝুলে পড়া কানের বৈশিষ্ট্য বুনো জন্তুর মধ্যে কেবল হাতি ছাড়া অন্য কারো মাঝে দেখা যায় না। এমন কি এসব দৈহিক পরিবর্তন ছাড়াও আচরণেও নানা রকম পরিবর্তন চোখে পড়ে পোষ মানা জন্তুদের মধ্যে। মানুষের সাথে খেলতে–ঘুরতে পোষা–কুকুরের ভীষণ আগ্রহ সবাই খেয়াল করবেন।
বেলায়েভ সহ অন্যান্য সোভিয়েত জীববিজ্ঞানীরা পোষ মানা কুকুরের মাঝে জটিল ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন। তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না ঠিক কোন পদ্ধতির মাধ্যমে নেকড়ে থেকে কুকুরের দৈহিক গঠন, শারীরতত্ত্ব আর আচরণ পরিবর্তন হয়েছে। তারা অন্তুত এটুকু উপলদ্ধি করতে পারছিলেন যে এর উত্তর লুকিয়ে আছে মেন্ডেলের সূত্রের মধ্যে। আমরা জানি, মেন্ডেলের তত্ত্ব হলো আধুনিক বংশগতিবিদ্যার মূলভিত্তি। কিন্তু তৎকালীন স্টালিন আমলের রাশিয়ায় এই ক্ষেত্রে লাইসেঙ্কোইজম ছিলো রাষ্ট্রীয় মতামত। তখন জীববিজ্ঞানীরা এইসব জেনেটিকাল প্রশ্ন অনুসন্ধানের জন্য গবেষণা করতে পারতেন না।
লাইসেঙ্কইজম সোভিয়েত বিজ্ঞান চর্চার এক কালো অধ্যায়। গত শতাব্দীর বিশের দশকে লাইসেঙ্কো নামের একজন কৃষিবিদ দাবী করেন তিনি চাষাবাদের নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তার দাবী অনুযায়ী এই পদ্ধতি ফলন তিন থেকে চারগুন বেড়ে যায়। তার তত্ত্বের মূল কথা হলো একটি প্রজন্মের অর্জিত গুনাবলী তার পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যায়। লাইসেঙ্কোর এই পদ্ধতির নাম ছিলো ভার্নালাইজেশন, যেটা নতুনও ছিলো না কিংবা তেমন উৎপাদনশীলও ছিলো না। যাই হোক, লাইসেঙ্কো খুব দ্রুত তৎকালীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে উপরের দিকে উঠে যান। সমসাময়িক জীববিজ্ঞানে বংশগতি নিয়ে কাজ হচ্ছিলো ফলের মাছির উপর। ফলের মাছি নিয়ে কাজ করে মর্গানের মতো বাঘাবাঘা বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে বংশগতি কিভাবে কাজ করে। কিন্তু লাইসেঙ্কো কমিউনিস্ট পার্টিতে তার অবস্থানগত ক্ষমতা ব্যবহার করে তৎকালীন সোভিয়েত বংশগতি–বিজ্ঞানীদের দমিয়ে রাখেন।

লাইসেঙ্কোইজম ছিলো একটি অপবিজ্ঞান। এটা সরাসরি ধ্রুপদী মেন্ডেলিয়ান বংশগতিবিদ্যার বিপরীত ছিলো। মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্স অনুযায়ী বংশগতির একক হলো জিন। জীবের অর্জিত অভিজ্ঞতা/গুণ বংশপরম্পরায় ছড়ায় না। লাইসেঙ্কোইজম বরং বহুআগেই পরিত্যাক্ত ল্যামার্কীয় মতামতের সাথে মিলে যায়। কিন্তু তৎকালীন বংশগতিবিদ্যার ধীর উন্নতি কমিউনিস্ট পার্টির মাথাদের প্রভাবিত করতে পারে নি যে বংশগতিবিদ্যার মৌলিক গবেষণা তাদের বিপ্লবে আশু কোন কাজে লাগবে। তাছাড়া সমসাময়িক জার্মানীর নাৎসীরা বংশগতির মোড়কে ইউজেনিক্স নামের আরেক অপবিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যে জার্মান আর্যরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি! সুতরাং সোভিয়েত কমিউনিস্টরা বংশগতিকে চিহ্নিত করে ‘ফ্যাসিবাদী বিজ্ঞান‘ হিসেবে। গত শতাব্দীর ত্রিশ শতকে কমিউনিস্টরা অনেক বংশগতি–বিজ্ঞানীকে লেবার ক্যাম্পে শাস্তি দেয়। ১৯৪৮ সালে বংশগতিবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেয়া হয় একটি ‘অপবিজ্ঞান‘ হিসেবে। তাই তখনকার সকল বংশগতি–বিজ্ঞানী তাদের চাকরী হারান।
বেলায়েভ কাজ করতেন মস্কোর একটি গবেষণাগারে, পশমী–প্রাণী প্রজননকেন্দ্রে। এই রকম রাজনৈতিক অবস্থায় বেলায়েভও তাঁর চাকরী হারান – তিনি ধ্রুপদী জেনেটিক্স নিয়ে কাজ করতেন বলে। চাকরী হারানোর পরেও বেলায়েভ বিচ্ছিন্নভাবে জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। ১৯৫৯ সালে ক্রুস্কভ ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানবিষয়ক নীতিমালাগুলো বদলান। তখনকার পটপরিবর্তনের সাথে সাথে বেলায়েভও রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সে সাইটোলজী এন্ড জেনেটিক্স ইন্সটিটিউটে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।
বুনো প্রাণীদের সাথে তুলনা করলে পোষা প্রাণীদের দেহগাঠনিক ও শারীবৃত্তীয় বিভিন্নতা আমরা খেয়াল করি। বেলায়েভ মনে করতেন এই ভিন্নতার উদ্ভব আসলে বুনো প্রাণীদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ক্রমাগত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, উগ্র বুনো প্রাণী থেকে একটু নিরীহ প্রকৃতির প্রাণীকে নির্বাচন করাটাই হলো মূল সূত্র। এটাই ছিলো বেলায়েভের অনুকল্প বা হাইপোথিসিস।

উগ্র বুনো প্রাণীর বিপরীতে একটু শান্ত প্রাণীদের কৃত্রিম ভাবে ক্রমাগত নির্বাচিত করতে থাকলে তাদের হরমোন এবং ও বিভিন্ন নিউরো–রাসায়নিক পরিবর্তন হয় কি না এটা ছিলো বেলায়েভের অন্যতম কৌতুহলের বিষয়। প্রাণীদের আচরণের পেছনে রয়েছে এসব জৈবরাসায়নিক উপাদান ও প্রক্রিয়া। এসব হরমোন ও নিউরোরাসায়নিক পরিবর্তন অন্যান্য দেহগাঠনিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটায় কি না এটা দেখতে চান বেলায়েভ। তাই বুনো শেয়ালদের পোষ মানানোর প্রচেষ্টা করে দেখতে চাচ্ছিলেন যে আসলেই কৃত্রিম নির্বাচন পোষা প্রাণীদের মধ্য এসব আচরণগত, শারীরবৃত্তীয় ও দেহগাঠনিক পরিবর্তন বয়ে আনে কি না। তিনি বেছে নেন বুনো রূপালী খেঁকশিয়াল এবং তাদের প্রতিপালন করতে থাকেন। প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা সুনির্দিষ্ট নির্বাচন নীতি ছিলো তাঁর, সেটা হলো অন্ত:স্থ শান্ত স্বভাব।
বাচ্চা শেয়ালদের প্রতি এক মাস অন্তর অন্তর একটি সুনির্দিষ্ট পরীক্ষায় প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হতো। পরীক্ষাকারীরা বাচ্চা শেয়ালদের খাবারের লোভ দিয়ে পোষ মানানো ও শরীর ধরার করার চেষ্টা করতেন। এছাড়া লক্ষ্য করার হতো যে ওই শেয়ালরা অন্য শেয়ালদের সাথে ঘুরতে পছন্দ করে নাকি মানুষের সহচর্য পছন্দ করা হয়। যখন এই বাচ্চা শেয়ালরা প্রজনন সক্ষম হয়ে ওঠে, তখন তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা করা হতো। তারপর সব মিলিয়ে তাদের শান্ত স্বভাবের জন্য একটি তুলনামূলক নাম্বার দেয়া হতো। অন্য শেয়ালের সামনে কোন শেয়াল পরীক্ষাকারীর দিকে যায় কি না; এবং তাকে ধরার চেষ্টা করলে পরীক্ষাকারীকে কামড় দেয় কি না এর ভিত্তিতে নাম্বার দেয়া হতো। শুধুমাত্র যেসব শেয়াল সবচাইতে কম উগ্র ও কম ভীতিকর, তাদেরকেই নির্বাচিত করা হতো পরবর্তীত প্রজন্মে প্রজননের জন্য। প্রতি প্রজন্মে ২০ শতাংশের কম শেয়ালকে প্রজনন করার সুযোগ দেয়া হতো। একই পদ্ধতিতে বেলায়েভ আরেকদল শেয়ালকে নির্বাচিত করতে থাকেন যাদের প্রকৃতি এর বিপরীত, যারা কি না সবচাইতে বেশি ভীতিকর ও উগ্র। এই ‘শান্ত স্বভাব‘ বংশগতি থেকে উৎপন্ন হচ্ছে কি না নিশ্চিত করার জন্য কোন শেয়ালকেই ট্রেনিঙ দেয়া হতো না। তাদের মানুষ থেকে দূরে রাখা হতো। শুধুমাত্র পরীক্ষা–নিরীক্ষা আর যত্ন নেয়ার সময় মানুষের সহচর্য পেত এই শেয়ালরা। এই সময়টা রাখা হতো কম।
এই প্রজননকর্ম ৪০টিরো বেশি প্রজন্ম ধরে চালানো হয়। এর ফলে উদ্ভব হয় এক দল বন্ধুত্বপূর্ণ পোষা শেয়ালের! এই পোষা শেয়ালের আচরণ তো বটেই, শারীরবৃত্তীক ও দেহগাঠনিক পরিবর্তনও দেখা যায়। এই পোষা শেয়ালগুলো মানুষের সাথে ঘুরতে পছন্দ করে, মানুষের মনোযোগ নেয়ার জন্য নানা চেষ্টা করে, তাদের পরিচর্যাকারীদের গায়ে গা লাগায়, গা চেটে দেয়। এই পোষা শেয়ালগুলো যখন খুশী বা উত্তেজিত থাকে – তাদের লেজ নাড়ায়। তাছাড়া নতুন মানুষদের দেখলেও তারা আগের মত ভয় পায় না। অনেক পোষা শেয়ালের কান দেখা যায় ঝোলানো, কারো লেজ বাঁকানো আর ছোট। অনেকের পশমের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়; পরিবর্তন হয় তাদের মাথার খুলি, দাঁত আর চোয়ালের গঠন। তাছাড়া তারা বুনো খেয়াল সুলভ ‘গন্ধ‘-ও হারিয়ে ফেলে। এই শারীরবৃত্তীক ও দেহগাঠনিক বৈশিষ্ট্যগুল সাধারণত বুনো শেয়ালদের মধ্যে দেখা যায় না। এই পরীক্ষাটি কৃত্রিম নির্বাচনের। আর কৃত্রিম নির্বাচনের শর্তটি খুবই স্পষ্ট – এই শেয়ালগুলো কি মানুষকে দেখলে পালায়, গর্জন করে বা কামড়ানোর চেষ্টা করে? নাকি তারা মানুষের দিকে এগিয়ে আসে, মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করে?

পোষ মানানো শেয়ালের রক্তে এড্রেনালিন হরমোনের পরিমাণ বুনোশেয়ালের তুলনায় অনেক কম। এই হরমোনটি সাধারণত বিপদাক্রান্ত অবস্থায় বেড়ে যায়; প্রাণীকে ‘লাড়াই করো অথবা পালাও’ এই প্রতিরক্ষাব্যাবস্থায় উত্তেজিত করে। পোষ মানানো শেয়ালের পশমের ভিন্নতার পেছনে মেলানিনের পরিবর্তন কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়। এই মেলানিন কণা উৎপাদনের যে জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া-পথ সাথে (মেটাবলিক পাথওয়ে) এড্রেনালিন তৈরির বিক্রিয়া-পথের কিছু কিছু সাধারণ অংশ আছে। পোষ মানানোর প্রক্রিয়াতে কুকুরের দেহে কিভাবে নেকড়ের পশম থেকে একেবারে ভিন্ন পশম তৈরি হলো? আপাতভাবে ভিন্ন এই দুইটি বৈশিষ্ট্যের পেছনে সাধারণ জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া একটি ব্যাখ্যা দেয় এই প্রশ্নের।
বেলায়েভের এই শেয়ালগুলোকে রাশিয়ায় এখন বিক্রি করা হয় পোষার জন্য!
মূল প্রবন্ধ:
Man’s new best friend? A forgotten Russian experiment in fox domestication
অন্যান্য তথ্যসূত্র:
এক কথায় ভালো লেগেছে…তবে আমার শিরোনামটা খুব পছন্দ হইছে।
শিরোনাম দেয়া অন্যতম কঠিন একটা কাজ … ধন্যবাদ … 🙂
আরাফাত, ভাল লাগল। এর মধ্যে এখানকার National Public Radio’তে দুটো প্রোগ্রামে এই সম্বন্ধে শুনলাম।
http://www.npr.org/2012/03/18/148758624/domesticated-foxes-mans-new-best-friend
দীপেনদা
ধন্যবাদ দীপেনদা 🙂
আরাফাত ভাই, আপনার এই লেখাটি এতদিন চোখে পড়ে নি। অনেক ভালো লাগলো।
থ্যাঙ্কস, মোর্শেদ 🙂