অনুসন্ধিৎসু চক্রের সদস্য খুকি আপু যিনি ডার্ক এনারজি নিয়ে পি.এইচ.ডি. করছে, তিনি একদিন আমাকে টেকনোলজির আদি ঘটনার কিছু কাজের ভিতর বেলুন নিয়ে ঘাটতে বললেন। হালকা পাতলা একটা ঝটিকা অভিযান চালালাম কিছু বই এর উপরে।
আমি বেলুনের নানা কাজ দেখে তো হতবাক! আমরা অনেকেই আকাশ জয়ের কাহিনীতে বেলুন এর অবদানের কথা জানি, প্রয়োজনে নানা আকৃতির বেলুন দিয়ে ঘর সাজিয়েছি। কিন্তু বেলুন যে বিজ্ঞানের অনেক জটিল পরীক্ষায় এখনও ব্যবহার হয় সেটা আমার জানা ছিল না।
বেলুন বলতে আমরা গ্যাসীয় পদার্থ দ্বারা পূর্ণ পাতলা বস্তুর একটি ছিদ্রহীন বদ্ধ আস্তরণ বোঝাই। অনেক সময় আমরা ঊর্ধ্ব আকাশে কিছু তোলার জন্য বেলুন ব্যবহার করে থাকি। আকাশে বেলুন উপরে উঠার জন্য বায়ুর প্লবতা দায়ি। এক্ষেত্রে বেলুন আর্কিমিডিস এর নীতি মেনে চলে । এ নিয়ম অনুযায়ী বেলুনের ওপর ঊর্ধ্বমুখী প্লবতার মান বেলুন কর্তৃক অপসারিত বায়ুর ওজনের সমান। এই পর্যন্ত ৫৩ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বেলুন ওঠানো সম্ভব হয়েছে।
বেলুন কি দিয়ে তৈরি হয় ? এই প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় বেলুন রাবার , প্ল্যাস্টিক দিয়ে। কথা সত্য কিন্তু শুধুমাত্র এই ২টি উপাদান দিয়ে বেলুন প্রস্তুত করা হয় না। এর উপাদান গুলঃ রাবার, প্ল্যাস্টিক, কাপড়, নাইলন, ল্যাটেক্স, পলিক্লোরোফিলেন ইত্যাদি ।
উপাদান তো জানলাম এবার প্রকারভেদ জানাতে হবে না! অনেক বলবে এটা আবার জানার কি হল। না হলে র বলছি কি । কিছু পরিচিত ও কিছু অপরিচিত প্রকারভেদ আছে ।
১. হট এয়ার বেলুন
২. এয়ার শিপ বেলুন
৩. জিরো প্রেসার বেলুন
৪. সুপার প্রেসার বেলুন
১. উষ্ণ-বায়ু বা হট এয়ার বেলুন এরসাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। ম্যাগাজিন বা টি.ভি.তে দেখা যায় বড় এক বেলুনের নিচে একটা ঝোলানো ঝুড়িতে কয়েকটি লোক, তারা আবার বার্নার ব্যবহার করে ওপরে বেলুনের ভেতরের বাতাসকে গরম করছে। এটি মূলত অগ্নি রোধক মজবুত নাইলন দিয়ে তৈরি। বেলুনের ভেতরের গরম বাতাসের ঘনত্ব বাইরের বাতাসের ঘনত্বের চাইতে কম হওয়ায় আর্কিমিডিসের নীতি অনুযায়ী উষ্ণ-বায়ু বেলুন ওপরে ওঠে। ১৭৮৩ সনে ফ্রান্সে মন্ট্গলফিয়ের ভাতৃদ্বয় মানুষ-পরিবাহী উষ্ণ-বায়ু বেলুনের প্রবর্তন করেন। আবার ফানুস যা কিনা কাগজ দিয়ে তৈরি তাও কিন্তু উষ্ণ-বায়ু বিভাগের অন্তর্গত। প্রায় দুই হাজার বছর আগে চীন দেশে ফানুসের ব্যবহার শুরু হয়। উষ্ণ-বায়ু বেলুন মূলতঃ ভ্রমন, আকাশে চড়ার আনন্দ, ইত্যাদির জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে বিমানের প্রবর্তনের আগে যুদ্ধক্ষেত্রে ও ভূমি জরীপের কাজে এর ব্যবহার ছিল।
২. এয়ারশিপ বা বায়ুযান জাতীয় বেলুনের ইতিহাস খুবই বিচিত্র। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন আকাশপথ ভ্রমণের জন্য এটাই একমাত্র পথ। এই ধরণের বায়ুযানের নানান নাম আছে – এয়ারশিপ, ডিরিঝাবেল, জেপেলিন, ব্লিম্প, ইত্যাদি। প্রথম মহাযুদ্ধে বোমা ফেলা বা গোয়েন্দাগিরি করবার জন্য জার্মানী ও যুক্তরাজ্য উভয়েই বায়ুযানের ব্যাপক ব্যবহার করেছে। এই ধরনের বায়ুযান চোঙ্গাকৃতি আকারের যার ভেতর হাল্কা গ্যাস দিয়ে ভরা থাকত। নিচে থাকত চেম্বার এবং সামনে পিছনে পাখা লাগান থাকত দিক পরিবর্তন করার জন্য। কিন্তু পৃথিবীতে হিলিয়ামের স্বল্পতার কারণে খুবই দাহ্য হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হত যার কারণে এই ধরণের বায়ুযান দুর্ঘটনার শিকার হত। ১৯৩৭ সনে হিনডেনবার্গ নামক একটি যাত্রীবাহী বায়ুযান জার্মানী থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পারি দিয়ে নিউ জার্সীতে অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়, আগুনে সেই যানের অনেক যাত্রীই মারা যায়। এর পর থেকে বায়ুযানের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে অনেক দেশে, বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, একে বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করা হয়। বলাই বাহুল্য এই সমস্ত যানে এখন শুধুমাত্র হিলিয়াম ব্যবহার করা হয়।
৩) জিরো প্রেসার বা বেলুন – এই ধরণের বেলুনের ব্যবহার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে শুরু হয়। উঁচু বায়ুমণ্ডলের আবহাওয়া ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক নানা পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে এই বেলুন ব্যবহার করা হয়। ল্যাটেক্স, পলি ক্লোরোফিলেন দ্বারা এই ধরনের বেলুন তৈরি হয়ে থাকে। ল্যাটেক্স হল রাবার গাছ এর কষ যা দ্বারা রাবার বানান হয়।পলি ক্লোরোফিলেন এক ধরনের পলিমার ।
পলিমার এর গঠন
এই ধরনেরবেলুন আকাশের শেষ স্তরে গিয়েও ফেটে যায় না। এর আবরন মাত্র কয়েক মাইক্রন পুরু, বাইরে বায়ুর চাপ খুব কমে গেলেও এটি ফাটে না।
সাধারানতঃ বেতার ও দৃশ্যমান আলো ছাড়া আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করার সময় যা দেখতে পাই তা অনেকটা ছাকনি দিয়ে ছাকার পর যা অবশিষ্ট থাকে তার মত, কেননা অনেক ধরনের রশ্মি থাকে যা কিনা আমাদের বায়ু মণ্ডলে প্রবেশ করে না। এই জন্য মহাকাশ থেকে আসা বিভিন্ন তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দেখতে NASA সহ অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা এই বেলুন ব্যবহার করে। বেলুনের নিচে ডিটেকটর বা টেলিস্কোপ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বায়ুমণ্ডলের ওপর থেকে মহাকাশ থেকে আগত অবলোহিত, অতিবেগুনী, এক্স ও গামা রশ্মি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। এর জন্য এই বেলুনকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার ওপরে উঠতে হয়। এই বেলুন এর সাথে এমন ভালভ থাকে যা কিনা বেলুনটার বাইরের ও ভিতরের চাপের মধ্যের পার্থক্যকে শূন্যের কাছাকাছি ধরে রাখতে সাহায্য করে। তবে রাতের বেলা যখন আকাশ ঠাণ্ডা থাকে তখন গ্যাস ঘনীভূত হয়, বেলুন খানিকটা নিচে নেমে আসে। তখন ঐ বেলুন কে আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে কন্ট্রোলার দ্বারা কিছু ভর(যেমনঃ লোহার গুড়া, বালু, ইত্যাদি ) ফেলে দেওয়া হয়। এই বাড়তি ভরকে ব্যালাস্ট বলে। আবার দিনের বেলা সূর্যের আলোর উষ্ণতায় বেলুন আবার ফুলে উপরের দিকে উঠে। বর্তমানের এই ধরনের বেলুন কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত আকাশে উড়তে পারে।
৪)সুপার প্রেশার বেলুন – যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ যেমন প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন করেছে তাই বেলুনের উন্নয়নও বাদ যায় নি। এর উদাহরণ হল সুপার প্রেশার বেলুন। জিরো প্রেশার বেলুন এবং সুপার প্রেসার বেলুন এদের উভয়ের গঠন উপাদান একই , তবে পার্থক্য হল সুপার প্রেশার বেলুনের বাহিরের চাপ খুব কমেগেলেও ভেতরের গ্যাস এর চাপে এই বেলুন ফাটবে না।এর জন্য একটা বিশেষ ইলাস্টিক উপাদান তৈরি করতে হয়েছে। এই বেলুনে জিরো প্রেশার বেলুনের মত ভেতরের চাপ কমিয়ে দেবার জন্য কোন ভালভ নেই। ধারনা করা হচ্ছে এই বেলুন দিয়ে একটানা কয়েক মাস ধরে উপাত্ত সংরক্ষণ করা যাবে। নাসা, গুগল সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নানা বিজ্ঞান মুলক গবেষণার কাজে এই বেলুন ব্যবহার করা সবেমাত্র শুরু করেছে।
গুগল বিশ্ব ব্যাপি ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি প্রচলনের একটি প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছে যেখানে তারা বেলুনের সাথে রাউটার ঝুলিয়ে দিচ্ছে। এবং সাথে আরও দিচ্ছে নানা যন্ত্রপাতি । এইবেলুন কতটুকু ভর বহন করতে পারে তার শুরু থেকে এই পর্যন্ত জরিপ এই ছকে দেখা যাবে
মঙ্গল গ্রহে যে রোবট পাঠানো হয়েছিল তা অবতরণ করার জন্য সুপার প্রেশার বেলুন ব্যাবহার করেছিল । নিচে তারি ছবি।
মঙ্গলে বেলুন
নানা কাজে এখন মানুষ বিশেষ করে মহাকাশ গবেষণায় সুপার প্রেশার বেলুন বেশি পছন্দ করে কেননা বাতাসের চাপ ও প্লবতার কারণে সুপার প্রেসার বেলুন নিজ স্থান থেকে কম বিচ্যুতি ঘটে যা জিরো প্রেশার বেলুনের বেশি ঘটে। নিচে এর একটি ছবি দেওয়া হল। তবে এটি একটি নতুন প্রযুক্তি, এর ব্যাপ্ক ব্যবহার এখনো শুরু হয় নি।
পরিমার্জন: দীপেন ভট্টাচার্য
Leave a Reply