syringe floating near person s hand

রিজেনারেটিভ মেডিসিনঃ চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন দর্শন


লিখেছেন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

আজকালকার বিজ্ঞানীরা ল্যাবে বসে বসে মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি করে ফেলতে পারেন! শুধু তৈরি করেই ক্ষান্ত হন না, রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ কেটে ফেলে দিয়ে একদম ল্যাবফ্রেশ ওয়ার্কিং অংগটা শরীরে ফিট করে দেয়ার ক্ষমতাও রাখেন! কিন্তু অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা অরগ্যান ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট তো নতুন কিছু না, সেই হিন্দু পুরাণের গনেশের মাথা প্রতিস্থাপন অথবা ড্যামিয়ান আর কসমসের মিথ থেকে শুরু, তারপর থেকে আজ অবধি কত কিডনি, চোখ, হার্ট, লিভার-ই তো প্রতিস্থাপিত হল। তাহলে এটা নিয়ে লেখা ফেঁদে বসেছি কেন? কারণ আগের দিনের এসব ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করা হত দাতা বা ডোনারের কাছ থেকে অরগ্যান নিয়ে। কিন্তু রিজেনারেটিভ মেডিসিনে দাতা হচ্ছে স্বয়ং রোগী, যার কাছ থেকে কোষ নিয়ে বিজ্ঞানীরা তার প্রয়োজন অনুযায়ী অঙ্গ তৈরি করে দেবেন।

রিজেনারেটিভ মেডিসিন- নাম থেকেই অনেকখানি আন্দাজ করে ফেলা যায় যে এটা কী হতে পারে। মেডিসিনের সাহায্যে রিজেনারেট বা পুনরুৎপাদন করাকে রিজেনারেটিভ মেডিসিন বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হল কী পুনরায় উৎপাদন করা হবে? উত্তর- দেহের ক্ষতিগ্রস্ত কোষ, টিস্যু অথবা আস্ত অঙ্গ!

এতদিন পর্যন্ত আমরা যা দেখে এসেছি, তা হল কোন অঙ্গ কাজ না করলে অন্য কারো কাছ থেকে নিয়ে রিপ্লেস করে ফেলা। কারো কিডনিতে সমস্যা? ডোনার খোঁজো, ডোনারের কিডনি কেটে নিয়ে রোগীর শরীরে বসাও। কারো হার্টের ভালভে গন্ডগোল? মানুষের হার্টের ভালভ সহজলভ্য না, তাই শূকরের হার্টের ভালভ যোগাড় করে লাগিয়ে দাও!

The next frontier in health care: regenerative medicine | ParkRecord.com

রিজেনারেটিভ মেডিসিন আমাদেরকে সর্বপ্রথম বলল যে এভাবে অন্যেরটা আর কত নেবে? মানুষের নিজের শরীরেরই তো নতুন অঙ্গ আর কলা গঠনের সুপ্ত ক্ষমতা রয়েছে (না, না, এখানে অলটারনেটিভ মেডিসিনের কথা বলা হচ্ছে না)| স্টেম সেল (একটু পরেই বলছি এটা কী) নাও, সেটাকে প্রভাবিত/নিয়ন্ত্রন কর, ঠিকঠাক ভাবে সাহায্য করতে পারলে এই স্টেম সেলই তোমাকে তোমার দরকারি অঙ্গ গঠন করে দেবে in vitro (কৃত্রিম পরিবেশে, ল্যাবরেটরিতে) বা in vivo (লিভিং অর্গানিজম বা জীবিত জীবের ভেতরে, এক্ষেত্রে মানুষের শরীরের ভেতরে)|এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ বা টিস্যুকে সারিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের এ নতুন শাখা। বিজ্ঞানীরাও এই নতুন পদ্ধতিকে লুফে নিলেন প্রধানত তিনটা কারনে-


১. যেহেতু রোগীর নিজের শরীর থেকে কোষ নিয়ে এ অঙ্গগুলো তৈরি করা হয়, তাই ইমপ্ল্যান্টের পর অরগানটাকে রোগীর দেহের রিজেক্ট করার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
২. সহজলভ্যতা, এই প্রক্রিয়া অরগান ডোনারের স্বল্পতার সমস্যার একটা ভালো সমাধান! সার্জনেরা নিয়মিত দেখেন কীভাবে একজন ম্যাচিং ডোনারের অভাবে রোগী মারা যায়। এক্ষেত্রে এমন ডোনার খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা এমন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার সাহস পাই যেখানে “ডোনার লিস্ট” এর দরকার পড়বে না।
৩. বিভিন্ন ক্রনিক রোগের চিকিৎসায় রিজেনারেটিভ মেডিসিন অভূতপূর্ব ভুমিকা রাখতে পারে।

রিজেনারেটিভ মেডিসিন সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই স্টেম সেল সম্পর্কে ধারণাটা পরিষ্কার করতে হবে।
স্টেম সেল হচ্ছে এক ধরণের মাতৃকোষ যার দেহের যেকোন কোষে রুপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা থাকে অর্থাৎ এরা আনস্পেশালাইজড! এদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন স্পেশালাইজড সেলে (যেমন কার্ডিয়াক মাসল সেল, নিউরন, যকৃৎ কোষ, ইত্যাদি) পরিণত হতে পারে। এরা সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে; সংখ্যাবৃদ্ধি করে আরও অনেক স্টেম সেল যেমন গঠন করতে পারে (এটার জন্য একটা গালভরা শব্দ ব্যবহার করা হয় ‘প্রোলিফারেট’), তেমনি দেহের চাহিদামত প্রায় যেকোন কোষে পরিনত হতে পারে (এটার জন্য গালভরা শব্দটা হচ্ছে ‘ডিফারেনশিয়েট’ করা)| ভ্রূণ থেকে সংগ্রহ করা স্টেম সেল সব ধরণের কোষে রুপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা রাখলেও, মানবদেহ থেকে নেয়া স্টেম সেল কেবল নির্দিষ্ট
কিছু অঙ্গ গঠন করতে পারে।

টিস্যু বা অঙ্গ রিজেনারেট করার প্রক্রিয়াকে সহজ ভাবে বলা যায় বিজ্ঞানীরা চিনির অণু, প্রোটিন আর বিভিন্ন ফাইবারের মিশ্রণ তৈরি করে তা দ্বারা রোগীর দেহ থেকে সংগ্রহ করা স্টেম সেলকে পুনরুৎপাদনে সাহায্য করেন এবং উৎপাদিত কোষগুলোকে প্রকৌশলের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অংগের আকৃতি দেন।

বর্তমানে রিজেনারেটিভ মেডিসিন নিয়ে কাজ করছেন এমন বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য হল গবেষণার মাধ্যমে একে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেন ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসে যখন কোন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দরকার পড়বে না। ইতোমধ্যেই ল্যাবে তৈরি করা ব্ল্যাডার শরীরে নিয়ে দিব্যি কিছু মানুষ হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে! এছাড়াও সম্প্রতি জাপানে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যকৃৎ কোষ। কিডনি তৈরি করাও সম্ভব হয়েছে। স্কটল্যান্ডে কৃত্রিম রক্ত তৈরি করার অনুমোদন পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। হৃদরোগ, লিউকেমিয়া ও ব্রেস্ট ক্যান্সারে এই থেরাপি প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া গেছে। অদূর ভবিষ্যতে অগ্ন্যাশয়, হার্ট, নিউরন তথা মস্তিষ্কের মত অপেক্ষাকৃত জটিল অঙ্গ উৎপাদন করার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

যদিও এখন পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেছে স্বল্প সংখ্যক সার্জারি-ই, তবুও হাল ছাড়ছেন না কেউ। কেননা গবেষণা গুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ভবিষ্যতে এই রিজেনারেটিভ মেডিসিন যেসব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে,তার মাঝে প্রধান হচ্ছে ক্যান্সার, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস, সেরেব্রাল পালসি, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, ট্রমাটিক ব্রেইন ইনজুরি, শ্রবণশক্তি হ্রাস, হার্ট ফেইলিয়র, স্ট্রোক, বিভিন্ন চক্ষুরোগ, মাসকুলার ডিসট্রফি, পারকিনসনস ডিসিজ, রক্তবাহিকা পুনর্গঠন, গভীর ক্ষত সারিয়ে তোলা, ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখেন এক সময় মেডিসিনের এ শাখাকে এতটা উন্নত করা যাবে, যখন সুনিয়ন্ত্রিত ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে তৈরি করা স্টেম সেলকে দেহে ইনজেক্ট করেই রোগীর দেহে নতুন ও উন্নত কোষ, টিস্যু বা অঙ্গ উৎপাদন করে তাকে সুস্থ করে তোলা যাবে। কে জানে, হয়তো এই রিজেনারেটিভ মেডিসিনই হবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ!

লেখাটি 819-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
    সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

    ভালো লেগেছে! চালিয়ে যাও!

    1. Shaily Zarin Tasnim Avatar
      Shaily Zarin Tasnim

      সবাইকে অনেক ধন্যবাদ 🙂

    2. Shaily Zarin Tasnim Avatar
      Shaily Zarin Tasnim

      ধন্যবাদ মোর্শেদ ভাইয়া 🙂

  2. লেখাটা ভালো হয়েছে। বিষয়টা ইন্টারেস্টিঙ। নতুন কিছু তথ্য জানলাম। চালিয়ে যান।

    এই লিঙ্ক থেকে আপনার লেখক তথ্য যুক্ত করুন প্লিজ! http://www.bigganblog.com/wp-admin/profile.php

    1. Shaily Zarin Tasnim Avatar
      Shaily Zarin Tasnim

      তথ্য যোগ করা হয়েছে। বিষয়টা জানানোর জন্য ধন্যবাদ 🙂

  3. Antifungal Sharif Raihan Avatar
    Antifungal Sharif Raihan

    ভালো লেগেছে নতুন কিছু জেনে। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

    1. Shaily Zarin Tasnim Avatar
      Shaily Zarin Tasnim

      সময় নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ 🙂

  4. লেখাটা পড়ে ভাল লাগলো। রিজেনারেটিভ মেডিসিন আসলেই চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে। একটা সময় ছিল মানুষ চিন্তাও করতে পারত না কোন অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে সেটা আবার প্রতিস্থাপন করা যাবে। কিন্তু এর পরে বিজ্ঞানীরা সে কাজটাও করা শুরু করলো, সম্ভবত ১৯০৫ সালে প্রথম সফলভাবে চোখের কর্ণিয়া প্রতিস্থাপন করেন “Eduard Zirm”। কিন্তু এক জনের অঙ্গ অন্যজনের শরীরে স্থাপনের মাধ্যমে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে “হাইপারসেনসিটিভিটি রিএ্যাকশন” দেখা যেত ফলে সফলতার থেকে এর adverse effect বেশী চোখে পড়ত। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সঠিক অঙ্গ খুজে পাওয়া বা ম্যাচিং যেটাকে বলে। কিন্তু নতুন এই প্রযুক্তি অনেকাংশে সফলতা বয়ে আনবে। অবশেষে ধন্যবাদ জানাই এরকম নতুন প্রযুক্তি নিয়ে পরিচিতিমূলক লেখার জন্য।

    1. Shaily Zarin Tasnim Avatar
      Shaily Zarin Tasnim

      নতুন কিছু তথ্য জানলাম। আমরা যারা নতুন লিখছি এভাবে কমেন্টের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমাদের উৎসাহিত করবেন বলে আশা করছি 🙂

  5. প্রেইযওয়ারদি লেখা ।
    তুমি ব্লগ লেখো এটা জানতাম না ।
    জেনে ভালো লাগলো ।

    1. Shaily Zarin Tasnim Avatar
      Shaily Zarin Tasnim

      আমি ব্লগ লিখি না আসলে, এটাই আমার প্রথম লেখা।
      থ্যাংকিউ রওনাক 🙂

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading