…দ্বিতীয় পর্বের পর থেকে।
কিভাবে বোঝে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কোথায়:
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কোথায় সেটি বের করতে বিজ্ঞানীরা অংকের সাহায্য নেন। অত্যন্ত চমৎকার একটি উপায়ে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করা হয়। সিসমোমিটারে প্রাইমারী তরঙ্গ ও সেকেন্ডারী তরঙ্গ রেকর্ড হবার সাথে সাথে সময়ও রেকর্ড হয়। এ থেকে বোঝা যায় কোন তরঙ্গ কতটুকো দেরিতে এসে পৌছেছে। প্রাইমারী তরঙ্গ ও সেকেন্ডারী তরঙ্গের একটি নির্ধারিত বেগ আছে। সেকেন্ডারী তরঙ্গের বেগ প্রাইমারী তরঙ্গের প্রায় অর্ধেক[৬০%] । প্রারম্ভিক সময়ে কিন্তু দুটি তরঙ্গ একই সময়ে বিমুক্ত হয়। যাত্রা পথে একটু একটু করে তাদের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সিসমোমিটারে কত সময় পর দুটি তরঙ্গ ধরা পড়েছে সেটা হিসাব করে এই সময়ে কতটুকো দূরত্ব আগে তারা একসাথে থাকতে পারে এটা বের করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় শুধু পাওয়া যায় মাপক যন্ত্র থেকে কত দূরত্বে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে।[৩] কিন্তু ঠিক কোন দিকে কোথায় হয়েছে সেটা জানা যায় না। গ্রাফ যদি ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের ফল দেয় তাহলে যন্ত্রের চারিদিকেই ১০০ কিলোমিটার আছে। ঠিক কোনদিকে হয়েছে সেটা জানতে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন স্থানে রাখা কয়েকটি সিসমোমিটারের রেকর্ড হিসাব করেন। মিটারে রেকর্ড করা দূরত্ব অনুযায়ী প্রত্যেককে কেন্দ্র করে বৃত্ত আঁকা হয়। প্রত্যেকটি বৃত্তের পরিধি যে একটা সাধারণ বিন্দুতে ছেদ করবে সেটাই হবে ভূমিকম্পের সঠিক উৎপত্তিস্থল। এখানেও ব্যবহার হচ্ছে গণিত(জ্যামিতি)। গণিতের মাঝে কোনো কারচুপি নেই। গণিতে নয়-ছয় হয়না। তাই একদম সূক্ষ্মভাবে এবং সঠিকভাবে বলে ফেলা যায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি কোথায় হয়েছে।
চিত্র: তিনটি বৃত্তের সাধারণ ছেদবিন্দুতে অবস্থান করছে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র।
তবে এই ক্ষেত্রে যেটা করতে হয় কমপক্ষে তিনটা বৃত্ত নিতে হবে। তার কমে হলে সঠিক অবস্থান পাওয়ার সম্ভাবনা একদমই কমে যাবে। তিনটা বৃত্ত কেন নিতে হবে সেটা মনে হয় খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে দুটি বৃত্তের সাধারণ ছেদবিন্দু একাধিক হতে পারে। একাধিক বিন্দু হতে একটা বিন্দুতে নিশ্চিত হতে হলে তিনটা বা তারও অধিক বৃত্ত কল্পনা করতে হয়।
তরঙ্গের তীব্রতা, তরঙ্গের দৈর্ঘ্য সহ আরও কয়েকটি কারণ হিসেব করে মূল কেন্দ্র বের করা হয়।
ভবিষ্যদ্বাণী
অন্যসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম খবর বিজ্ঞানীরা দিতে পারলেও ভূমিকম্পের আগাম খবর বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন না। মানুষের প্রযুক্তি এখনো এত উন্নত হয় নি যার ফলে ভূমিকম্পের ঠিক ঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে। মাঝে মাঝে হয়তো দৈবভাবে দু-একটা ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যেতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না।
পশুপাখিদের মাঝে আবার ভূমিকম্পের আগে আগে একধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। হয়তো তারা কোনোভাবে জানতে পারে ভূমিকম্পের আগাম খবর। হয়তো তাদের এমন কোনো ইন্দ্রিয় আছে যেটা ভূমিকম্পের আগে সংঘটিত আলামত দেখে বুঝতে পারে ভূমিকম্প হবে কখন। হাস পানি থেকে উঠে যায়, মুরগী গাছের উপরে উঠে বসে থাকে, কুকুর বিরামহীন ঘেও ঘেও করে। কিন্তু তারা সত্যিই আগাম খবর পায় কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। হয়তো তারা পেতেও পারে যেটা কিভাবে কাজ করে তা মানুষের জানা নেই। যদি জানা থাকতো তবে তাদের ব্যাবহার করা বিজ্ঞানটাকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি তৈরি করা হতো এবং মানুষেও পারতো আগাম জেনে নিতে।
চিত্র: ভূমিকম্পের আগে আগে হাস, মুরগী পানি থেকে উপরে গাছে ওঠে বসে থাকে।
তবে এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের এক্সট্রা ধন্যবাদ দিতেই হবে কারণ পত্র পত্রিকা টেলিভিশনে যখন ভূমিকম্প নিয়ে খবর প্রচার করা হয় তখন সাংবাদিকেরা প্রথমে বিজ্ঞানীদের কাছেই আসেন সঠিক তথ্যটা কি জানার জন্য।
সুনামি:
ভূমিকম্প যখন সমুদ্রের তলদেশে হয় তখন মাটির তরঙ্গের প্রভাবে পানির মাঝেও বিশাল আকারের তরঙ্গ বা ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্পের তীব্রতা যদি কম হয় তাহলে এই ঢেউ এমনিতেই সেরে যায়। শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে পানির আন্দোলনও হয় শক্তিশালী। আর এই শক্তিশালী আন্দোলন যদি মাঝ সমুদ্রে না হয়ে মানুষ বসবাসের এলাকার কাছাকাছি হয় তাহলে এটি ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়ায়। কথা নেই বার্তা নেই ৫০ ফুট ৬০ ফুট উঁচু উঁচু ঢেউ এসে হঠাৎ এসেই আঘাত হাতে অপ্রস্তুত লোকালয়ে। অকস্মাৎ বন্যা। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় তাতে। এটাই সুনামি নামে পরিচিত। ভাবা যায় ৫০ ফুট উঁচু একটা ঢেউ এগিয়ে আসছে যেটি কয়েক বিলিয়ন টন পানির ওজনের সমান শক্তি বহন করে। এমন পরিমাণ শক্তি নিয়ে আঘাত করে নিমেষেই বিশাল বিশাল অট্টালিকা গুড়িয়ে ফেলে। মূলত সুনামি ভূমিকম্পের একটা ফল। এটা যেন প্রকৃতির এমন এক খেলা যার কাছে মানুষ একদমই অসহায়। সুনামি নিয়ে পরবর্তীতে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লিখার ইচ্ছা আছে।
চিত্র: সমুদ্র থেকে লোকালয়ের দিকে অগ্রসরমান সুনামি।
শেষ কথা
মানবজাতি একটা সময় এমন অবস্থানে ছিল যেখানে প্রকৃতি যেভাবে চালাতো সেভাবেই চলতে হতো। প্রকৃতি যে জায়গায় ফল-ফসল উৎপন্ন করত যাযাবর মানুষ মত সে জায়গায় যেত। সেখানকার খাবার শেষ হলে আর সেখানে থাকা যেত না। প্রকৃতি গরম দিলে গরমে থাকতে হত, শীত দিলে থাকতে হতো শীতেই। আস্তে আস্তে মানুষ প্রকৃতর শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। মুক্ত হবার পরে উল্টো প্রকৃতিকে শাসন করেছে। গরমে ফ্যান চালিয়ে দিচ্ছে, শীতে সোয়েটার। জমিতে চাষাবাদ। ভঙ্গুর নদীর পানিকে বিদ্যুতে, বাতাসকে শক্তিতে। এখনকার সময়ে আমরা প্রকৃতির যে যে জিনিসকে ব্যাবহার করে চলছি একটা সময় সেগুলোই ছিল মানুষের জন্য অভিশাপ। আজ যেটা মানুষের জন্য অভিশাপ হতে পারে দূর ভবিষ্যতে সেটাই হয়ে যেতে পারে মানুষের জন্য অপার এক সম্ভাবনা। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বসে থাকতেই পারি এমন একটা দিন হয়তো মানুষের আসবে যেদিন মানুষ ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারবে এমনকি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। শক্তির কথাই ধরা যাক না, সুনামিতে যে কয়েক বিলিয়ন টন পানির শক্তি নিয়ে অগ্রসর হয় সেটা বগলদাবা করতে পারলে সমগ্র পৃথিবীর কয়েক বছরের খোরাক হয়ে যাবে! মানুষের পক্ষে কোনোকিছু অসম্ভব বলে মনে হয় না। শুধু দুদিন আগে কিংবা দুদিন পরে।
নোটঃ
[১] প্রাণিজগতের বৈশিষ্ট্যটাই এরকম যারা শক্তিশালী তারাই ক্ষমতার দাপটে টিকে থাকবে এবং নিজের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে অন্য কোনো প্রজাতিকে নিজের চেয়ে বড় হতে দিবে না। শক্তিশালী প্রজাতি দুর্বলদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখবে এবং তাদেরকে নিজের কাজে ব্যাবহার করতে থাকবে। যেমন মানুষ নিজের ক্ষমতাবলে প্রকৃতির সমস্ত জিনিসকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষের সবচাইতে বড় শক্তি তার মস্তিষ্ক।
তথ্যসূত্র:
- সায়েন্সটেক (মাসিক) : অক্টোবর ২০১২
- http://earthquake.usgs.gov/learn/kids/eqscience.php
- রয়টার্স
- ডিজেসটার প্ল্যানেট : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডকুমেন্টারি
- একটুখানি বিজ্ঞান : মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- টেকটোনিক চলন, ভূমিকম্প প্রবণতা ও সূচকীয় বিধি : ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
- Wikipedia : Earthquake
- মাধ্যমিক ভূগোল
- আমার পৃথিবী আমার পরিবেশ : সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট
দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী জিরো টু ইনফিনিটি এপ্রিল ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
Leave a Reply