এস্ট্রো-ভাইরোলজি

পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে বহির্জগতে প্রাণের অনুসন্ধান করা বর্তমান কালের জ্যোতির্বিদদের একটা বড় ধরনের এজেন্ডা। পৃথিবীর বাইরে মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশ হওয়াটা অনেক বড়সড় ব্যাপার, প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হলেও অনুপ্রাণ বা ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের বিকাশ হওয়াটা তেমন শক্ত কিছু নয় বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পৃথিবীতে আদি প্রাণ সৃষ্টির সময় যেরকম তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা ছিল সেরকম আর্দ্রতায় যদি প্রাণের সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান গুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে বেশ কদিন রেখে দেয়া হয় তবে তা প্রাণের আদি রূপের কাছাকাছি চলে যায়। যেমন সেটা হয়ে যায় এমাইনো এসিড। আর এমাইনো এসিডকেই ধরা হয় প্রাণের সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়। এই এমাইনো এসিড থেকেই উৎপত্তি ঘটেছে ভাইরাসের। যদি এমাইনো এসিড বাইরের কোনো জগতে উৎপন্ন হতে পারে তবে ভাইরাস উৎপন্ন হওয়াটা অবাক করা কিছু নয়। আর ভাইরাস যদি আদি প্রাণের ভিত্তি হয়ে থাকে সে ভাইরাস থেকে উন্নত প্রাণ সৃষ্টি হওয়াটা হেসে তো আর উড়িয়ে দেয়া যায় না। হোক সেটা এক কোটি বছর পর বা হোক সেটা এক বিলিয়ন বছর কিংবা ট্রিলিয়ন বছর পর। একারণেই বহির্জগতে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করতে ভাইরাসকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

যে শাখায় এ নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে বলা হয় এস্ট্রো-ভাইরোলজি। সহজ বাংলায় এটা দাড়ায় বহির্জাগতিক ভাইরাসবিদ্যা। এই শব্দটাকে যদি ভিনগ্রহী ভাইরাস বিদ্যা বলে ডাকা হয় তবেও হয়ে যায়। আভিধানিক ভাবে বললে তো কেমন একটা কটমটে অর্থ হয় “জ্যোতির্ভাইরাসবিদ্যা” । উল্লেখ রাখা ভাল এই নবীন শব্দের বাংলা পরিভাষা বাংলা কোনো অভিধানেই এখন পর্যন্ত পাই নি। অবশ্য থাকার কথাও নয়, ইংরেজি সায়েন্টিফিক টার্ম গুলোর ভাল একটা পরিভাষা তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাও আবার এটা খুবই নতুন একটা শব্দ। যাহোক সাম্প্রতিক কালে এস্ট্রো-বায়োলজি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় ড.গ্রিফিন নামে এক বিজ্ঞানী ভদ্রলোক গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন পৃথিবীর বাইরে প্রাণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ভাইরাস হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। অন্য সকল জটিল জটিল প্রাণের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া থেকে এটাই সবচে ভাল হবে। প্রাণটা যদি জটিল হয় তবে তাঁর কার্যকলাপও জটিল হবে। তাঁর চেয়ে সরল এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করলেই পাওয়া যাবে একেবারে গোরা থেকে। ভিন গ্রহে যদি প্রাণ থেকে থাকে সেটা যে মানুষের মত কিংবা আমাদের পরিচিত কোনো পশু-প্রাণী বা গাছ-উদ্ভিদের মত হবে এমন কি কোনো কথা আছে? এমনটা কি বলা যায়? মানুষের কল্পনা অনেক সীমিত, মানুষ কোনো ভূতের প্রতিকৃতি আঁকতেও তাঁর নিজের আদলে আকে, নিজের আদলে কল্পনা করে। এমনকি প্রায় রোবটই বানায় মানুষের আকৃতির মত করে। রোবট মানুষের মত হতে হবে কি? যেকোনো আকৃতিরই হতে পারে সেটা। হতে পারে চতুর্ভুজ-ঘনকের মত। মানুষ তাঁর সহজাত প্রবৃত্তির কারণে ভিনগ্রহে উন্নত প্রাণ মানুষের মত হবে বলে মনে মনে অবয়ব আঁকে। এমন সব ঝামেলা শেষ করে ফেলা যায় সবচে সরল একটা প্রাণকে স্কেল করে নিলে। সবচে সরলের মাঝে এক কোষী সবার আগে। এক কোষের চাইতে তো আর সরল হতে পারে না। অর্ধেকটা কোষ নিয়ে অর্ধকোষী তো আর হওয়া যায় না। আর ভাইরাস হল এই সুবিধাবলীর জন্য আদর্শ। তাই এত কিছু থাকতে ভাইরাসকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

ast.2012.12.issue-12.cover

চিত্র: এস্ট্রো বায়োলজি ম্যাগাজিনের একটি প্রচ্ছদ।  

সূর্যের মত ভরের নক্ষত্রের কাছে পৃথিবীর যে প্রাণবান্ধব অঞ্চলে অবস্থান, সূর্য থেকে পৃথিবীর একদম উপযুক্ত দূরত্ব, অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র, পানি চক্রের অপরূপ সন্নিবেশে পৃথিবীটা প্রাণ বিকাশের জন্য হয়েছে একদম উপযুক্ত। এরকম পৃথিবীর মত আঁকার, ভর, যদি মিলে যায় এবং সাথে সাথে সূর্যের মত কেন্দ্রে রেখে আবর্তনকারী নক্ষত্র থেকে দূরত্ব ও চক্র যদি মিলে যায় তবে সেখানে প্রাণের বিকাশ হওয়াটা কাকতালীয় কিছু নয়। আর প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিত হওয়া গেলে মানুষের ভবিষ্যতের জন্য একটা বিশাল ইঙ্গিত বহন করে। ভবিষ্যতের একটা ঠাই পাওয়া যায়। আজ হোক কাল হোক পৃথিবী এক সময় ধ্বংস হবে। সূর্য যখন হাজার কোটি বছর পর ধ্বংস হয়ে যাবে তখন সেটি পৃথিবীকেও করে নিবে। হোক না সেটি হাজার কোটি বছর পর, কিন্তু ধ্বংস তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এই ধ্বংসকে এড়িয়েও যাওয়া যাবে না। পৃথিবী তো ধ্বংস হবেই, তারপরও যদি যুক্তির খাতিরে কিচ্ছুক্ষণের জন্য ধরে নেই যে কোনো একভাবে সূর্য ধ্বংস হলেও এই পৃথিবী সেই ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে। যদি বেঁচে যায় তবেও মানুষ প্রাণ রক্ষা করতে পারবে না। আমরা জানি আমাদের সকল শক্তির উৎস সূর্য। সে সূর্য না থাকলে আমরা কোনো প্রকার খাবারই পাব না। কোনো গাছ ফল দিবে না। মরে যাবে সব। মাছ প্রাণী উদ্ভিদ সবাইকেই শেষ হয়ে যেতে হবে ১০ দিনের মাথায়। লাক্সারিয়াস ভাবে কয়েক হাজার মানুষ বেঁচে যেতে পারে (2012 সিনেমায় যেমন করে বেঁচেছিল) তবে সেটা মাত্র কয়েক বছরের জন্য।

মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এক সময় না একসময় পৃথিবী থেকে ‘পালাতেই’ হবে। সেজন্যই এই এস্ট্রো-ভাইরোলজি বিজ্ঞানীদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। বসবাসের উপযোগী গ্রহ খুঁজে পাতে তা দরকারি। তাড়াহুড়ো করেই যে করতে হবে তাও না, সময় কিন্তু আছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর! ততদিনে মানুষের প্রযুক্তি উন্নত হয়ে যাবে, এমনকি শত শত আলোক বর্ষ দুরের গ্রহে যাওয়াটাও হয়ে যেতে পারে মামুলি ব্যাপার। যারা শত শত আলোক বর্ষ দূরে কথাটা শুনে হয়তো একটু ভড়কে যাবার কথা, কভাবে এত দূরে যাওয়া সম্ভব? আলো এক সেকেন্ডেই অতিক্রম করে তিন লক্ষ কিলোমিটার আর এক বছরে অতিক্রম করলে তো হয়ে যায় বিশাল ব্যাপার! বিশাল ব্যাপারটাও সম্ভব। একটা ওয়ার্ম হোল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই এটা করা সম্ভব। হয়তো এখন থেকে একশ বছর কিংবা এক হাজার বছর পরেও সেটা মানুষের জন্য সম্ভব না। একটা ওয়ার্ম হোল নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি পাওয়া হয়তো হাজার বছরে নাও হয়ে উঠতে পারে কিন্তু লক্ষ বছর পর সেটা মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়, হোক সেটা যতই অসম্ভবপর। মানুষের চিন্তা শক্তির তুলনা হয় না। সেই লক্ষে এখনই কাজে নামা। তাই প্রথম দিকেই আলোচনায় এই এস্ট্রোভাইরোলজি।

সুত্র

What Exactly Is Astrovirology?

http://www.wired.com/wiredscience/2013/09/what-exactly-is-astrovirology/



মন্তব্য

  1. skyship Avatar
    skyship

    খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে পড়লাম। এইটা নিয়ে আমার কৌতূহল আছে সামান্য। খুব ভালো লিখেছেন আপনি। শুভেচ্ছা রইল।

    1. সিরাজাম মুনির শ্রাবণ Avatar

      ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂 । কৌতহল আছে শুনে ভাল লাগল।
      এই ব্লগে এটাই আমার প্রথম পোস্ট। সত্যিকারের ব্লগ বলতে যা বোঝায় তা হলে এটাই আমার প্রথম ব্লগ। আশা করি নিয়মিত থাকবো।

  2. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
    সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

    মন্তব্য আগেই করেছি। আশা করি তোমার কাছ থেকে বিজ্ঞান ব্লগে নিয়মিত লেখা পাব 🙂

    বিজ্ঞান ব্লগে স্বাগতম 🙂

    1. সিরাজাম মুনির শ্রাবণ Avatar

      ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার মন্তব্য গুলো আবার দেখতে হয় তো… 😛 😉
      ইনশাল্লাহ, নিয়মিত লিখবো। আর আশা করি আপনি আপনারা সে লেখা পড়বেন। মন্তব্য করবেন। 🙂

  3. আরাফাত রহমান Avatar

    তোমার অনুবাদের ভাষাটা বেশ সুন্দর। তবে কিছু জায়গায় অর্থের অনুবাদটা ঠিকমতো হয় নি। অণুপ্রাণ বলতে আসলে ঠিক ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাস বোঝায় না, এটা মলিকুলার বায়োলজির অনুবাদ, মলিকুলার বায়োলজির গন্ডীতে ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস ছাড়াও অনেক কিছুই পড়তে পারে। আবার, এমিনো এসিড থেকেই ভাইরাসের উৎপত্তি, এই লাইনটা কিন্তু সঠিক হয় নি, ভাইরাস তৈরি করতে এমিনো এসিড লাগে, কিন্তু ভাইরাসের ‘উৎপত্তি’ এমিনো এসিড থেকে এটা তর্ক সাপেক্ষ।

    পরিভাষা নাই এটা একটা সমস্যা হলেও দরকার মতো পরিভাষা তৈরি করে নিলেই হলো! জ্যোতির্ভাইরাসবিদ্যা তো তেমন একটা খারাপ শোনায় না। এমনিতে কিন্তু এস্ট্রোভাইরলজি বিষয়টা দারুণ! কোষীয় জীবনের আগে ভাইরাস আসাটা অস্বাভাবিক নয়; যদিও প্রাণের উদ্ভবের গোড়ার অনেক কিছুই পরিস্কার। এই বিষয়টা অনেক আলোচনার দাবী রাখে।

    বিজ্ঞানব্লগে স্বাগতম! হ্যাপী ব্লগিং!

    1. সিরাজাম মুনির শ্রাবণ Avatar

      অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া, আপনার কথাগুলো ভবিষ্যতে আমার কাজে লাগবে। শেখার জন্যই তো আসা। এমিনো এসিড থেকে যে ভাইরাসের উৎপত্তি সেটাই তো জানতাম। কিন্তু সেটা যে তর্ক সাপেক্ষ সেটা জানতাম না। আজ জানলাম। কাজে দিবে। 🙂 ।

      পরিভাষাটা আসলেই একটা সমস্যা। আমরা নবীনরা যেমন তেমন পরিভাষা করতে পারি না। চাইলেই হয়ে যায় না। ” এস্ট্রোভাইরোলজি” শব্দের পরিভাষার জন্য আমি ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, সৌমিত্র চক্রবর্তী, সুব্রত দেব নাথ, অভীক রায় এদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তাদের শেষে আলোচনা শেষে যেটা সিদ্ধান্ত নেয়া হল সেটা হল ‘ইংরেজি শব্দটাই থাকুক।’ তাই রেখেও দিলাম।
      আসলে এটা শুনতে ভালই লাগে।

      আমার জানামতে Astrovirology টপিকে এটাই বাংলা ভাষায় (দুই বাংলা মিলিয়ে) প্রথম কোনো আর্টিকেল। সে হিসেবে আমার একটা দাবী থাকবে কেও যদি বাংলা প্রেমী হয়ে পরিভাষা করতেই চায় তবে যেন “বহির্জাগতিক ভাইরাসবিদ্যা” রাখে।

      আশা করি ব্লগে নিয়মিত থাকতে পারবো। আর এও আশা করি আপনি আপনারা আমার ব্লগ নিয়মিত পড়বেন, মন্তব্য করবেন। 🙂 🙂

মন্তব্য লিখুন