সম্প্রতি গবেষকগণ ডিএনএ অণু ব্যবহার করে প্রায় ১০০ টির মত বিভিন্ন আকৃতির ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরি করেছেন।এই প্রযুক্তি উদ্ভাবণের ফলে ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে এবং জৈব প্রযুক্তির প্রয়োগে নতুনমাত্রা যোগ হবে বলে আশা করা যায়। তাছাড়া ডিএনএ ভিত্তিক তথ্য-প্রযুক্তির জগতেও এই উদ্ভাবন উল্ল্যেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
যেকোন কাঠামোর ভিত্তিহলো অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিট যাদের কম্বিনেশনে একটি কাঠামো তৈরি হয়। কোনবিল্ডিং তৈরি করতে হলে দরকার হয় অনেক ইটের বিশেষ সজ্জা। একটির পর একটি ইট পাশাপাশিবসে তৈরি করে বিশালাকার স্থাপত্য। একই ভাবে ডিএনএ অণুর একেকটি ইউনিটকে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে আমারা পেতে পারি নানা আকৃতির কাঠামো। এই ক্ষুদ্র একেকটি ইউনিটকে আমরা বলতে পারি ‘ডিএনএ ইট’।
সম্প্রতি এই বিষয়ের গবেষণাপত্রটি “সায়েন্স ম্যাগাজিনে (https://www.sciencemag.org/content/338/6111/1177.full)” প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণার সিনিয়র গবেষক PengYin এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নব্যগঠনকৃত ডিএনএ ইটগুলো একেকটি ডিএনএ স্ট্র্যান্ড থেকে বাছাইকৃত ভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি সজ্জিত হয়ে অনেক জটিল জটিল কাঠামো তৈরি করতে পারে।এই বৈশিষ্ট্য এরা অর্জন করেছে কৃত্রিমভাবে ডিজাইনকৃত নাইট্রোজেন বেসগুলোর সজ্জার কারনে।এই বৈশিষ্ট্যটিকে কাজে লাগিয়ে ন্যানোপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং মানবশরীরে প্রয়োগক্ষম বায়োম্যাশিনারী উদ্ভাবন করা সম্ভব।
ডিএনএ একটি দ্বি-সূত্রক অণু। দুইটি সুতার মধ্যে চারধরনের নাইট্রোজেন বেস থাকে যাদের দুইটির একেকটি জোড়ার মধ্যে হাইড্রোজন বন্ধন তৈরি করে এই দুইটি আণবিক সুতা পরস্পরের সাথে সমান্তরালে যুক্ত থাকে। ডিএনএর এই গঠনটিই দুনিয়ার যাবতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায়। তবে ডিএনএর একেকটি সুতা যদি দৈর্ঘ্যে বেশ ছোট হয় (যেমন ৩২ টি বেসের একেকটি সুতা) তাহলে এদের একটি সুতাকে অপর সুতা হতে বিচ্ছিন্ন করে শুধু সমান্তরালে নয় বরং প্রয়োজন মতো ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকিয়েও সুনির্দিষ্টভাবে সাজানো যায় এবংনাইট্রোজেন বেসগুলোর মধ্যকার আকর্ষণ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে স্থিতিশীল করা যায়। এই সজ্জাটিকে লেগো সেটের লেগোর সাথে তুলনা করা যায়। প্রতিটি লেগো যেমন একটির সাথে আরেকটি সমান্তরালেসজ্জিত হতে পারে তেমনি ৯০ ডিগ্রি কোণেও যুক্ত হতে পারে।
এই গবেষণাটি ইতিপূর্বেপ্রকাশিত আরেকটি গবেষণা থেকে অনুপ্রাণীত যেখানে ডিএনএ অণু ব্যবহার করে দ্বিমাত্রিকসজ্জা তৈরি করা হয়েছিল। পূর্বের গবেষকগণ ৩২টি নাইট্রোজেন জোড়া সংবলিত একেকটি ডিএনএঅণুকে ৯০ ডিগ্রি কোণে যুক্ত করে একটি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।বর্তমান প্রকাশকৃত গবেষণায় দ্বিমাত্রিক স্থানে ডিএনএর বাঁকের পাশাপাশি উপরের দিকেও ৯০ডিগ্রি কোণে যুক্ত করে ত্রিমাত্রিক গঠন দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ভাবেযুক্ত হতে সক্ষম ডিএনএর ক্ষুদ্র ইউনিট গুলোকে উপযুক্ত পরিবেশে ছেড়ে দিলে তারা নিজেরাই পরস্পরের সাথে যথাযথভাবে যুক্ত হয়ে ত্রিমাত্রিক আকৃতিগুলো তৈরি করে। ক্ষুদ্র ইটগুলো কিভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত হবে তা নির্ভর করবে তাদের মধ্যকার নাইট্রোজেন বেসগুলোর কম্বিনেশনের উপর এবং সেই কম্বিনেশনটি আগেই ঠিক করে দেওয়া। সেই কম্বিনেশন অনুযায়ী দেখা গেলো অনেকগুলো ইউনিটের একটি গ্রুপ হয়তো ইংরেজি নির্দিষ্ট কোনো অক্ষরের আদলে যুক্ত হচ্ছে আবার আরেকদল কোন সংখ্যা তৈরি করছে। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সজ্জিত হয়ে তারা শতাধিকবিভিন্ন আকৃতি গঠন করে।
এই উদ্ভাবণ DNA Origami approach এর একটি উল্ল্যেখযোগ্য অগ্রগতি। সম্প্রতি এইধরনের জটিল আকৃতি গঠনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ নরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্যহল বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগের উপর নিয়ণ্ত্রন প্রতিষ্ঠা। ন্যানোপ্রযুক্তিতে এই ধরনের জটিল আকৃতি তৈরি করার জন্য ইতিপূর্বে বিভিন্ন ধরনের পরিকাঠামো (scaffolding,ভবন নির্মানের সময় যেমন বাঁশ বা লোহার খুঁটি ব্যবহার করে ভবনের চারপাশে কাঠামো তৈরিকরা হয়) ব্যবহার করা হত যার মাধ্যমে অণুগুলো নির্দিষ্টস্থানে যুক্ত হয়ে জটিল কাঠামোতৈরি করত। কিন্তু নতুন এই গবেষণায় গবেষকগণ কোনো রকম পরিকাঠামো ব্যবহার ছাড়াই সুনির্দিষ্ট জটিল কাঠামো নির্মানে সাফল্য লাভ করেন।
(লেখাটি সম্প্রতি ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত)।
Leave a Reply