পরমাণুর অভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ-২

internet connection school technology
Photo by Tara Winstead on Pexels.com

পরমাণুর অাভ্যন্তরীন মহাবিশ্বে ভ্রমণ
মূল: আইজ্যাক আসিমভ
অধ্যায়-১
অনুচ্ছেদ-২: মৌলিক পদার্থ

এই বিশ্ব কী দিয়ে তৈরি তা ভেবে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা চমৎকৃত হতেন। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় এটি অগণিত বিভিন্ন ধরনের বস্তু দিয়ে তৈরি কিন্তু বিজ্ঞানীরা সবসময়ই এই উপাদানগুলোকে সরলীকরনের তাগিদ অনুভব করে আসছেন। বিজ্ঞানীদের কাছে সবসময়ই অনুভূত হয়ে এসেছে যে, এই বিশ্ব কিছু সরল ভিত্তিমূলক উপাদান দিয়ে গঠিত এবং বিশ্বের সবকিছু সেই সরল ভিত্তিগত উপাদানগুলোর বিভিন্ন রকম রূপভেদ এবং সংমিশ্রণ।

খুব সম্ভবতঃ থ্যালেস (Thales, ৬৪০ -৫৪৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) ছিলেন প্রথম গ্রীক দার্শনিক যিনি মতামত দিয়েছিলেন যে পানিই হচ্ছে এই বিশ্বের সকল বস্তুর মূল ভিত্তি যা দিয়ে সকল বস্তু তৈরি হয়েছে। অপর আরেকজন ব্যক্তি, এনাক্সিমেনেস (Anaximenes, ৫৭০-৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ), ভেবেছিলেন এই মূল ভিত্তিটি হচ্ছে বায়ু। এমনকি আরো একজন দার্শনিক যার নাম হেরাক্লিটাস (Heraclitus, ৫৩৫- ৪৭৫ খৃষ্টপূর্বাব্দ) বলেছিলেন আগুনই হচ্ছে সেই বস্তু যা সকল বস্তুর মূল ভিত্তি। একইভাবে আরো অনেকেই অনেক কিছু প্রস্তাব করেছিলেন।

Illustrerad Verldshistoria band I Ill 107.jpg
গ্রীক দার্শনিক খ্যালেস

এইসব প্রস্তাবনার কোনোটিকেই বস্তুর মূল ভিত্তি বাছাই করার কোনো উপায় ছিলো না কেননা এর কোনো বাস্তব ও যৌক্তিক প্রমাণ কেউ দিতে পারেন নি। অবশেষে গ্রীক দার্শনিক এম্পেডোক্লেস (Empedocles , ৪৯৫ – ৪৩৫ খৃষ্টপূর্বাব্দ) এই বিষয়টির নিষ্পত্তি করেছিলেন আপোষের মাধ্যমে। তিনি এই বিশ্বের সকল বস্তু কয়েকটি মৌলিক বস্তু আগুন, বায়ু, মাটি এবং পানি দিয়ে গঠিত বলে প্রস্তাব করেন। এর সাথে এরিস্টটল ইথার (aether, একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ প্রজ্জলিত) নামের আরেকটি মৌলিক ভিত্তি যুক্ত করেন যা আকাশে দৃশ্যমান বিভিন্ন উজ্জল স্বর্গীয় বস্তু গঠনের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এসব ভিত্তিগত বস্তুসমূহকে ইংরেজিতে element এবং বাংলায় মৌলিক পদার্থ বা মৌল নামে ডাকা হয়। যারা মৌলিক পদার্থের ধারনা করেছেন এবং একই সাথে যারা পরমাণুবাদী তাঁদের কাছে সবমিলিয়ে মনে হতে থাকে যে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলো ভিন্ন ভিন্ন, অর্থাৎ চার ধরনের মৌলিক পদার্থ আগুন, বায়ু, পানি এবং মাটির জন্য চার ধরনের পরমাণু আছে এবং সেই সাথে পঞ্চম একধরনের পরমাণু আছে স্বর্গীয় ইথারের জন্য। মাত্র চারধরনের পরমাণুই পৃথিবীর যাবতীয় বৈচিত্র্যময় বস্তু গঠনের জন্য দায়ী বলে চিন্তা করা হয়। এই বিষয়টি অনুধাবনের জন্য আমাদের শুধু এইটুকু অনুমান করে নিতে হবে যে, চারধরনের পরমাণুর বিভিন্ন অনপাতের এবং বিভিন্ন বিন্যাসের কারনের বিভিন্ন বস্তু তৈরি হয়ে থাকে। সর্বোপরি, আমদের ইতিমধ্যেই এই অভিজ্ঞতা আছে যে, মাত্র ২৬ টি বর্ণ এবং একটি ফুলস্টপ ও একটি ড্যাশ দিয়ে আমরা ইংরেজিতে লক্ষ লক্ষ শব্দ তৈরি করে ফেলতে পারি।

যা-হোক, চারপ্রকার (কিংবা পাঁচ) মৌলিক পদার্থের মতবাদটি ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসতে লাগল যখন পরমাণুবাদ আরো অগ্রবর্তী হয়ে উঠল। ১৬৬১ সালে বয়েল ‘The Skeptical Chemist’ (সন্দেহপ্রবণ রসায়নবিদ) নামের বইতে লেখেন, কী কী মৌলিক পদার্থ দিয়ে পৃথিবী গঠিত তা অনুমান করে নেওয়ার কোনো তাৎপর্য নেই। আমাদেরকে সেগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করতে হবে। যে বস্তুকে রাসায়নিক ভাবে বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত সরল কোনো উপাদান পাওয়া যাবে না সেটিই হচ্ছে মৌলিক পদার্থ। আর যে বস্তুকে রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করে একাধিক সরল উপাদান পাওয়া যাবে তা কখনো মৌলিক পদার্থ হবে না।

তাত্ত্বিকভাবে এই ধারনা ছিলো বিতর্কের উর্দ্ধে। কিন্তু ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করা খুব সহজ ছিলো না। দেখা গেলো যে কিছু বস্তুকে রাসায়নিক ভাবে বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে না এবং ফলশ্রুতিতে মৌলিক বলে ধরে নিতে হলো কিন্তু রসায়নের অগ্রগতির ফলে পরবর্তীতে সেগুলোকেও বিশ্লেষণ করা গেলো। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যখন একবস্তুকে ভেঙ্গে অপর বস্তু পাওয়া যায়, তখন সবসময় বোঝাও যায় না কোন বস্তুটি অপেক্ষাকৃত সরল। এতদসত্ত্বেও, বয়েলের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন শতাব্দী পর্যন্ত রসায়নবিদগণ মৌলিক পদার্থসমূহ খুঁজে বের করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। পরিচিতি মৌলিক পদার্থগুলোর উদাহরণের মধ্যে পড়ে সোনা, রূপা, লোহা, টিন, অ্যালুমিনিয়াম, ক্রোমিয়াম, সীসা এবং পারদ। গ্যাসের মধ্যে হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন হচ্ছে মৌল। পূর্বের ধারনা ভেঙ্গে দিয়ে দেখা গেলো বায়ু, পানি, মাটি এবং আগুন কোনো মৌলিক পদার্থ নয়।

বর্তমান সময়ে ১১৫ টির মত মৌল আমাদের পরিচিত, যার মধ্যে ৯২টি প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীতে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং বাকি ২৩ মৌল হয় নগন্য পরিমানে উৎপন্ন হয় অথবা গবেষণাগারে তৈরি করা যায়। এর মানে হচ্ছে ১১৫ টি ভিন্ন ভিন্ন মৌল সম্বন্ধে আমরা অবগত।

(সবগুলো পর্ব একত্রে)

ইমতিয়াজ আহমেদ
পোস্টডক্টরাল গবেষক: Green Nanomaterials Research Center Kyungpook National University Republic of Korea.