জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমি বরাবরই আগ্রহী। মহাবিশ্বের উৎপত্তি মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ আমার দারুণ ভাল লাগা কয়েকটি বিষয়ের মাঝে স্থান করে নিয়েছে। আর দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের কাজ তো সমস্ত পৃথিবীতে সাঁরা জাগানো। বরাবরই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গিয়েছিলেন তিনি। প্রচার বিমুখ। কথা নেই বার্তা নেই অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন সকালে পত্রিকায় দেখি জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই। এই সংবাদে সেদিন মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
২০১৪ সালের বইমেলায় তার মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকীকে সামনে রেখে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে একটা নাদুস নুদুস বই লিখেছেন শরীফ মাহমুদ সিদ্দিকী। বইয়ের লেখক জামাল নজরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত গণিত ও ভৌত গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেছেন অনেকদিন। অনেক কাছে থেকে দেখেছেন অধ্যাপক ইসলামকে। সেই হিসেবে তার কলম থেকে বইটি পাওয়া আমাদের মোটামুটি একটা সৌভাগ্য।
বইটিতে জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য ঘটনাই লেখক তুলে এনেছেন। বইয়ের লেখক জামাল নজরুল ইসলামের মৃত্যু পর্যন্ত বেশ অনেক বছর একসাথে কাজ করাতে অত্যন্ত সুনিপুণ ও বিশ্বস্ত হাতে তার জীবনকে তুলে আনতে পেরেছেন।
জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম, পরিচয়, বংশ, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, অধ্যাপনা, দেশপ্রেম, উত্তরাধিকার ইত্যাদি সবকিছুই আলোচিত হয়েছে। অধ্যাপক ইসলামের বিদেশ জীবন, দেশে ফিরে আসার প্রেক্ষাপট, মন মানসিকতা দারুণভাবে তুলে এনেছেন।
তার পছন্দ-অপছন্দ, গবেষণা, প্রকাশনা সহ খুঁটিনাটি প্রায় সবই আলোচিত হয়েছে।
আমরা হয়তো জেনে থাকব জামাল নজরুল ইসলাম পিয়ানো বাজাতেন। যেমনটা করে আইনস্টাইন বাজাতেন বেহালা। জামাল নজরুল ইসলামের এই ভিন্ন দিকটাও গুরুত্ব পেয়েছে খুব। এখানে তো একজনের জীবন আলোচনা করা হচ্ছে, সিরিয়াস বিজ্ঞান তো নয়। এই হিসেবে এই দিকটা গুরুত্ব পাওয়াতে বইটার নির্ভরশীলতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বইতে দেখা যাবে বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের অন্য আরেক জীবন। তার সাংস্কৃতিক মনন, সাংস্কৃতিক জীবন, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিমত, দর্শন সবই আলোকপাত করা হয়েছে এই বইটিতে। জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহী যে কেহই অবাক হয়ে যাবে তার নিজের হাতে লেখা ছড়া পড়ে।
এই বইতে আমরা খুঁজে পাই একজন ব্যক্তি জামাল নজরুলকে। ১৯৮৪ সালে যখন তিনি দেশে ফিরে আসবেন তখন অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ পরামর্শ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার জন্য। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম তার নিজ এলাকা চট্টগ্রামে থাকতে বদ্ধপরিকর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তার পদ না থাকায় গণিত বিভাগেই তিনি চলে আসেন। চট্টগ্রামে নানা সীমাবদ্ধতা, ঢাকার সুবিধা তিনি কোনো আমলে নেন নি। বোঝাই যায় এমন মানুষ কী করবেন। যিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু পদ ফেলে দেশে চলে এলেন তাকে সামান্য কিছু কি আর দমাতে পারবে?
অধ্যাপক ইসলামের অনেকগুলো দুর্লভ ছবি, চিঠিপত্র, ডকুমেন্ট বইটির মূল্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখান থেকেই বোঝা যায় বইটি লেখার ক্ষেত্রে জামাল নজরুল ইসলামের একজন কাছের লোক হওয়াতে কত সুবিধা হয়েছে। লেখক কাছের হওয়াতে যে কাজটি করতে পেরেছেন, দূরের অনেকের পক্ষে তার অংশবিশেষ করাও দুরূহ ব্যাপার হতো।
সর্বোপরি বইটি দারুণ হয়েছে। ছোট দেশের এই বড় বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের প্রতি যাদের কম বেশি অনুরাগ আছে তারা সকলেই পড়তে পারেন এই বইটি। রাখা যেতে পারে সংগ্রহে।
সবশেষে কিছু আলোচনা। আমার মনে হয় বইটি খুব দ্রুত লিখে ফেলা হয়েছে। দ্রুত করাতে অনেক কিছুই বাদ পড়ে গেছে। আমি বুঝতে পারি অনেক কিছুই পরে পাওয়া গেছে যা বইটিতে যোগ করা হয়নি। এত দ্রুত বইটি প্রকাশ না করলেও হতো। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে না করে মাত্র এক বছর পর করলেও হতো। ছয় মাস হলেও তো অনেক। তাড়াহুড়া করাতে বইটি ত্রুটিযুক্ত হয়েছে। সময় নিলে আমি মনে করি এইসকল ত্রুটি সহ অন্যান্য টেকনিক্যাল ত্রুটি উৎরে আসা যেতো। বইটির বহু জায়গায় বানানে সমস্যা। এখানে আমি বানান ভুল কথাটা বলিনি। বলেছি সমস্যা। যত জায়গাতেই “ন্ড” যুক্তাক্ষরটি এসেছে ততবারই সেটা মিস হয়েছে। এরকম সমস্যা বিজয় ফন্টে হয়ে থাকে। তবে সহজেই এটা উৎরে আসা যায়। প্রকাশনার সাথে কাজ করে এই অভিজ্ঞতা আমার আছে। এইখানেই বোঝা যায় তড়িঘড়ি করে বইটা ছাপানো হয়েছে। এবং ছাপার পরে ত্রুটি বিচ্যুতি দেখার সময় হয়নি। এছাড়া আরও অনেকগুলো বানানে সমস্যা। :/ । আশা করবো পরবর্তী সংস্করণে এসব সংশোধন করা হবে। এবং এদের পাশাপাশি আরও তথ্যে তথ্যবহুল করা হবে।
এছাড়াও আরেকটা ব্যাপার মোটা দাগে চোখে পড়েছে। সেটা হচ্ছে জগদীশ চন্দ্র বসু গাছের প্রাণ আছে এটা আবিষ্কার করেছেন বলে বইতে উল্লেখ করেছেন। এমনটা আশা করা যায়না। একটা গাছ বীজ থেকে চারা হয়, আস্তে আস্তে বড় হয় এবং একসময় মারাও যায়- এটা প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরাই জানতো। গাছের প্রাণ আছে সেটা মানুষের বুদ্ধিমত্তার শুরু থেকেই মানুষ জানে। জগদীশ চন্দ্র যেটা করেছিলেন সেটা গাছের অনুভূতি এবং গাছের সাঁরা দেয়া সংক্রান্ত।
আরেকটু সামনে দেখা যায় জামাল নজরুল ইসলামের বই “কৃষ্ণবিবর” কে বলা হচ্ছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমালা’র অংশ। আদতে সেটা অমর একুশে গ্রন্থমালা হবে না। সেটা হচ্ছে বিখ্যাত ‘ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা’। বাংলা একাডেমীর যে সিরিজের আওতায় অসাধারণ কতগুলো বই বের হয়েছিল। ৫৫ পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় লাইন থেকে শুরু করে পরের দশ লাইন একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, প্রসঙ্গ বহির্ভূত হওয়াতে এই লাইনগুলোকে একদমই উদ্ভট বলে মনে হয়েছে। এমন চেষ্টা আরও কয়েক যায়গাতে করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেগুলো এক বাক্যে বা অল্প শব্দে শেষ হয়ে গেছে তাই সেগুলোতে কোনো সমস্যা হয়নি। যাহোক এসব ছোটখাটো ব্যাপার কোনো সমস্যা নেই। সর্বোপরি বইটি অসাধারণ।
সকলে পড়ে দেখবেন বইটি। অনন্য এক জামাল নজরুল ইসলামকে খুঁজে পাওয়া যাবে এই বইতে।
নাম : বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম
লেখক : শরীফ মাহমুদ সিদ্দিকী
প্রকাশক : অনুপম
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৪
ISBN : 9789844043756
পৃষ্ঠা : ১৪৪
কভার : হার্ডকাভার
Leave a Reply