মানুষের মৃত্যুর কারন নানান রকম। আলোচনার সুবিধার জন্য দুই ভাগে ভাগ করলাম, আত্নহত্যা আর পরহত্যা(মানে খুন, দূর্ঘটনা, রোগ এরকম পরের দ্বারা হত্যা)। কোষের ক্ষেত্রেও একই প্রকারভেদ প্রয়োগ করা যায়। পরহত্যা-মানে কোন কোষ যদি আঘাতজনিত, বিষক্রিয়া কিংবা কোন ধরনের সংক্রমনের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অথবা রক্তের প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যায় তখন তাকে বলে নেক্রোসিস। নেক্রোসিসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানে প্রদাহ এবং পরবর্তীতে নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে কোষের সমাজে নেক্রোসিস যতটা অস্বাভাবিক, অ্যাপপ্টসিস ততটাই স্বাভাবিক।
তবে অ্যাপপ্টসিস নাম যেমনই হোক, কাজে কিছুটা ভদ্র। মরলে মরে, কিন্তু ছড়ায়না। জী হ্যা। কোষের আত্নহত্যার ব্যাপারটাই আসলে অ্যাপপ্টসিস। এই ব্যাপারটা বেশ সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং সহজে বুঝা যায়। অ্যাপপ্টসিসের সাথেও মারামারি-কাটাকাটি জড়িত থাকলেও, মোটেই কোন রকম যন্ত্রনা দেয়না। কেন দেয়না? সেটা ভাবতে থাকুন।
তো ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে? মরা তো এত সহজ না। আবার একটা কোষ! এত ছোট্ট একটা অস্তিত্ব। তার জন্য তো আরও কঠিন। তাই সে ক্যাসপেজ নামের এক এনজাইমকে ভাড়া করে। ক্যাসপেজের মধ্যে কোন দয়া-মায়া নাই। সে এসেই এমন পিটুনি শুরু করে যে কোষের মধ্যেকার মাইটোকন্ড্রিয়া, গলগি, রাইবোজম সব ভেঙ্গে পড়ে। কোষের আকার ছোট হতে থাকে, যন্ত্রনায় সে চিৎকার শুরু করে! কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। পিটুনির ঠেলায় কোষটির দেহে প্রচুর ডিএনএজ(DNAse) এনজাইম তৈরি হয়, যা তার ডিএনএ কে ধ্বংস করে ফেলে। অতঃপর আসেপাশে ওত পেতে থাকা মরাখেকো ম্যাক্রোফেজ এসে মৃত কোষটির সংকুচিত দেহটিকে গায়েব করে দেয়। অপরদিকে নেক্রোসিসের সময় মূলত কোষটা ফুলতে থাকে, ফুলতে ফুলতে একসময় মেমব্রেন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে ভেতরের সব জিনিসপত্র চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে বাজে একটা অবস্থা তৈরি করে। ফ্যাগোসাইটরা বুঝেই উঠতে পারেনা কোথা থেকে পরিষ্কার করা শুরু করব। তাই অনেক ক্ষেত্রেই নেক্রোটিক টিস্যুকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সরানো হয়ে থাকে।
অ্যাপপ্টসিস সাধারনত ঘটে থাকে দৈহিক বৃদ্ধির সাথে সাথে টিস্যু সমূহে কোষের সংখ্যা ঠিক রাখার জন্যে। একে অনেক সময় মাইটোসিসের পরিপূরক বলা হয়। মগজের ক্রমবৃদ্ধির সাথে সাথে দেহ শুধু প্রয়োজনের বেশি কয়েক মিলিয়ন কোষ তৈরি করে। এদের মধ্যে যেগুলো সিনাপ্টিক সংযোগ তৈরি করতে পারেনা, তাদের পরিনতি হয় অ্যাপপ্টসিস। যাতে অন্যান্য কোষ ঠিকমত কাজ করতে পারে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাও এই রকম প্রচুর কোষ তৈরি করে, যার বেশির ভাগেরই পরিনতি হয় অ্যাপপ্টসিস। ভ্রূনের বিকাশের সময়ও অ্যাপপ্টসিস দরকার। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, গর্ভে থাকা-কালীন সময়ে আমাদের হাত এবং পায়ের আঙ্গুল এক ধরনের পর্দার মাধ্যমে যুক্ত থাকে। অ্যাপপ্টসিসের কারনে এই পর্দা গায়েব হয়, এবং আমরা দশটি করে আলাদা প্রত্যংগ পাই। কাটা-ছেড়ার ফলে ক্ষতস্থানে যেই অস্থায়ী ‘স্কার-টিস্যু’ তৈরি হয়, এদের দূর করার জন্যেও অ্যাপপ্টসিস দরকার। আবার যখন একটি কোষ বুঝতে পারে যে, ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত কিংবা কোন জিনে মিউটেশন ঘটেছে। তখন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া রোধে অ্যাপপ্টসিস ঘটতে পারে।। এসব ছাড়াও বহু শারীরতাত্বীয় এবং রোগতাত্বীয় পরিস্থিতি রয়েছে যার কারনে অ্যাপপ্টসিস ঘটে থাকে। সব কোষ এ ধরনের সংকেতের প্রতি সবসময় সমান সংবেদনশীল নয়। তাই, অ্যাপপ্টসিস সংক্রান্ত কিছু জটিলতা দেখা যায়। কখনো সুস্থ কোষ নিজেদের নষ্ট করে ফেলে, অথচ যেসব কোষের ঝামেলা থাকে তারা ঠিকই বেঁচে রয়। কখনো কখনো দেখা যায় কম মাত্রায় তাপ, তেজস্কৃয়তা, অক্সিজেন স্বল্পতা, ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ অ্যাপপ্টসিসের দিকে নিয়ে যায়; আবার ঠিক একই জিনিস বেশি মাত্রায় হয়ে গেলে সেটা নেক্রোসিসের দিকে চলে আসে।
অস্বাভাবিক অ্যাপপ্টসিসের কারনে নানান রোগ দেখা যায়। উদাহরন হিসেবে বলা যায় ক্যান্সার,এইডস, ইশকেমিয়া,আলঝেইমার, পার্কিনসন্স, মোটর নিউরন কিংবা হান্টিংটন রোগ এর নাম। কোনটার কারন কম অ্যাপপ্টসিস, কোনটার কারন বেশি অ্যাপপ্টসিস। ক্যান্সার একটি উদাহরন যেখানে স্বাভাবিক কোষ চক্রের ছন্দপতন ঘটে এবং বেশি বেশি কোষ তৈরি হতে থাকে অথবা খারাপ কোষের অপসারন কমে যায়। কার্সিনোজেনেসিস(স্বাভাবিক কোষের ক্যান্সার কোষে রূপান্তর) পর্যায়ে অ্যাপপ্টসিস দমিয়ে রাখাকে ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারন ধরা হয়। টিউমার কোষ নানান কুবুদ্ধি খাটিয়ে নিজেদের অ্যাপপ্টসিস থেকে বাঁচিয়ে রাখে। অ্যান্টি-অ্যাপপ্টটিক প্রোটিন নিঃসরন করে, টি-সেল রিসেপ্টর নষ্ট করে, এমনকি জটিল(এফএএস লিগান্ড মেডিয়েটেড কাউন্টার অ্যাটাক) ফাঁদে ফেলে টিউমারে প্রবেশ করা শ্বেতকণিকার অ্যাপপ্টসিস ঘটিয়ে দেয়। অতিরিক্ত অ্যাপপ্টসিসের ফলে যেসব রোগ হয় তেমন একটি হল এইডস। এই রোগে টি-সেলের অ্যাপপ্টসিস বেড়ে যায় এবং পরবর্তীতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। প্রেসেনিলিন নামক প্রোটিনে মিউটেশনের ফলে ইহা জমাট বাধা অ্যামাইলয়েড বিটা তৈরি করে যার ফলে নিউরনে অ্যাপপ্টসিস বেড়ে যায়। এটাকে বলে আলঝেইমার।
তো বুঝতেই পারছেন অ্যাপপ্টসিস কত্ত গুরুত্বপূর্ন একটা ব্যাপার। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার স্যাপার থেকে মারাত্নক কিছু রোগের সাথেও অ্যাপোপ্টসিস জড়িত। তাই বৈজ্ঞানিকরা এটা নিয়ে জোড়েসোরে গবেষনা করছেন। অ্যাপোপ্টসিসের নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতিটা ভালোভাবে ধরা গেলে সেটা চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখবে। এইবার চলেন একটু অগুরুত্বপূর্ন ব্যাপারের দিকে নজর দেই। সেই Bios and logos থেকে শুরু। এখন পর্যন্ত দেখে আসছি বায়োলজিস্টরা ব্যাবহার করা টার্মিনোলজির উৎস এবং অর্থ কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরন করে থাকেন। জর্ডান ইয়ারন(Jordan Yaron) নামের একজন গবেষক এর লেখায় প্রথম জানতে পারি বেশির ভাগই APOPTOSIS শব্দটাকে ভূল উচ্চারন করেন। তার এটা নিয়ে তার ততটা মাথা ব্যাথা ছিলোনা, কারন আমজনতার কথায় কি আসে যায়। কিন্তু আমেরিকান সোসাইটি অফ সেল বায়োলজির ২০১৩ সালের কনফারেন্সে গিয়ে তারা মাথা ব্যাথা আসলেই বেড়ে যায়। কারন তিনি দেখেন সেখানকার বেশিরভাগ সায়েন্টিস্টেরও APOPTOSIS উচ্চারন ভূল। বানান দেখে কি মনে হয়, এর উচ্চারন কি হবে? A-POP-TOSIS এরকম কিছুই প্রথমে মাথায় আসে। এর উৎস হিসেবে যুক্তিও দেয়া যায় ‘Because the cell is POPPING!’। তবে প্রকৃত পক্ষে POPPING নয়, এটা মূলত DROPING OFF। গ্রীক ভাষায় APOPTOSIS ফুল থেকে পাপড়ি, ডাল থেকে পাতার ঝরে পরা বুঝাতে ব্যাবহার হয়। এবং এর PTOSIS অংশে P এর উচ্চারন হবেনা। যেই কারনে PTOLEMY হয় টলেমি, সেই কারনেই PTOSIS হবে শুধু টসিস। তাই APOPTOSIS এর উচ্চারন অ্যাপোটসিস!
তথ্যসূত্রঃ
১। Apoptosis: A Review of Programmed Cell Death
২। Apoptosis wikipedia
৩। Apoptosis: a critical process in homeostasis
৪। “A-POP-TOSIS” Jordan Yaron’s blogpost
Leave a Reply