আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশে কিছু জিনিস হল জীব, যাদের জীবন আছে। আর কিছু জিনিস জড়, যাদের জীবন নেই। জীবের মধ্যে কিছু আছে যাদের আমরা খালি চোখে দেখি, যেমনঃ আমাদের বাবা-মা, ভাই-বন্ধু, দেয়ালের পোকা,পাশের বাসার বিড়াল, পথের কুকুর ইত্যাদি। আবার কোন কোন জীব আছে যাদের খালি চোখে সবসময় দেখিনা, যেমনঃ স্টোর রুমের ইদুর, বইয়ের সেলফের তেলাপোকা ইত্যাদি- কিন্ত মাঝে মাঝে এদের সাথে দেখা হয়ে যায়!
তবে কিছু জীব আছে যাদের আসলেই খালি চোখে দেখা অসম্ভব, কিন্তু তারা চোখের সামনেই থাকে। আপনার হাতে,পায়ে, পেটের ভিতরে, সারা ঘরে, সব জায়গাতেই তারা রয়েছে। তাদেরকে বলা হয় অণুজীব। নানান রকম অণূজীবের অন্যতম হল ব্যাক্টেরিয়া। আঁতকে উঠার কিছু নেই, ব্যাক্টেরিয়া মানেই রোগ বালাই নয়। আমাদের জানা ব্যাক্টেরিয়াগুলোর মধ্যে ১ শতাংশেরও কম হল ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া।
তো ব্যাক্টেরিয়া খায় কি(যদিও এটাকে ঠিক খাওয়া বলা যায়না)? তাদের খাদ্যতালিকায় শর্করা, শ্বেতসার থেকে শুরু করে সূর্যের আলো পর্যন্ত সবই রয়েছে! আবার সব ব্যাক্টেরিয়াই যে সব খায়, এমন কিন্তু নয়। এদের মধ্যে হাজার রকমের বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক কালে এমন কিছু ব্যাক্টেরিয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে, আজব খাবারের রুচি-বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষকে বেশ আমোদিত করেছে।
পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণের থেকে ব্যাতিক্রম এই ব্যাক্টেরিয়া বিশুদ্ধতম শক্তি- ইলেক্ট্রন খেয়ে বেঁচে থাকে। তারা এই ইলেক্ট্রন খায় তথা গ্রহন করে পাথুরে, খনিজ কিংবা ধাতব পৃষ্ঠতল থেকে। উদাহরন হিসেবে Shewanella এবং Geobacter প্রজাতির কথা বলা যায়, তবে জীববিজ্ঞানীরা পাথুরে পরিবেশ এবং সামুদ্রিক তলদেশ এমনকি স্বর্ণের খনি থেকে ইলেক্ট্রনের টোপ দিয়ে আরো বিচিত্র ইলেকট্রনখোর ব্যাক্টেরিয়ার প্রজাতি শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।
ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার কেনেথ নেলসন বলেছেনঃ এতে অবাক হবার কিছু নেই। জীবন মূলত ইলেক্ট্রনের প্রবাহ। আমরা শর্করা খাই যাতে অতিরিক্ত ইলেক্ট্রন থাকে, আমাদের কোষ শর্করা ভাঙ্গে এবং এই ইলেক্ট্রন নানা জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ইলেক্ট্রন আসক্ত অক্সিজেনে পৌছে যায়। যেই অক্সিজেন নিঃশ্বাসের দ্বারা গ্রহন করি। এই প্রকৃয়ায় এটিপি তৈরি হয়, যা মোটামুটি বেশির ভাগ জীবিত সত্বায় শক্তির আধার হিসেবে কাজ করে।
তাই, জীবনকে সচল রাখার জন্য ইলেক্ট্রনের প্রবাহ দরকার। কারো গলা টিপে ধরলে সে কিছুক্ষনের মধ্যে মারা যায়, কারন তার অক্সিজেনের সর্বরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং তার দেহে ইলেক্ট্রন প্রবাহিত হতে পারেনা।
এই ‘বৈদ্যুতিক ব্যাক্টেরিয়া’র আবিষ্কার এটাই প্রমাণ করে যে কোন ‘সুগারি মিডলম্যান’ এর ভরসা ছাড়াও বিশুদ্ধতম শক্তি ইলেক্ট্রন ব্যাবহার করে জীবন টিকতে পারে। নেলসনের দল এখন সরাসরি ইলেক্ট্রোডের গায়ে এই ব্যাক্টেরিয়া চাষ করছেন এবং শর্করা কিংবা অন্য কোন পুষ্টি বাদে শুধু এবং শুধুমাত্র ইলেক্ট্রনের সাহায্যে এদের বাঁচিয়ে রাখছেন। তার প্রথমে সমুদ্র্যের তলদেশ থেকে পলি সংগ্রহ করেন, তারপর ল্যাবে নিয়ে এর মধ্যে ইলেক্ট্রোড ঢুকিয়ে দেন।
সংগ্রহ করা পলির প্রাকৃতিক ভোল্টেজ পরিমাপ করার পর, এতে সামান্য উচ্চ ভোল্টেজ এবং নিম্ন ভোল্টেজের ইলেক্ট্রোড দেয়া হয়। এর ফলে দেখা যায়, ব্যাক্টেরিয়া উচ্চ ভোল্টেজের ইলেক্ট্রোড থেকে ইলেক্ট্রন গ্রহন করে নিম্ন ভোল্টেজের ইলেক্ট্রোডে ইলেক্ট্রন ত্যাগ করে একটি তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করছে। এই ইলেক্ট্রনের প্রবাহই গবেষকদের কাছে ইলেক্ট্রনখোড় ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্বের প্রমাণ।
বিশুদ্ধতম শক্তি ইলেক্ট্রন গ্রহন করে বেঁচে থাকা ছাড়াও এদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা গবেষকদের আগ্রহী করে তুলেছে। এমনকি নাসাও তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, কারন যারা সমুদ্র/মাটির গভীরে অন্ধকার এবং অক্সিজেন বিহীন পরিবেশে সামান্যতম শক্তি ব্যবহার করে বেঁচে থাকে। তাদের মত আরো কেউ এই সৌরজগতের অন্য কোন প্রান্তে থাকতেই পারে।
পৃথিবীতেই অবশ্য এই ব্যাক্টেরিয়াকে নানা কাজে লাগানো সম্ভব হতে পারে। যেমন, কোন বায়োমেশিন তৈরি করা যাবে-যা বাড়তি কোন পুষ্টির যোগান ছাড়াই নিজের চারপাশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে পয়ঃপ্রনালী কিংবা মাটির গভীরের দূষিত পানি পরিষ্কার করবে। আবার, কিছু কিছু ব্যাক্টেরিয়া কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা ‘বায়োকেবল’ তৈরি করতে পারে, যা তড়িৎ পরিবাহিতা বহুল ব্যবহৃত তামার চেয়ে কম নয়। ধারনা করা হচ্ছে, এদের কাজে লাগিয়ে একসময় মাটির নিচে জীবন্ত নেটোয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব হবে।
কিংবা, এই ব্যাক্টেরিয়ার ওপর এক্সপেরিমেন্ট হয়তো খুজে দেবে এক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর, জীবনের জন্য নূন্যতম কি পরিমান শক্তি লাগে।
তথ্যসূত্রঃ
1. Meet the electric life forms that live on pure energy by Catherine Brahic.
2. Electric Aliens? Bacteria discovered that exist on pure energy.
Leave a Reply