মনভূবনের দুই বাসিন্দা – দ্বিতীয় কিস্তি

[পূর্বের পোস্ট পড়ুন: মনভূবনের দুই বাসিন্দা – প্রথম কিস্তি]

 

দ্বন্দ্ব ও বিভ্রম

এতক্ষণ আমরা মনের দুই বাসিন্দার সাথে পরিচিত হলাম। জগ্রত অবস্থায় দুইটি ব্যাবস্থাই সক্রিয় থাকে। ব্যাবস্থা ১ নিজে নিজেই কাজ করে। আর ব্যাবস্থা ২ একটু গদাইলস্করী চালে চলতে থাকে। মানে, ব্যাবস্থা ২ সবচাইতে কম খাটতে চায় – সে আরামপ্রিয়। সাধারণ অবস্থায় ব্যাবস্থা ২ তার উদ্যমশক্তির খুব সামান্যই কাজে লাগায়। ওদিকে ব্যাবস্থা ১ ক্রমাগত ব্যাবস্থা ২কে বিভিন্ন মতামত দিয়ে চলছে। চারপাশের ঘটনার ছাপ, অন্তর্দৃষ্টি, প্রবৃত্তি এবং নানান রঙের অনুভূতি – এসব তথ্য থেকে এই সব মতামত দিচ্ছে সে। ব্যাবস্থা ২ এসব মতামত গ্রহণ করলে তা বিশ্বাস কিংবা আচরণে পরিণত হয়। যখন সবকিছুই নিয়মমাফিক চলছে বলে মনে হচ্ছে, তখন ব্যাবস্থা ২ এসব মতামত সামান্য পরিবর্তন করে বা কোন পরিবর্তন ছাড়াই গ্রহণ করে। সাধারণত আপনি আপনার ইচ্ছামাফিকই কাজ করেন; চারপাশের ঘটনা ও মানুষজন যেসব ছাপ ফেলে আপনার মনে সেগুলোকেই বিশ্বাস করে বসেন।  এটা সাধারণত দোষের কিছু না।

যখন ব্যাবস্থা ১ কোন ঝামেলার মধ্যে পড়ে যায়, সে ব্যাবস্থা ২কে ডাক দেয়া। ব্যাবস্থা ২ ঘটনার আরো বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ আর নানারূপ প্রক্রিয়াজাত করে ব্যাবস্থা ১কে সাহায্য করতে আসে। কোন সমস্যার সমাধান যখন ব্যাবস্থা ১ দিতে পারে না, ব্যাবস্থা ২ তখন জড়তা কেটে কাজে নেমে পড়ে। একটু আগে আপনার কি মনে আছে ১৭ × ২৪ এর গুণসমস্যার কথা? আপনি কি তখন কোন সচেতন মনোযোগ অনুভব করেছিলেন? চারপাশের পরিবেশপরিস্থিতি কেমন হবে, মানুষজন কেমন আচরণ করবে এইসব নানা বিষয়ের একটা মডেল তৈরি করে ব্যাবস্থা ১। যখন এই মডেলবহির্ভূত কোন ঘটনা ঘটে; কিংবা যখন এই মডেলটাই ভেঙে যায় (আরো খারাপ ঘটনা) – তখন ব্যাবস্থা ২ সক্রিয় হয়ে যায় পুরোদমে। ব্যাবস্থা ১ এর মডেলে বিড়াল ঘেউ ঘেউ করে না, গরিলা বাস্কেটবল কোর্ট দিয়ে হাঁটে না। গরিলা পরীক্ষণটি আরো প্রমাণ করে যে, মডেল ভেঙে যাওয়ার মতো বিস্ময়কর ঘটনা খেয়াল করতে আসলে কিছু মনোযোগ লাগে। মডেল ভেঙে যাওয়ার বিশ্ময়ে আমরা হতবাক হয়ে আরো ভালোভাবে ঘটনাটা যাচাই করি আমরা।পাশাপাশি ওই ঘটনাটার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক চালু হয়ে যায়। ব্যাবস্থা ২ আমাদের নিজেদের আচরণও খেয়াল করে। যে কারণে প্রচন্ড রাগের মাথায়ও আমরা শান্ত থাকার চেষ্টা করি। ব্যাবস্থা ২ নিজে ভুল করতে পারে, পাশাপাশি নিজেকে নিজের ভুল সম্পর্কে সতর্কও সে করে দেয়।

 

দ্বন্দ্ব

ব্যাবস্থা ১ ও ২ এর মধ্যে শ্রমবিভাজন খুবই সুচারু। এই শ্রমবিভাজনের লক্ষ্য – কম শ্রম দিয়ে কিভাবে সবচাইতে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে এই দুইটি ব্যবস্থার মধ্যে তৈরি হতে পারে দ্বন্দ্ব। তৈরি হতে পারে বিভ্রম। নিচের তালিকাটা একটা মানসিক পরীক্ষন। এখানে দুইটি ব্যাবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির একটা উদাহরণ পাওয়া যাবে। নিয়ম হলো, প্রথমে সব কলামে প্রতিটি শব্দ দেখে বলতে হবে বড়না ছোট। অনুরূপভাবে আবার প্রথম থেকে শব্দগুলো দেখে বলতে হবে কোনটা বামে‘, কোনটা ডানেআছে। নিজে নিজে পরীক্ষাটা করুন। দুটি কলাম আলাদা আলাদা করে পড়বেন।

পরীক্ষাটি করেছেন? বেশিরভাগ শব্দই আপনি হয়তো ঠিক ভাবে বলতে পেরেছেন – বাম/ডান অথবা বড়/ছোট। কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় আপনি ভুল বলেছেন – বা আটকে গেছেন। প্রথম ধাপে আপনি সব শব্দগুলোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন বড়/ছোট বলতে। পরের বার যখন একই শব্দকে ডান/বাম নামে ডাকতে হচ্ছে – তখন সমস্যা হয়েছে বেশি। আপনি এসময় যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন তা হলো দুইটি ব্যাবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্বের উদাহরণ। এই দ্বন্দ্বের উদ্ভব ব্যাবস্থা ১ এর নিজস্ব প্রতিক্রিয়া আর ব্যাবস্থা ২ এর ঠিক করে বলার মধ্যকার দুই প্রবণতার মাঝে। কোন বিরক্তিকর বই (পাঠ্যবই অবশ্যই 🙁 ) পড়তে গিয়ে বারবার নিজেকে আবিষ্কার করছেন একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। ওই জায়গায় আপনি বারবার পড়েছেন, কিন্তু তার কোন পাঠ্যদ্ধার হয় নি। এটাও িকন্তু দুই ব্যাবস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফসল।

 

বিভ্রম

ব্যাবস্থা ১ স্বৈরতান্ত্রিক – নিজের খেয়ালে চলে। যুক্তি কিংবা পরিসংখ্যান তার কাছে বিবেচনাযোগ্য না। সাবধানী পাঠক হয়তো এখনো এই বক্তব্য মেনে নিতে প্রস্তুত নন। ব্যাবস্থা ১ এর স্বৈরতন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যাবে নিচের ছবিটা দেখলে। লাইনদুটি আপাত চোখে অসমান মনে হচ্ছে। নিচের লাইনটি উপরের তুলনায় বেশি লম্বা মনে হচ্ছে। অন্তত চোখ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ব্যাবস্থা ১ আমাদের এমন মতামতই দিচ্ছে। কিন্তু যদি একটা স্কেল দিয়ে লাইন দুটি মাপি তবে দেখবো উভয় লাইনের দৈর্ঘ্যই সমান। স্কেল দিয়ে মাপামাপির প্রক্রিয়া ব্যাবস্থা ২ এর অধীন। ব্যাবস্থা ২ অনুযায়ী আমরা জানি উভয় লাইন সমান। তবুও ব্যাবস্থা ১ অনুযায়ী নিচের লাইনকেই প্রস্থে বড় মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় একটাই, ব্যাবস্থা ১কে পাত্তা না দেয়া, বিশ্বাস না করা। এরকম সব বিভ্রমই কিন্তু দর্শনসংশ্লিষ্ট নয়। আমাদের বোঝার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও বিভ্রম কাজ করতে পারে।

মিউলার-লেয়ার বিভ্রম

 

এই লেখার শেষ টানবো একটি কাল্পনিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে:

 

  • কাহিনীটা কি আসলে? উনি হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন কেন?
  • ঘটনাটা উনার মধ্যে একটা ছাপ ফেলে। তবে সেই ছাপের একটা অংশ ছিলো বিভ্রম।
  • হুহ … বুঝেছি ঘটনা কি। এইটা আসলে ব্যাবস্থা ১এর প্রতিক্রিয়া। উনি দড়িকে সাপ ভেবে লাফ দিয়েছেন ভুলে
  • হুম। ব্যাবস্থা ২ ঘটনাটা বিশ্লেষণের আগেই আসলে ব্যাবস্থা ১ লাফ দেয়ার আদেশ দেয় …
  • ওহে ব্যাবস্থা ১, ধীরে বৎস, ধীরে। শান্ত হও, আর ব্যাবস্থা ২এর উপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দাও।
[এই সিরিজটা জিরো-টু-ইনফিনিটি পত্রিকার ডিসেম্বর ২০১২ সংখ্যার জন্য তৈরি।  ]

আরাফাত রহমান Avatar

মন্তব্য

  1. selfish gene Avatar
    selfish gene

    আরাফাত সাহেব লেখাটা কি আরো চালিয়ে যাবেন? পড়ে খুব মজা পাচ্ছি।

    1. আরাফাত Avatar

      মন ও মগজ নিয়ে লেখালেখি করবো … কিন্তু ঠিক এই টপিক নিয়ে লেখালেখি চলবে কি না বলতে পারছি না। আপনি ব্রেন নিয়ে যেসব লেখা লিখতে চাচ্ছিলেন, সেগুলার বিষয়বস্তু কি?

      1. selfish gene Avatar
        selfish gene

        ব্রেন এর গঠন,ব্রেন এর বিভিন্ন অংশের কাজ,ব্রেনের বিবর্তন,ব্রেনের রোগ বলতে গেলে ব্রেন নিয়ে একটা বিস্তর লেখা তৈরি করার ইচ্ছা আছে।

        1. আরাফাত রহমান Avatar

          লিখে ফেলেন … এই বিষয়ে আমারো কিছু লেখালেখির চিন্তা খেলা করছে … বাংলাতে কি এই বিষয়ের উপর কোন জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই আছে? না থাকলে হয়ে যাক??

  2. Saeed Anwar Anuj Avatar
    Saeed Anwar Anuj

    মন আর মস্তিষ্ক…
    মস্তিষ্ক আর মন…
    জমছে ভালই…
    অপেক্ষমাণ রহিলাম…

    1. আরাফাত রহমান Avatar

      থ্যাঙ্কস অনুজ। এই পোস্ট দুইটা মন নিয়েই — মস্তিস্কের কারবার নিয়ে পরে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে আছে। তবে এই সিরিজ আপাতত চলছে না … বইটা পড়ছি, খুবই ইন্টারেস্টিং!

  3. দীপেন ভট্টাচার্য Avatar

    আরাফাত – তোমার লেখার হাত দিন দিন আরো ভাল হচ্ছে। দীপেনদা

    1. আরাফাত রহমান Avatar

      অনেক ধন্যবাদ দীপেনদা 🙂

মন্তব্য লিখুন