আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হাজার রকমের মিথ (myth) এবং এগুলোর একটি বিশাল অংশ বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত। এগুলোর কিছু কিছু এতোটাই প্রচালিত যে এমনকি বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতেও সেগুলো ছড়িয়ে আছে সমান ভাবে। সেই মিথগুলোর যুক্তিখন্ডন এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যই এই সিরিজটির অবতারণা করা হয়েছে। এখানে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মিথ বা অপব্যাখ্যার প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে।
২১. উটপাখি বিপদ দেখলে বালিতে মাথা গুঁজে ফেলে
বিপদে পড়ুক আর যাই ঘটুক উটপাখি কখনোই বালিতে মাথা গোঁজে না। যেকোন বিপদ বা ভয়ে উটপাখির প্রথম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ঝেড়ে দৌড় দেওয়া। এর দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমত, দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া (উটপাখি ঘন্টায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে) আর দ্বিতীয়ত, শিকারীর নজর অন্যদিকে ফেরানো, যদি শিকারি ডিমের কাছাকাছি থাকে। তাছাড়া উটপাখি যে বিপদে শুধু পালিয়ে বেড়ায় তা-ও নয় অনেক সময় উটপাখি সম্ভাব্য বিপদের মুখোমুখি হয় এবং আক্রমনাত্মক অবস্থান নেয়। এরা পা-এর লাথি দিয়ে এমনকি সিংহকেও কাবু করে ফেলতে সক্ষম। তবে অধিকাংশ সময় এর খুব শক্ত আঘাত করে না। বালিতে মাথা না গুঁজলেও উটপাখি তাদের ডিম বালিতে গুঁজে রাখে।এই কারনে পুরুষ পাখিটি বালিতে বড়সড় গর্ত করে। এই সময় হয়তে তাদের দেখে মনে হতে পারে তারা বালিতে মাথা গুঁজে আছে। বালিতে মাথা গোঁজার মিথ আরেকটি কারনে তৈরি হতে পারে। সেটা হলো উটপাখির মাথার অংশটি ধুষর ও হালকা রংএর। দুর থেকে দেখে বালি থেকে আলাদা করা যায় না। ফলে মনে হতে পারে এরা বালিতে মাথা গুঁজে আছে।
সূত্র:
১. ostrich.org
২. উইকিপিডিয়া: Ostrich
২২. জেমস ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেন
জেমস ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেন নি। জেমস ওয়াট এবং কেতলি সম্পর্কিত যেই কাহিনী আমরা ছোটো বেলায় পড়ে এসেছি সেটাও একটা হোকস্। কাহিনীটি হল এই রকম: জেমস্ ওয়াট একবার কেতলিতে পানি গরম করছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন কেতলির ঢাকনা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। তিনি লক্ষ করেন পানি বাস্পীভূত হয়ে ঢাকনার নিচে চাপ দিচ্ছে। অর্থাৎ বাষ্পের কাজ করার সামর্থ আছে। এই ঘটনা থেকে তিনি বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেছেন থমাস নিউকমেন (Thomas Newcomen)। ১৭১২ সালে তিনি এটা উদ্ভাবন করেন। তাঁর উদ্ভাবিত বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে atmospheric engine নাম দেওয়া হয়। অপর দিকে জেমস ওয়াটের জন্মই হয়েছে নিউকমেনের উদ্ভাবনের দুই যুগ পরে ১৭৩৬ সালে। তিনি নিউকমেনের উদ্ভাবিত ইঞ্জিনের উন্নতি সাধন করেন যেটা পরে ওয়াট স্টীম ইঞ্জিন নামে প্রচলিত হয়। তিনি নিউকমেনের ইঞ্জিনকে ইন্ডাস্ট্রীতে ব্যবহারোপযোগী করেন।
সূত্র:
১. উইকিপিডিয়া: Newcomen Steam Engine
২. উইকিপিডিয়া: Thomas Newcomen
৩. উইকিপিডিয়া: James Watt
২৩. ঠান্ডা লাগলে ভিটামিন সি নিরাময় করতে পারে
সাধারণ ঠান্ডা লেগে থাকে বিশেষ কিছু ভাইরাসের আক্রমনে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে rhinoviruses, coronaviruses এবং respiratory syncytial virus প্রভৃতি। যদিও ভিটামিন সি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে কিন্তু ঠান্ডা লাগলে ভিটামিন সি তার উপশম করতে পারে না। ১৯৭০ সালে Linus Pauling দাবী করেন ভিটামিন সি ঠান্ডা লাগার প্রভার উল্লেখযোগ্য পরিমানে হ্রাস করে। তাঁর দাবীর মাধ্যমে অনুপ্রাণীত হয়ে গবেষকরা পরবর্তীতে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং দেখেন যে ঠান্ডা নিরাময়ে মোটের উপর ভিটামিন সি এর কোনো প্রভাব নেই। প্রায় ১০০০০ অংশগ্রাহীর উপর ৩০ টির ও বেশী পরীক্ষা করা হয় যাদের প্রতিদিন ২ গ্রাম করে ভিটামিন সি সেবন করতে দেওয়া হয়। ঠান্ডার উপর ভিটামিন সি এর প্রভাব যদিও পাওয়া যায় নি তবে এই গবেষণা হতে দেখা যায়, যারা খেলাধুলা করেন এবং নিয়মিত শরীরচর্চা বা শারিরীক কসরত করেন তাঁরা ভিটামিন সি সেবনে উদ্যম বৃদ্ধি করতে পারেন এবং স্ট্রেস দূর করতে পারেন।
সূত্র:
১. উইকিপিডিয়া: Vitamin C and common cold
২৪. মানুষের পাঁচ ধরনের ইন্দ্রিয় বা অনুভূতি আছে
আমরা ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি মানুষের পাঁচ ধরনের ইন্দ্রিয় আছে। এগুলো হচ্ছে দৃশ্যানুভূতি, স্পর্শানুভূতি, গন্ধের অনুভূতি, স্বাদের অনুভূতি এবং শ্রবণ অনুভূতি। কিন্তু এটা একটা মহাভুল তথ্য। আমরা একটু সচেতনতার সাথে খেয়াল করলে উপলব্ধি করতে পারব আরো অনেক ধরনের অনুভূতিই আমাদের আছে! যেমন: ভারসাম্যের অনুভূতি- আমাদের শরীরের ভারসাম্য এই অনুভূতির মাধ্যমে বোঝা যায়। এই ইন্দ্রিয়ের অবস্থান কানের ভিতর। ত্বরণের অনুভূতি: আমরা যদি একটি নির্দিষ্ট বেগে চলতে থাকি তাহলে আশেপাশে না তাকালে বুঝতে পারব না, কিন্তু যদি বেগের পরিবর্তন হয় তাহলে তা অনুভব করতে পারি। ব্যাথার অনুভূতি- ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন! এটা যে স্পর্শানুভূতি নয় সেটাও বলা নিষ্প্রয়োজন। তাপমাত্রার অনুভূতি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রক্তের কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমানের অনুভূতি (আপনি এই অনুভূতি না পেলে আমাকে দূষবেন না! তবে দম বন্ধ রেখে কিংবা মুখে একটা পলিব্যাগ ধরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে উপলব্ধি করতে পারবেন), সময়ের অনুভূতি- কি পরিমান সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে সেটা বোঝার ক্ষমতাও আমাদের আছে, কিন্তু ঘড়ির কল্যাণে এই অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। এর বাইরেও আরো কিছু অনুভূতি আছে।
সূত্র:
১. The brain geek
২৫. বিবর্তন তত্ত্ব প্রাণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করে
বিবর্তন তত্ত্ব আসলে প্রাণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করে না। প্রাণের উদ্ভব নিয়ে গবেষণার জন্য জীব বিজ্ঞানের একটি আলাদা শাখা আছে, সেটি হচ্ছে abiogenesis বা উদ্ভব বিজ্ঞান। উদ্ভব বিজ্ঞানীরা প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত কোনো গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও বিবর্তন তত্ত্বের তাতে কিছু যায় আসে না। বিবর্তন শুধুমাত্র আলোচনা করবে একপ্রজাতি থেকে অন্যপ্রজাতির রূপান্তর, জীনগত পরিবর্তন তথা মিউটেশন। আনবিক বিবর্তনও বিবর্তনেরই একটি আলোচ্য বিষয়। আনবিক পর্যায়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে পার্থক্য তৈরি হয় এবং তার ফলে জীবের বৈশেষ্ট্যে যে পরিবর্তন ঘটে সেটা এই ক্ষেত্রে আলোচনা করা হয়। ফসিল এভিডেন্স থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সম্বন্ধীকরণ, প্রাকৃতিক নির্বাচন এসবও বিবর্তনের আলোচনার বিষয়। অর্থাৎ বিবর্তনের আলোচনার বিষয় হচ্ছে প্রাণের বিকাশ কিভাবে ঘটে, এবং বিবর্তন এটা ধরে নিয়েই এগোয় যে প্রাণের যেভাবেই হোক ইতিমধ্যে উৎপত্তি হয়েছে।
সূত্র:
১. about.com
২. Studytoanswer.net
Leave a Reply