বেশ কিছুদিন আগে ফিজিওলজি ল্যাবে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা শেখানো হল। স্যার একবার দেখিয়ে দিয়ে ল্যাব থেকে চলে গেলেন। উৎসাহীরা একে অপরের আঙ্গুল ফুটো করে তিনফোটা রক্ত স্লাইডে নিয়ে অ্যান্টিজেন মিশিয়ে গ্রুপ বের করতে শুরু করল। সাহসীরা নিজেরাই নিজেদের আঙ্গুলে সুই ফুটিয়ে কাজ করল। কিন্তু, ঝামেলা হল-বেশ কয়েকজনের রক্তের গ্রুপ তারা যেটা জানতো সেটা না এসে অন্য কিছু দেখাচ্ছে। তারা আবার পরীক্ষা করল, তবে ফলাফল আগের মতই। তারাও সেটা মেনে গেল, কেউ কেউ আগের পরীক্ষকের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। অনেকে আবার নিজেদের মিউট্যান্ট দাবী করে গল্প জমানো শুরু করল। আমি ভাবলাম স্যার যখন আসছেননা, দেখি একটু খুজাখুজি করে। স্বতস্ফুর্তভাবে রক্তের গ্রুপ বদলে যাওয়ার কোন ব্যাখ্যা আছে কিনা।
প্রথমেই যে মজার তথ্যটা চোখে পড়ল তা হল-বিজ্ঞানিরা ধারনা করেন এক সময় ও গ্রুপের রক্ত ছাড়া আর কোন রক্ত ছিলোনা। কালের পরিক্রমায় এ,বি কিংবা এবি রক্তের গ্রুপ এসেছে। এই নতুন নতুন গ্রুপের আবির্ভাবের কারন হিসেবে ধরা হয় মাইগ্রেটরি মিউটেশনকে। তাই ও গ্রুপের তুলনায় অন্যান্য গ্রুপের রক্তকে নতুনই বলা চলে। সেই কারনেই এখনো জনসংখ্যার বড় একটা অংশে ও গ্রুপের আধিক্য দেখা যায়। ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু জনগোষ্ঠিতে দেখা যায়, তাদের সকলেরই রক্তের গ্রুপ ও। যদি অন্যান্য রক্তের গ্রুপ-ও গ্রুপের সাথে একই সাথে আসত, তাহলে এই সব জনগোষ্ঠিতেও তাদের উপস্থিতি পাওয়া যেত। অর্থাৎ, যেসব জিনের কারনে নতুন গ্রুপের উদ্ভব হয়েছিল সেগুলো তাদের সমাজে প্রবেশ করতেই পারেনি।
আরএইচ ফ্যাক্টর বলে আরেকটি ব্যাপার আছে যেটার কারনে এখন আমরা যেকোন রক্তের গ্রুপকে আবার পজেটিভ এবং নেগেটিভে ভাগ করি। আরএইচ ফ্যাক্টর থাকলে বলি পজেটিভ, না থাকলে বলি নেগেটিভ। তাহলে এটাও বুঝা যাচ্ছে, আদিম মানুষের রক্তে আরএইচ ফ্যাক্টর উপস্থিত ছিলোনা। তাই ও নেগেটিভ রক্তকে প্রাচীনতম রক্তের গ্রুপ বলা যায়। এটা তো সবারই জানা আছে।
যাই হোক, কথা হচ্ছিল স্বতস্ফুর্ত রক্তের গ্রুপের পরিবর্তন নিয়ে। সেখানেই ফিরে যাই,
ঘাটাঘাটি করে জানতে পারলাম ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর ধীরে ধীরে গ্রহীতা দাতার রক্তের গ্রুপের অধিকারি হয়েছেন, এরকম কিছু ঘটনা রয়েছে। জেনে রাখা ভালো- অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য দাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ নয়, এইচএলএ(হিউম্যান লিউকোসাইট-অ্যাসোসিয়েটেড অ্যান্টিজেন) পরীক্ষা করে দেখা হয়।
আরেকটি ঘটনা জানলাম, তা হল- হামে আক্রান্ত এক নবজাতক। যার জন্মের প্রথম আট সপ্তাহে বেশ কয়েকবার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছিল। প্রতিবারই দেখা গিয়েছে তার গ্রুপ এ। কিন্তু, চার মাস পরে দেখা গেছে তার রক্তের গ্রুপ ও তে পরিনত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারনা কোন একটা এনজাইম তার রক্তের এ-এন্টিজেনকে হজম করে ফেলেছে, তাই এই অবস্থা।
এই ধরনের এনজাইম যদি নিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যাবহার করে যেকোন রক্তকে ও গ্রুপে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে বিশাল একটা ব্যপার হয়ে যাবে। কারন, ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়ে এসেছি ও নেগেটিভ রক্তের গ্রুপকে বলা হয় ইউনিভার্সাল ডোনার। অর্থাৎ, যে কোন রক্তের গ্রুপের অধিকারী প্রয়োজনে ও নেগেটিভ গ্রহন করতে পারে। তবে ব্যাবহারিক জীবনে জরুরী অবস্থা ছাড়া এটা করা হয়না। এই রকম এনজাইম এক ধরনের মাশরুম থেকে বের করার চেষ্টা চলছে।
আরেকটি আশ্চর্য ঘটনার কথা জানলাম- বেশ কয়েকবছর আগে ৯ বছরের এক বালিকার লিভার নষ্ট হয়ে যায়। অন্য আরেকটি লিভার প্রতিস্থাপন করা হলেও সে এন্টি-রিজেকশন ওষুধের কারনে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে যেতে শুরু করে। অংগ প্রতিস্থাপনের পর দেহ গ্রহন না করা একটি মারাত্নক ব্যাপার। তাই প্রতিস্থাপনের পর রোগীকে সারা জীবনই এমন ওষুধ গ্রহন করে যেতে হয় যা দেহকে জোর করবে ওই অংগ গ্রহন করার জন্য। ওই বালিকার ক্ষেত্রে ওষুধ গ্রহনের সাথে সাথেই অসুস্থ হয়ে যাওয়া একটি খারাপ লক্ষন। ডাক্তাররা তার রক্ত পরীক্ষা করে জানালেন,তার দেহ স্বতস্ফুর্ত ভাবে রক্তকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। দেখা গেল, তার লিভার থেকে স্টেম সেল অস্থিমজ্জায় যায়। সেখান থেকে সম্পুর্ন ইম্যুন সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে রক্তকে ও নেগেটিভ থেকে ও পজেটিভে পরিবর্তন করে, এবং তার দেহ লিভারকে সাদরে গ্রহন করে নেয়। এই অবস্থায় তাকে ওষুধ গ্রহন থেকে বিরত রাখা হয়। দেখা যায় সে দিব্যি ভালো আছে। পরবর্তীতে আসলে তার এন্টি-রিজেকশন ওষুধের আর দরকারই হয়নি কখনো। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের ঘটনার সম্ভাবনাকে দেখে ৬ বিলিয়নে ১টি। অংগ প্রতিস্থাপনের রোগীদের জন্য এটা আসলেই আশার ব্যাপার হতে পারতো যদি এই সম্ভাবনাকে কিছুটা হলেও বাড়ানো যেত।
সবার কাজ হয়ে যাওয়ার পর যখন শিক্ষক মহোদয় আসলেন এবং আমরা তাকে প্রশ্ন করলাম এই ব্যাপারে যে, কয়েকজনের রক্তের গ্রুপে ঝামেলা আছে। আগে একটা জানত, এখন পরীক্ষা করে অন্যটা পাওয়া যাচ্ছে। তখন তিনি জানালেন, এটাই নাকি স্বাভাবিক এবং সাধারন প্রক্রিয়া। আমি বেশ দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম, কেননা এতক্ষন যা জানলাম তাতে এই ঘটনা স্বাভাবিক হলেও সাধারনত হয় বলে তো মনে হলোনা। পরবর্তীতে তিনি বললেন, তোমাদের প্র্যাকটিসের জন্য যে অ্যান্টিজেনগুলো দেয়া হয়েছে তার একটা মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই অন্যরকম ফলাফলে আশ্চর্য হবার কিছু নাই।
তথ্যসূত্রঃ
www.dadamo.com
blog.doctorz.com
www.io9.com
www.dailymail.co.uk
Leave a Reply