অনুবাদঃ
সাদিয়া মুসাররাত এবং খান তানজীদ ওসমান
আমাদের কথাঃ
১৯৫৩ সালে বিলেতি জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক তার ১২ বছর বয়সী সন্তান মাইকেল কে নিজেদের সাম্প্রতিক একটি অসাধারন আবিষ্কারের বর্ণনা দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন।
এই চিঠিতে ক্রিক এঁকেছেন এমন একটি গঠন, যা সম্ভবত এযাবৎকালে সবচেয়ে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক চিত্রকর্ম- DNA এর গঠন (যার জন্য ১৯৬২ সালে ক্রিক এবং অন্যন্যরা পেয়েছিলেন নোবেল পুরষ্কার)। উল্লেখ্য, ‘নেচার’ পত্রিকায় পাঠানোর আগেই DNA এর গঠনের বর্ণণা দিয়ে নিজের ১২ বছর বয়সী ছেলেকে চিঠিটি লিখেছিলেন ক্রিক। সেজন্য, DNA এর গঠনের বর্ণনা করা প্রথম কোনো লিখিত পত্র এটি এবং বিজ্ঞানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
গত ১০ ই এপ্রিল (২০১৩) মাইকেল ক্রিক (ছেলে) চিঠিটি অকশনে তুলেছিলেন নিউ ইয়কর্ে। একজন অজানা ক্রেতা কিনে নেন ৫.৩ মিলিয়ন মাকর্িন ডলারে; বাড়তি খরচসহ মোট খরচ আসে ৬ মিলিয়ন ডলার। অকশনে অর্জিত অধর্েক টাকা দান করা হবে সান ডিয়েগো, ক্যালিফোনর্িয়ায় অবস্থিত Salk Institute of BIological Studies এ, যেখানের প্রফেসর ছিলেন ফ্রান্সিস ক্রিক। অকশনের চিঠিটির দাম হারিয়ে দিয়েছে এর আগের রেকর্ড গড়া আব্রাহাম লিঙ্কনের একটি চিঠিকে যেটা বিক্রি হয়েছিল মোট ৩.৪ মিলিয়ন ডলারে।
মজার বিষয় হচ্ছে, নোবেল পুরস্কারের মেডেলটিও অকশনে উঠেছিল, কিন্তু সেটা এই চিঠির চেয়ে কম দামে বিক্রি হয়েছে (মাত্র ২.৩ মিলিয়ন ডলারে)। সে যাই হোক, পয়সা দিয়ে এই চিঠির মূল্য কখনই নিধর্ারন করা যায়না, বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ চিঠিগুলির একটি হলো এই হাতে লেখা চিঠিটি।
এখানে, ফ্রান্সিস ক্রিকের নিজহাতে লেখা চিঠিটির মূল ছবিসহ বঙ্গানুবাদ করা হলো। (দ্রষ্টব্যঃ ব্র্যাকেটের ভেতরে লেখাগুলি মূল লেখায় ছিলনা।)
চিঠিঃ
১৯ পর্তুগাল প্লেস কেমব্রিজ
১৯ মার্চ ‘৫৩
প্রিয় মাইকেল,
জিম ওয়াটসন এবং আমি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ আবিস্কারটি করেছি। আমরা ডিঅক্সি-রাইবো-নিউক্লিইক-এসিডের (নামটা লক্ষ্য কর, এটাকে ছোট করে বলে DNA) গঠনের একটি মডেল তৈরি করেছি। তোমার হয়তো মনে আছে আমাদের বংশগতি বহন করা ক্রোমোজমে (chromosome) জিনের (gene) কথা- যেগুলি DNA এবং প্রোটিন দিয়ে গঠিত।
আমাদের গঠনটি অদ্ভুত সুন্দর। DNA কে মোটামুটি চ্যাপ্টা পুঁতির লম্বা চেইন হিসেবে দেখতে পারো। চ্যাপ্টা পুঁতিগুলোকে বলে বেইস (base)। ফমর্ুলাটি মোটামুটি এইরকমঃ
এখন আমরা এরকম দুইটি চেইন পাই যারা একে অপরকে পেঁচিয়ে আছে- প্রতিটা একটা হেলিক্স (helix)- এবং চেইনের যে অংশ সুগার এবং ফসফরাস থাকে তারা হেলিক্সের বাইরের দিকে থাকে এবং বেইসগুলো ভেতরের দিকে থাকে। আমি খুব ভাল আঁকতে পারছিনা, কিন্তু এটি মোটের উপর এইরকমঃ
মডেলটা আসলে এরচেয়েও অনেক সুন্দর দেখতে।
এখন উত্তেজনাকর ব্যাপার হল, যেই চারটি বেইস আমরা খুঁজে পাই তারা একটি নিদর্িষ্ট বিন্যাসে জোড়া (pair) তৈরি করে। এই বেইসগুলোর নামও আছে- এডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন এবং সাইটোসিন। আমি এগুলিকে ডাকবো যথাক্রমে- A, G, T এবং C। এখন আমরা খুঁজে পেয়েছি যে একটি চেইনের একটি বেইসের সাথে আরেকটি চেইনের আরেকটি বেইসের মধ্যে জোড়াগুলি হয় এভাবেঃ
শুধুমাত্র A এর সাথে T এবং G এর সাথে C।
এখন পযর্ন্ত মনে হচ্ছে, (DNA দ্বিসূত্রক গঠনে) একটি চেইনের বেইসগুলি কোন নিদর্িষ্ট বিন্যাস মানেনা; কিন্তু একটি চেইনের বিন্যাস যদি অনড় (fixed) রাখা হয় তবে অন্য চেইনের বিন্যাসটিও অনড় হবে। মনে করি, প্রথম চেইন যদি গঠিত হয় এভাবে (তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হচ্ছে লেটারের বামপাশের চেইনটিকে) তবে দ্বিতীয় চেইনটা অবশ্যই এরকম হতে হবে (তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হচ্ছে লেটারের ডানপাশের চেইনটাকে)।
এটা একটি কোড (code) বা সূত্রের মত। তোমাকে যদি একটি সেটের অক্ষরগুলি দেয়া হয় তবে তুমি অন্যটির অক্ষরবিন্যাসও লিখতে পারবে।
এখন আমরা বিশ্বাস করি DNA হলো একধরনের কোড। বেইসের বিন্যাসে পার্থক্য একটি জিন (DNA) থেকে আরেকটি জিনকে পৃথক করে (যেমন একটা বইয়ের পাতার প্রিন্ট আরেকটা পাতা থেকে ভিন্ন হয়)। তুমি এখন দেখতে পাবে কিভাবে প্রকৃতি জিনের কপি বা প্রতিলিপি তৈরি করে। যেহেতু DNA চেইনগুলি পেঁচানো অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে দুইটি একক চেইন তৈরি করতে পারে, এবং প্রতিটি চেইন অন্য একটি (বিপরীত বেইস দিয়ে তৈরি, যেমন A এর জায়গায় T, G এর যায়গায় C) চেইনকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারে, সেহেতু, অবশ্যই A এর সাথে T এবং G এর সাথে C জোড় বাঁধার নিয়মের কারনে আমরা দুইটি DNA এর প্রতিলিপি পাবো (যেখানের প্রত্যেকটি নতুন DNA তে [দ্বিসূত্রক] একটি নতুন চেইন থাকবে এবং একটি মাতৃচেইন থাকবে)। যেমনঃ
অন্য কথায়, আমাদের মতে, আমরা এমন একটি মৌলিক প্রতিলিপি তৈরির পদ্ধতির সন্ধান পেয়েছি যা দিয়ে একটি জীবন থেকে আরেকটি জীবন তৈরি হয়। আমাদের মডেলটির সৌন্দযর্্য এই জায়গায় যে, মডেলটির আকৃতির কারনে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট জোড়গুলিই (বেইসের) একটির সঙ্গে আরেকটি বন্ধন তৈরি করবে; বেইসগুলি হয়তো অন্যভাবে জোড় তৈরি করতে পারতো যদি তারা স্বাধীনভাবে ভেসে বেড়াতো। আমরা যে খুবই উত্তেজিত সেটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝছো। আমাদের অবশ্যই দুই একদিনের মধ্যে একটি চিঠি ‘নেচার’ পত্রিকায় পাঠাতে হবে। খুব সতর্কতার সাথে এটা পড় যেন তুমি বুঝতে পারো। তুমি যখন বাসায় আসবে তোমাকে আমরা মডেলটি দেখাবো।
অনেক অনেক আদর,
বাবা।
Leave a Reply