ফুলের রং পাল্টে দেবার আগে আমার ছোট মামার কথা বলে নেই। আমার দেখা প্রথম বিজ্ঞানী হচ্ছেন আমার ছোট মামা। তার কাছ থেকেই শিখেছি কি করে ফুলের রং পাল্টে দিতে হয়। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় আমরা ছিলাম সেই বিজ্ঞানী মামার সার্বক্ষণিক এসিস্ট্যান্ট। সে সুবাদে তার কাছ থেকে শিখেছি হলুদ আর সাদা মেশানো ছিটছিট রঙের পাতাবাহার গাছের ডাল কেটে স্বচ্ছ কাঁচের বোতলে পানি ভরে রেখে দিলে কিভাবে শিকড় গজায়। আরও শিখেছি, ফাউন্টেন পেনের কালির দোয়াতে সাদা ফুলের দুবলা গাছ থেকে কী করে কালো ফুল ফোটাতে হয়। চিকন বাঁশের চটি দিয়ে বানিয়েছি বাতাসের দিক নির্দেশক যন্ত্র। ফিউজ হয়ে যাওয়া বাল্বের ভেতর কালি শেষ হয়ে যাওয়া বলপয়েন্ট কলম গলিয়ে পেপার ওয়েট বানিয়েছি। গুড়ো দুধের কৌটা দিয়ে পিন-হোল ক্যামেরা; খেলনা গাড়ি থেকে মোটর খুলে নিয়ে শোলা দিয়ে লঞ্চ বানিয়েছি। আরও মনে পড়ছে, সে সময় এক ধরনের খেলনা লঞ্চ পাওয়া যেত যেটা ছিল টিনের তৈরি একদম সত্যিকারী লঞ্চের মত; কেরোসিন তেল ভরে একটি সলতের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিলে ভটভট শব্দ করে পানিতে চলত। এখন আর ওরকম খেলনা লঞ্চ দেখি না। এখন নিশ্চয়ই আরও সুন্দর সুন্দর খেলনা পাওয়া যায়।
ছোট মামা আমাকে সেন্ট্রি বলে ডাকতো। সেন্ট্রি যে শুধু আমাকে ডাকতো তা না। গবেষণায় মগ্ন থাকলে সে তার সকল ভাগ্নে-ভাগ্নিদের এই নামে ডাকত। সেন্ট্রি বলে ডাকলেই বুঝতে পারতাম এখনি সে চমৎকার একটা কিছু একটা করতে যাচ্ছে, যেখানে আমাদের সাহায্য দরকার। মামার নানান রকম আবিষ্কার আর গবেষণার অদ্ভুত সব আইডিয়া দেখে দেখে আমার মাথায়ও আইডিয়া কিলবিল করতে লাগলো। সেই কিলবিল করা আইডিয়া নিয়ে একদিন আমি আমাদের বাসার ছাদের চিলেকোঠায় একটি বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেললাম।
ঠিক করেছি, আমার সেই সময়ের নিজে করা, অথবা করতে চাইতাম, কিন্তু তখন করতে পারি নাই, সেইসব এক্সপেরিমেন্ট গুলো লিখে রাখবো আজকের উৎসাহী ক্ষুদেবিজ্ঞানীদের জন্যে।
এক্সপেরিমেন্ট – ১
শিরোনাম: ফুলের রং পাল্টে দেয়া।
যা যা লাগবে:
১। দুটি বিকার (কাঁচের গ্লাস হলেও চলবে)
২। গ্লাসের উচ্চতার চেয়ে কিছুটা লম্বা ডাঁটা সহ ধবধবে সাদা গোলাপ অথবা যেকোনো সাদা ফুল
৩। ফুড কালার (মার কাছে চাইলেই পেয়ে যাবার কথা। ঘরে না থাকলে মুদি দোকানে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।)
৪। একটি ব্লেড, ছুরি অথবা কাঁচি।
কার্যবিবরণী:
দুটি ফুলেরই ডাঁটা তেরছা ভাবে কেটে ফেলতে হবে। তারপর বিকারে (গ্লাসেও হতে পারে, যেহেতু বৈজ্ঞানিক গবেষণা তাই বিকার বলছি!) যেকোনো ফুড কালার বেশি করে গুলে নিয়ে তাতে একটা ফুল রেখে দিতে হবে। আর বাকি ফুলটা রাখতে হবে সাধারণ পানিতে। তারপর অপেক্ষা। বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর দেখা যাবে, যে ফুলটি রঙিন পানিতে রাখা ছিল সেটি নিচের ছবির মত বিকারের পানির রঙ ধারণ করেছে। কিন্তু যে বিকারে রং ছিল না সেটির ফুলের রং সাদাই থাকবে।
এটাই ছিল আমার তখনকার গবেষণা। এটুকু করতে পেরেই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকতাম রঙ্গিন ফুলের দিকে। কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন। যেহেতু আমার অনেকগুলো অল্প বয়সের কাজিন আছে তাই আমি জানি, এখনকার ক্ষুদে বৈজ্ঞানিকরা এটুকুতে সন্তুষ্ট নয়। এসব তাদের কাছে পানি-ভাত খেলা। তারা জানতে চাইবে এটা কিভাবে হল। মেকানিজমটা কি? পানির রঙ কি করে ফুলের ভেতর এলো? আর এই এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে রঙ ছাড়া আরেকটা গ্লাসে ফুল রাখার দরকার কি ছিল? শুধু রঙ গোলানো বিকারে ফুল রাখলেই তো হত।
যারা ভেবেছ, এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর এই লেখাতেই পাওয়া যাবে, তাদের জন্যে দুঃসংবাদ। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাটাই আসল বৈজ্ঞানিকের কাজ। এটা নিজে নিজেই করতে হবে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বইয়ে অথবা ইন্টারনেটে ক্লু খোঁজা যেতে পারে – একটি উদ্ভিদে কিভাবে পানি পরিবাহন হয়। তারপর নিজেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে হবে কিভাবে এই এক্সপেরিমেন্টে পানির রঙ ফুলে পৌঁছালো। নিজের ব্যাখ্যাটি নিয়ে অন্যান্য ক্ষুদেবিজ্ঞানীদের সাথে আলাপ করা যেতে পারে। নিচে মন্তব্যের ঘর থেকে উৎসাহী কারো সাথে পরিচিত হয়ে নিজেদের মধ্যে ই-মেইল বিনিময় করে একসাথে পরামর্শ করে কাজ করা যেতে পারে। এমনও তো হতে পারে যে সত্যি সত্যি বিজ্ঞানী বা পি এইচ ডি স্টুডেন্ট যে কিনা নাম করা কোন গবেষণাগারে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বা অন্য কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছে তার সাথে এখানে একজন ক্ষুদেবিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় হয়ে গেল! তারপর, শুরু হয়ে গেল আরও নতুন নতুন গবেষণা প্রজেক্ট! কী দারুণ হবে তখন ব্যাপারটা!
[উপরে উল্লেখিত আমার সেই বিজ্ঞানী মামা কিছুদিন আগে বাবা হয়েছেন। মেয়ের নাম রেখেছেন আদৃতা। তার নিজের হাতে করা সেইসব এক্সপেরিমেন্টের প্রটোকল গুলোর একটি এই ব্লগে লেখা রইল। আদৃতা বড় হয়ে কোনদিন হয়ত গুগুলে কিছু একটা সার্চ করার সময় হঠাৎ করে লেখাটি খুঁজে পাবে!]লেখাটি আমার ব্যক্তিগত ব্লগে পূর্ব প্রকাশিত।
Leave a Reply