লেখাগুলি আগে ফেইসবুকে প্রকাশিত
১.
বিবর্তন তত্ত্বের একটা সমস্যা ছিল এই প্রশ্ন- যদি বিবর্তনের ফলে বিভিন্ন জীবের উদ্ভব হবে তবে কিভাবে বিভিন্ন মহাদেশে একইধরনের প্রাণীর উদ্ভব হল? যেমন ব্যাঙের মত উভচর প্রাণী সবগুলি মহাদেশে দেখা যায় (এন্টার্টিকা ছাড়া)। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে বিভক্ত। কিন্তু ব্যাঙের ত্বক পারমিয়েবল বা ভেদ্য, ফলে তারা তো সাঁতার কেটে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে পারবেনা।
তবে কি ভিন্ন দুইটি যায়গায় একদম একইরকমের প্রাণীর উদ্ভব সম্ভব? সম্ভবত নয়। ডারউইন ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছিলেন এভাবে- হয় ব্যাঙগুলি কোনকিছুর সঙ্গে ভেসে ভেসে অন্য মহাদেশে গেছে অথবা আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকাকে যুক্ত করা কোন ভূমির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ডারউইন নিজের ব্যাখ্যায় মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না।
বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে একজন জার্মান ভূতত্ববিদ একটা অসাধারণ তত্ত্ব দিলেন- পৃথিবীর ভূমির বেশিরভাগই একসময় একজায়গায় যুক্ত ছিল। এখনকার মানচিত্রে মহাদেশগুলির আকৃতি দেখলে আসলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। এই সুপার-কন্টিনেন্ট বা সুপার-মহাদেশকে নাম দেয়া হল পাঞ্জিয়া। পাঞ্জিয়া ভেঙে একসময় অনেকগুলি মহাদেশ হল। তাই ধারনা করা যায় ব্যাঙের মত উভচরের উদ্ভব পাঞ্জিয়া ভেঙে যাওয়ার আগেই হয়েছিল। ফলে সবগুলি মহাদেশে তারা ছড়াতে পেরেছে।
![Continental drift - Wikipedia](https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/1/10/Snider-Pellegrini_Wegener_fossil_map.svg/330px-Snider-Pellegrini_Wegener_fossil_map.svg.png)
পাঞ্জিয়া ভাঙনের পরে যেই পরিবর্তনগুলি হয়েছে সেটা এখনও চলমান। আমাদের ভূখন্ডগুলি এখনও নড়ছে, তবে এত ধীরে যে আমরা বুঝছিনা। উদাহরণ হিসেবে বলি, পাঞ্জিয়া ভাঙার পরে ভারতীয় উপমহাদেশ (বাংলাদেশ সহ) কোন এক সময়ে আফ্রিকার নিচের দিকের অংশ, এন্টার্টিকা এবং অষ্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। তারপর ভারতীয় ভূখন্ড সরে আসতে আসতে এশিয়ার মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংঘর্ষিত হয়। এই চাপে হিমালয় পর্বতমালা তৈরি হয়েছে।
যেসব জীব পাঞ্জিয়া ভাঙনের পরে বিবর্তনের ফলে উদ্ভব হয়েছে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নরকম। যেমন, প্রকৃতিবিদ এবং যৌথভাবে বিবতর্ন তত্ত্বের প্রবক্তা আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস খুঁজে পেয়েছিলেন যে ইন্দোনেশিয়ার থেকে অষ্ট্রেলিয়ার উত্তর দিক (নিউ গিনি) একটা অদৃশ্য রেখায় বিভক্ত যেখানের জীববৈচিত্র ভিন্নরকম। এই লাইনটাকে বলা হয় ওয়ালেসের রেখা। রেখার উত্তরদিকের অংশে ম্যামালেরা বা স্তন্যপায়ীরা হল বানর গোত্রীয়, আর দক্ষিণ দিকের অংশ হল ক্যঙ্গারু গোত্রীয়। কোন মিশ্রণ নেই এখানে। এই সূক্ষ রেখা আসলে জল, যেটা দুই দিকের ভূখন্ডকে আলাদা করে দিয়েছে এবং দুই অংশের স্থলজ জীব (পাখি নয়) সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে।
২.
অন্যান্য অনেক জীবের মতই মানুষের ডিএনএ তেও অনেকগুলি pseudogene (সিউডোজিন) আছে। সিউডোজিনকে বাংলা করলে বলা যায় ‘নকল জিন’। অর্থাৎ এদেরকে জিন হিসেবে খুঁজে বের করা গেলেও (ATG দিয়ে শুরু হয়, আসল জিনের সঙ্গে কিছু বিন্যাসে মিল আছে ইত্যাদি) এরা কোষে প্রকাশিত হয়না, বা প্রোটিন তৈরি করেনা; মোট কথায় এরা কোন কাজ করেনা।
আমাদের ডিএনএ তে অনেকগুলি ‘নকল জিন’ আছে যেগুলি গন্ধ নিতে সাহায্য করতো কোন এক সময়। কিন্তু বর্তমান মানুষের আর অন্য প্রাণীর মত এত এত গন্ধ নেয়ার প্রয়োজন পড়েনা (বন থেকে দূরে থাকি বলেই হয়তো)। আমরা গন্ধ নেয়ার উপর নির্ভরশীলতা অনেকখানি হারিয়েছি। অর্থাৎ বিবর্তনের ধারায় আমরা গন্ধ নেয়ার জন্য জরুরী জিনগুলি হারিয়েছি যেগুলি এখন ‘নকল জিন’ হিসেবে আছে।
অন্যান্য প্রাইমেটদের কিন্তু আমাদের চেয়ে বেশি কার্যকর জিন আছে যারা গন্ধ নিতে সাহায্য করে (যেগুলি আমাদের দেহে ‘নকল জিন’ হিসেবে আছে)। বেশিরভাগ পরীক্ষা বলছে এইসব ‘নকল জিন’ আমাদের দরকার নাই কোনই। হয়তো সময়ের সাথে সাথে আমরা অপ্রয়োজনীয় এসব জিন হারাবো, আবার নতুন নতুন জিন গ্রহণ করবো।
![Pseudogene - Wikipedia](https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/7/7c/Pseudogene_defects.png)
অনেকগুলি সৃষ্টিতত্ত্বেই বলা হয়- মানুষকে সবচেয়ে নিখুঁত করে বানানো হয়েছে। যদি বানানো হয়ও তবু বুঝতেই পারছেন যে প্রথম মানুষ (বাবা আদম) আর এখনকার মানুষ আর একইরকম নাই। আমরা খুঁতওয়ালা হয়ে গেছি।
৩.
Pax6 নামক একটা জিন এমন একটি প্রোটিন তৈরি করে যেটা মানুষের বিকাশমান মস্তিষ্কের কোন অংশটুকু চোখে পরিনত হবে সেই জিনিসটি নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিন ইঁদুর বা জিব্রাফিশ (জিনেটিক পরীক্ষায় বহুল ব্যবহৃত দুটি জীব) এও একই কাজ করে। কিন্তু এই দুইটি প্রাণীতে যেই Pax6 থাকে সেটা মানুষের প্রোটিনটি থেকে মাত্র ৪ টি এমিনো এসিডে পৃথক (প্রতি ১০০ টার মধ্যে)। কিন্তু ঝামেলা হইলো মানুষ, ইঁদুর এবং জিব্রাফিশ সবাই একসময় একই জীব ছিল ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে। অর্থাৎ এই ৪০০ মিলিয়ন বছরে জিনটির তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নাই। এমনকি তারও আগে আমাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া মাছির চোখেও জিনটি একইভাবে কাজ করে। আসলে Pax6 জিনের মত আরও অনেকগুলি জিনই এভাবে বিভিন্ন জীবে সংরক্ষিত। যদিও আমাদের ডিএনএ নিয়মিতভাবে ভুল বিন্যাসে প্রতিলিপি তৈরি করে এবং তার ফলে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়ে ভিন্ন প্রজাতির জীবের উদ্ভব হয়।
তাহলে এসব জিনে পরিবর্তন টা কি ইচ্ছাকৃতভাবে কম হয়েছে? ব্যাপারটা ঠিক ওরকমভাবে চিন্তা করলে ভুল হবে। আসলে জিনটিতে নিশ্চয়ই অন্যান্য জিনের মতই একই গতিতে পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের কমন আদিজীব (ইঁদুর, মৎস, মানুষের) থেকে। হয়তো প্রোটিনটির সবগুলি এমিনো এসিডেই পরিবর্তন হয়েছে কালের সঙ্গে সঙ্গে, বলা যায় পরীক্ষিত হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। তবে যেসব জীবে জিনটিতে বেশি পরিবর্তন হয়েছে তারা সম্ভবত টিকে থাকতে পারেনি। শুধুমাত্র এই জিনটির বিন্যাস অক্ষত থাকা জীবগুলিই বেঁচে ছিল। তাই আমাদের সঙ্গে ইঁদুরের জিনটির তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায়না। চোখতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তাইনা? আণবিক পর্যায়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন কিভাবে হতে পারে তার একটা দারুন উদাহরণ এটি।
Leave a Reply