(বলা হয় বিজ্ঞানকে তাড়া দেয়া যায়না। যদিও নিবন্ধ প্রকাশের প্রতিযোগিতা বা ফান্ডিং এর সুযোগ এই ব্যাপারটাকে ঠিক সাহায্য করেনা। কিন্তু কিছু কিছু বিজ্ঞানের পরীক্ষাকে চাইলেও তাড়া দেয়া যায়না। যেমন মানুষের জীবন-দৈর্ঘ্য নিয়ে গবেষণা বা মহাজাগতিক পরীক্ষা। এদের জন্য সময় দিতে হয়। এমনই দীর্ঘ সময় ধরে চলা কিছু পরীক্ষা নিয়ে এই সিরিজ। তৃতীয় পর্ব)
সর্বদাই সক্রিয় হলেও প্রতি কয়েক হাজার বছরে প্রচন্ড অগ্নুৎপাতে ফেটে পরে ভিসুভিয়াস পর্বত। ৭৯ খ্রীষ্টপূর্বে শেষবার যখন এটা ঘটেছিল তখন পম্পেই নগরীকে ঝলসে দিয়েছিল আগুনে; আর তারও আগে, ৩৮০০ বছর আগে এটা বর্তমান নেপলস শহরকে ধোঁয়া এবং গলিত পাথরে ঢেকে ফেলেছিল (সূত্র ২)। অগ্নুৎপাতের ফলে তৈরি মেঘকে প্লিনিয়ান বলা হয়। প্লিনি ছিলেন একজন রোমান ইতিহাসবিদ যিনি ৭৯ খ্রীষ্টপূর্বের ভিসুভিয়াস অগ্নুৎপাতের সবচেয়ে প্রাচীন বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। প্লিনি’র বর্ণনাটা এরকমঃ
‘২৪ আগষ্ট বিকেলে মা আমার মামার দৃষ্টি আর্কষণ করলেন একটি অদ্ভুত দর্শন মেঘের দিকে। এটাকে সবচেয়ে ভালভাবে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয়, একটি ছাতার মত পাইন গাছ তার কান্ডে ভর করে অনেক উঁচুতে পৌঁছে তারপর শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হল এরকম হওয়ার কারন এটা প্রথম বিস্ফোরণে উচ্চ চাপে উপরে উঠে গিয়েছিল এবং চাপ কমে যাওয়ায় নিচে পড়ে যাচ্ছিল। অথবে উঁচুতে উঠে নিজের ওজন ধরে না রাখতে পেরে আবার নিচে পরে গেল। মাঝেমধ্যে এটাকে সাদা দেখাচ্ছিল, মাঝে মাঝে ধোঁয়াশে আর ময়লা- এটা নির্ভর করছিল কি পরিমান ধুলা বা ছাই এর মধ্যে ছিল তার উপর।’
The Vesuvius Observatory নামের পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষণ গবেষণা স্টেশান ১৮৪১ সণ থেকে এই দানবটাকে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। টুকে রাখছে আগ্নেয়গিরির পেটের সব কাজকর্ম, মানে কম্পন ইত্যাদি, যেন পরবর্তী বিপদকে আগে থেকেই অনুমান করা যায়। জ্বালামুখ থেকে ৬০০ মিটার দূরে এবং উঁচুতে থাকা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি অগ্নুৎপাতের সময়ের লাভার ছিটেফোঁটা এড়িয়ে যেতে পারবে এমন দূরুত্বে অবস্থান করছে। বর্তমান পরিচালক মারসেল্লো মার্টিনি বলছেন- পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি আগ্নেয়গিরিবজ্ঞান এবং ভূমিতত্ত্ব দুই দিক দিয়েই গবেষণা করতে পারে এমনভাবে তৈরি করা।
পর্যবেক্ষণটির প্রথম পরিচালক ম্যাসেডোনিয়ো মেল্লোনি লাভার চৌম্বক গুণের উপর গবেষণাকে চালু করেছিলেন। এই গবেষণা পরবর্তী paleomagnetism গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। paleomagnetism হল পাথরের উপর লিপিবদ্ধ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা। ১৮৫৬ সালে দ্বিতীয় পরিচালক লুইগি পালমিয়েরি তড়িৎচুম্বক সিসমোগ্রাফ (ভূকম্পন মাপার যন্ত্র) আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রটি ছিল আগের যেকোন ভূমি-কম্পণ মাপার যন্ত্রের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। পামিয়েরি এবং পরবর্তী পরিচালকদের তত্বাবধানে কাজগুলি মূলত যন্ত্র-গবেষণায় নিয়োজিত ছিল যা পৃথিবীজুড়ে আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছে। যেমন, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গুইসেপ্পি মারসেল্লি একটি মাপন যন্ত্র বা স্কেল তৈরি করেছিলেন যা আজও অগ্নুৎপাতের কার্যক্রম বুঝতে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু যেই দালানে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি আছে সেটা এখন আর একই ধরনের কাজে ব্যবহ্রত হয়না। কিংসটন এর রোড বিশ্ববিদ্যালয়ের অাগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞ হারাল্ডুর সিগার্ডসন বলছেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্নুৎপাতের কাছাকাছি থেকে পর্যবেক্ষণ করাটা জরুরী ছিল; কিন্তু এখন সেটার প্রয়োজন নাই।’ প্রায় সব পর্যবেক্ষণই এখন করা হয় দূর থেকে, সংবেদণশীল ভূমি-যন্ত্র দিয়। তারপর সেই তথ্য পাঠিয়ে দেয়া হয় নেপলস এর National Institute of Geophysics and Volcanology এ। মূল দালানটি একটি জাদুঘরে পরিনত করা হয়েছে, ১৯৭০ সাল থেকে।
বৈজ্ঞানিক তথ্য জানানো ছাড়াও পর্যবেক্ষণগুলি যেকোন ধরনের বিপদ অনুমান করে এবং সেই অনুযায়ী মানুষকে রক্ষা করে। যেমন তাঁরা করেছিলেন ১৯৪৪ সালে (স্বল্পমাত্রায় হয়েছিল)। নেপলস গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা দিনে ২৪ ঘন্টা কাজ করেন, আর সিসিলি দ্বীপের ষ্ট্রম্বলি পর্বত, নেপলস এর পশ্চিমে ক্যাম্পেই ফ্লেগেরি ক্যালডেরা (এক ধরনের আগ্নেয়গিরি) এবং ইশচিয়া দ্বীপের উপরও চোখ রাখেন।
সিগার্ডসন যদিও বলছেন- ভবিষ্যৎ অগ্নুৎপাতগুলির সম্ভাবনা শুধু বিপজ্জনক আগ্নেয়গিরিগুলির কাছে মাটিতে সেন্সর রেখে দিয়ে অনুমান করা হয়না, বরং স্যাটেলাইট দিয়ে ভূমিতে যেকোন অদ্ভুত আচরন, ভাঙন দেখা হয় এবং ভূমিবিদরা কোন অনুমান না করলেও কিছু যায়গা নজরে রাখা হয়। আমাদর দিনে দিনে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষণগুলির মধ্যে সমন্বয়ের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, শুধুমাত্র আগ্নেয়গিরির আশেপাশে মনুষ্য কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য নয়, বরং সমন্বিতভাবেভাবে, বৈশ্বিকভাবে দেখতে হবে।’
সূত্রঃ
1. Nature 495, 300-303; 2013
2. Nature 473, 140-141; 2011
3. http://geology.com/volcanoes/vesuvius/
Leave a Reply