কিছুদিন দিন আগে আমি একটা কাপড়ের দোকানে টাকা দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানো। আমার সামনে একজন মহিলা প্রায় ৫০ বছর বয়সী। হাত পা অস্বাভাবিক ভাবে নড়ছে। অর্থাৎ তার নিজের শরীরের নড়াচড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ তেমন নাই। এটা পার্কিনসন্স ডিজিজ এর জন্য গৃহিত এল-ডোপা ঔষধের ক্লাসিক সাইড ইফেক্ট (কিছু অন্য কিন্তু বিরল কারনেও হতে পারে)। মস্তিষ্কের রাসায়নিক যোগাযোগের রোগ পার্কিনসন্স। আমাদের নড়াচড়াকে শিথীল করে দেয়। আর এল-ডোপা ঔষধ নড়াচড়া এত বাড়িয়ে দেয় যে নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। আর এর সাথেই জড়িত পরের কাহিনী।
টিম লরেন্স নামক একজন স্টান্টম্যান কাজ করেছিলেন ব্রেভহার্ট এবং লন্ডন ইজ বার্নিং এর মত মুভিগুলোতে। কম বয়সেই, অর্থাৎ মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই তার পার্কিনসন্স রোগ ধরা পরে। কিন্তু এল-ডোপা গ্রহণের ফলে হাত পা আর নিয়ন্ত্রণে নাড়াতে পারেন না, স্টান্টম্যান কিভাবে হবেন? এই উপশম থেকে রেহাই পেতে তিনি একটি অদ্ভুত উপায় খুঁজে বের করলেন। একটি ঔষধ গ্রহণ করা শুরু করলেন, যেটা বৈধ নয়, বরং নেশাদ্রব্য হিসেবে পরিচিত। নাম এক্সটাসি। অদ্ভুত ফলাফল। গ্রহণের পর আবার আগের মত হাতে পা’য়ে নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে। এমন কিন এক্রোবেটিক কাজকর্মও করতে পারেন। আর এই খবর ছড়ানোর পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাড়া পড়ে যায়। পার্কিনসন্স রোগের ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপশমে এর চেয়ে ভাল কোন ঔষধ খুঁজে পাননি চিকিৎসকরেরা আগে।
চিকিৎসকেরা প্রথমে ভাবলেন যে রোগের উপশমটা হচ্ছে আসলে ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’ হিসেবে। ব্যাপারটা আসলে মনের। হোমিওপ্যাথি ঔষধ কাজ করবার উদাহরণ শোনা যায় যেসব ক্ষেত্রে, একই ব্যাপার। মস্তিষ্ক ভুল করে ভাবে যে ভাল ঔষধ পাওয়া গিয়েছে, এবার ভালভাবে হাতপা নাড়াই ব্যাটার। কিন্তু আসলেই কি তাই? বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করলেন। তারা, টিমকে একদিন এক্সটাসি খেতে দিলেন এবং আরেকদিন একইরকম দেখতে আরেকটা পিল। কিন্তু টিম জানেননা কোনদিন কী খাচ্ছেন। চিকিৎসকদের অনুমান ভুল প্রমাণিত হল। তারা দেখলেন শুধুমাত্র এক্সটাসি খাওয়ার দিনই টিম সুস্থ থাকছেন। তাহলে ঘটনাটা কী?
প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন কোকেইন এর মত ডোপামিন পাথওয়েকে হাইজ্যাক করে এই ড্রাগ। আগের পর্বে দেখিয়েছিলাম সেটা কিভাবে হয় (নেশা ১)। তবে, মস্তিষ্ক পরীক্ষায় দেখা গেল ডোপামিন নয়, বরং সেরোটোনিন নামক আরেকটা রাসায়নিক দ্রব্যের পাথওয়েকে হাইজ্যাক করে এক্সটাসি। ডোপামিনের মত সেরোটোনিন ও নিউরোট্রান্সমিটার। আমাদের বিভিন্ন অনুভূতি, মুড, ভাল-লাগা, খারাপ-লাগা, রাগ এসব প্রকাশ এবং নিয়ন্ত্রণ করে এই পাথওয়ে। মস্তিষ্কে সেরোটোনিন কম হলে আমরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে যেতে পারি। তবে মানুষ ছাড়াও অন্য বহু জীবেই সেরোটোনিন পাওয়া যায়।
যখন সেরোটোনিন একটি নিউরন থেকে নির্গত হয় তখন সে আরেকটি নিউরনের গ্রাহকে গিয়ে লেগে যায় এবং আমাদের দেহে তার প্রতিক্রিয়া হয়। যত বেশি সেরোটোনিন নির্গত হবে তত বেশি ভাললাগার অনুভূতি কাজ করবে। আর নির্গত সেরোটোনিন যেন অধিক পরিমানে গ্রাহকে না লেগে যায় তাই একধরনের প্রোটিন এসে সেরোটোনিনকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। আর এক্সটাসি এইসব প্রোটিনে এসে বন্ধন তৈরি করে। ফলে নিউরনগুলির চারপাশে অতিপরিমান সেরোটোনিন থেকে যায়, আর বেশি বেশি রিসেপ্টরে লাগতে পারে। এভাবে নেশাটা কাজ করে।
কিন্তু এল-ডোপার সাইড ইফেক্ট এক্সটাসি কিভাবে কমায় সেটা আমরা জানিনা। এই দ্রব্য এখনও পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নিষিদ্ধ। তবে বিজ্ঞানীরা কাছাকাছি রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করার চেষ্টা করছেন। কারন এক্সটাসি গ্রহণে মস্তিষ্কের দারুণ ক্ষতি হয়। টিমকে পার্কিনন্স রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করছে এক্সটাসি ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে করছে দারুণ ক্ষতি। কি অদ্ভুত সমস্যা, তাইনা?
Leave a Reply