স্বপ্নের স্নায়ুবিজ্ঞান
সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণায় ঘুমের সময় মানুষজনের মস্তিষ্কের বিভিন্নধর্মী সক্রিয়তা মাপা হয়েছে ব্রেন স্ক্যানার দিয়ে। স্বপ্নের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে সেসব গবেষণার ফলাফল দেখে নেয়া যাক। গল্প বলা স্বপ্নেরা রেম ও গভীর নন-রেম দুই ধরনের ঘুমেই দেখা দিলেও রেম-ঘুমেই এসব স্বপ্নের প্রাদুর্ভাব বেশি। তাই রেম ঘুমের সময়ে মস্তিষ্কে কি কি শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হয় তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গল্প বলা স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করবো আমরা।
প্রাণীদের উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে আমরা জানি ব্রেনস্টেমে রেটিকুলার এক্টিভেটিং সিস্টেম রেম ঘুমের সময় সম্পূর্ণ সক্রিয় থাকে। এই সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত স্নায়ুদের সক্রিয়তা PET স্ক্যান করে দেখা সম্ভব। এই স্ক্যান থেকে পাওয়া ছবির একটা লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হলো স্বপ্নে গল্প বলা দৃশ্য দিয়ে ভরপুর হলেও প্রাথমিক দৃশ্য কর্টেক্সে তেমন কোন সক্রিয়তাই দেখা যায় না। কিন্তু দৃশ্যতথ্য নিয়ে উচ্চস্তরের বিশ্লেষন করে মস্তিষ্কের যেসব অঞ্চল (দৃশ্য তথ্য সম্পর্কিত স্মৃতি সঞ্চয় নিয়ে কাজ করে যারা) — তাদেরকে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায় এসব পেট-স্ক্যান ছবিতে। এ থেকে সম্ভবত বলা সম্ভব যে স্বপ্নেরা প্রায়ই কেন অতীতের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি নিয়ে গড়ে ওঠে — বিশেষ করে সেসব দীর্ঘমেয়াদী দৃশ্য-স্মৃতি যারা মস্তিস্কের দৃশ্য-তথ্য বিশ্লেষণ সম্পর্কিত এলাকায় জমা থাকে।
রেম ঘুমের সময়ে মস্তিষ্কের আরেকটা লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হলো আবেগ নিয়ে কাজ করা এলাকাগুলোতেও বেশ সক্রিয়তা দেখা যায়। বিশেষ করে অ্যামিগডালা ও অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট অঞ্চলগুলো প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলগুলো ভয়, উদ্বেগ, ব্যাথা সংশ্লিষ্ট আবেগীয় প্রতিক্রিয়া এবং ভয় কিংবা ব্যাথা সম্পর্কিত উদ্দীপনার সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়। গল্প-বলা-স্বপ্নে ভয়, উদ্বেগ ও আগ্রাসনের যে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তার পেছনে এই দুইটি অঞ্চল দায়ী বলে মনে করা হয়। রেম ঘুমের সময় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কিছু অংশ (ডর্সোল্যাটারাল) একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আমরা জানি প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হচ্ছে মস্তিষ্কের সম্প্রতি বিবর্তিত অংশ। কর্টেক্সের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া অঞ্চলটি যুক্তি, বিচার-বিবেচনাবোধ আর পরিকল্পনার মতো কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বপ্নে কেন আমরা অযৌক্তিক, অদ্ভূতুড়ে আর অসম্ভব সব ঘটনা ও কাহিনী কেন মেনে নেই তার একটি ব্যাখ্যা হলো এই নিষ্ক্রিয়তা। এছাড়াও ডর্সোল্যাটারাল প্রিফন্ট্রাল কর্টেক্সের এরকম দুর্বল হয়ে যাওয়া স্বপ্নে হ্যালুসিনেশনের মতো উপাদান সংযুক্ত করতে ভালো ভূমিকা রাখে। বলে রাখা ভালো সাইজোফ্রেনিয়ায় (এক ধরনের মানসিক রোগ) হ্যালুসিনেশনের পেছনেও এই ডর্সোল্যাটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এ কারণে সাইজোফ্রিনিয়া ভুক্তভোগীরা জেগে থেকেও স্বপ্নের মতো অযৌক্তিক ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান।
PET-এর মাধ্যমে ব্রেন স্ক্যানিং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের গড়পড়তা সক্রিয়তা সম্পর্কে তথ্য দেয়। এ তথ্য অনেক কাজের। কিন্তু ঠিক কোন সুনির্দিষ্ট জায়গায় কোন স্নায়ু সংকেত পাঠাচ্ছে কিংবা স্নায়ুসমুহের সক্রিয় হয়ে ওঠার ফলে সে অঞ্চলে সাময়িক কোন পরিবর্তন হচ্ছে তা এই স্ক্যানিঙের মাধ্যমে জানা যায় না। গল্প-বলা স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কে বিভিন্ন তথ্য কিভাবে প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে তা বোঝার জন্য এই দুইটি বিষয় জানা জরুরী। এক স্নায়ু থেকে অন্য স্নায়ুতে সংকেত পাঠানোর জন্য দুই স্নায়ুর সংযোগস্থলে নিউরোট্রান্সমিটার নামক উপাদান দরকার হয়। সিনাপ্সে নিউরোট্রান্সমিটার লেনদেনে দুই স্নায়ুর মাঝে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা পরিবহন নিয়ন্ত্রিত হয়। এই নিউরোট্রান্সমিটার কয়েক রকমের হয় – এসেটাইলকোলিন, নোরাড্রোলিন, সেরোটোনিন ইত্যাদি। প্রাণীদের উপর পরিচালিত কিছু গবেষণায় তড়িৎগ্রাহী বৈদ্যুতিক প্রোব মস্তিষ্কে বসিয়ে দিয়ে রেম ঘুমের সময় বিভিন্ন নিউরনের সক্রিয়তা দেখা হয়। এ গবেষণা থেকে দেখা যায় কোয়েরুলাস অঞ্চলের নোরাড্রোলিন ধারণকারী স্নায়ু ও ডর্সাল ড়্যাফে অঞ্চলের সেরোটোনিন ধারণকারী স্নায়ুরা এ সময় নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ব্রেনস্টেমে রেটিকুলার এক্টিভেটিং সিস্টেমের এসিটাইলকোলিন ধারণকারী স্নায়ুরা খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে। মস্তিষ্কের এই তিন নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার স্নায়ুসমূহের বিভিন্ন অ্যাক্সন থ্যালামাস, কর্টেক্স ও লিম্বিক সিস্টেম সহ সারা মস্তিষ্কেই ছড়িয়ে আছে। তার মানে পেট স্ক্যানে আমরা রেম ঘুমে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানিক সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠা দেখেছি তা সংঘটিত হয় এসব তিন ব্যবস্থার মাধ্যমে।
এছাড়া এসেটাইলকোলিন নিউরোট্রান্সমিটারের পরিচালনা ঐচ্ছিক পেশীসমূহকে সাময়িকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয়। আগেই জানিয়েছি যে এটা রেম ঘুমের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গল্প-বলা-স্বপ্নে মস্তিষ্ক দেহের নড়াচড়া করার বিভিন্ন নির্দেশ পাঠায়। কিন্তু এই নির্দেশ সুষুম্নাকান্ডে প্রবেশের আগেই ব্রেন স্টেমের এসিটাইলকোলিন পরিচালিত স্নায়ু বর্তনীর সংকেতের মাধ্যমে অবদমিত হয়। নড়াচড়ার জন্য মস্তিষ্ক থেকে যথাযথ নির্দেশ পাঠালেও সে নির্দেশ দেহে ছড়িয়ে পড়ছে না। একারণে নির্দেশ পাঠানোর পরেও সংশ্লিষ্ট পেশী ও অন্যান্য ইন্দ্রীয় কিভাবে নড়াচড়া হচ্ছে এধরনের কোন অনুভূতি ফেরত পাঠাচ্ছে না মস্তিষ্কে। তাই রেম ঘুমের গল্প-বলা-স্বপ্নে আকাশে ওড়া সহ অবিরাম আনায়সগতির অনুভবের পেছনে সম্ভবত এই অবদমন দায়ী।
স্বপ্নের সময় মস্তিষ্কের গহীন স্নায়ুবর্তনীসমুহে ঘটে যাওয়া সব খুঁটিনাটির খবরাখবর আমাদের জানা নেই। তবুও, স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সক্রিয়তার ধাঁচ দেখা যায়, তা থেকে আমরা স্বপ্নের অনেক লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করতে পারি। স্বপ্ন আমরা কেন দেখি, স্বপ্ন দেখে জীববৈজ্ঞানিক কোন উদ্দেশ্য সাধিত হয় কিংবা স্বপ্নের বিষয়বস্তু কেন আমাদের কাছে এতো অর্থবহ বলে মনে হয় – উপরের ব্যাখ্যা দিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে ঠিকমতো ধরা যায় না। তো, আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? এক কথায় উত্তর হলো, দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো জানি না। কিন্তু যদি বড় উত্তর দিতে চাই তাহলে ভিন্ন কয়েকটি পথে ভিন্ন তদন্তের খবরাখবর জানাতে হবে।
কতিপয় স্বপ্নতত্ত্ব
”আমরা কেন স্বপ্ন দেখি” — ঘুম নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাদের কয়েকজনকে বিচ্ছিন্নভাবে যদি এই প্রশ্নটা করা যায় তাহলে গবেষকের আগ্রহের এলাকা অনুযায়ী আমরা ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাবো। তাই যেসব বিজ্ঞানীর মূল আগ্রহের জায়গা আবেগ তাঁরা আপনাকে বলবেন যে স্বপ্নের মূল কাজ হলো মন-মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন শিকাগোর সেইন্ট লুক’স মেডিকেল সেন্টারের গবেষক রোজালিন্ড কার্টরাইট একটি তত্ত্ব খাড়া করেছেন যে স্বপ্ন মেজাজ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নেতিবাচক আবেগগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে। তাই ঘুম থেকে উঠে আমরা সাধারণত ভালো বোধ করি। অন্যদিক মনঃস্তত্ববিদেরা বলবেন স্বপ্ন হলো এক ধরনের মনঃচিকিৎসা। টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্নেস্ট হার্টম্যান প্রস্তাব করেছেন স্বপ্ন আর মনঃচিকিৎসা দুইই জীবনের আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজটি করে একটা নিরাপদ, বাইরের জগত থেকে পৃথক পরিবেশে।
যেসব জীববিজ্ঞানীর মূল আগ্রহ বিবর্তনে তারা প্রস্তাব করেছেন সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। স্বপ্নে সেই সব আচরণকে নিখঁত করে তোলার মহড়া ঘটে যারা জেগে থাকার সময়ে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বপ্ন অনেকটা ভার্চুয়াল বাস্তবতার মতো কাজ করে যেখানে একটি নিরাপদ স্থানে (যেখানে প্রাণী ঘুমাচ্ছে) জীবনের উপর হুমকী তোলা বিভিন্ন পরিস্থিতির একটা ছদ্মঅনুকরণ করা হয়। এই ব্যাখ্যাটি হার্টম্যানের প্রস্তাবনা থেকে বেশি দূরে নয়। দুই ব্যাখ্যাই স্বপ্নে ভয় ও উদ্বেগের কেন্দ্রীয় ভূমিকার পেছনে কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। একই সাথে দুই ব্যাখাই ধরে নেয় স্বপ্ন হলো নিরাপদ একটা পরিবেশ যেখানে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক কাজগুলো করে ফেলা যায়।
এর আগে মস্তিষ্কে স্মৃতি একীভবন (প্রাথমিকভাবে কোন তথ্য পাওয়ার পর তার বিভিন্ন অংশ মস্তিষ্কে ধরে রাখার প্রক্রিয়া) ও অন্যান্য স্মৃতির সাথে সংযুক্ত করার জন্য ঘুম চক্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আলোচনা করেছি। তাই এখন আন্দাজ করতে কষ্ট হবে না স্বপ্নও কোন না কোন ভাবে স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত। স্বপ্নের আলোচনায় একটা আগ্রহোদ্দীপক মোড় আসে যখন রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাথন উইনসন ভাবনা উত্থাপন করেন যে স্বপ্ন আসলে ঘুমন্ত অবস্থায় স্মৃতি প্রক্রিয়াজাত করার একটি উপজাত মাত্র। তিনি যুক্তি দেখান, অভিজ্ঞতাকে স্মৃতিতে পরিণত করার জন্য মস্তিষ্কের যে সম্পদ ব্যবহার করা লাগবে তা যদি জাগ্রত অবস্থায় করা হয় তাহলে আমাদের কর্টেক্সের যে আয়তন তার চাইতে বেশি পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার করা লাগবে। এ কাজটি জাগ্রত অবস্থায় করতে গেলে একটা অচলাবস্থার তৈরি হবে। তাই মস্তিষ্কের যে সীমাবদ্ধ সম্পদ আছে আমাদের তার উপযুক্ত ব্যবহার করার জন্য রাত্রে ঘুমের মধ্যে স্মৃতী একীভবন ও সংযুক্ত করার কাজটি করি। অনেকটা যুদ্ধকালীন সময়ে কোন অস্ত্র-কারখানায় রাত্রের শিফটে কাজ চলার মতো।
স্বপ্ন আমরা কেন দেখি তার ব্যাখ্যা দেয়া এইসব বিচিত্র মডেলের উপযোগীতা যাচাই করার সময় আমাদের কিছু কথা মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, এই মডেলগুলো যে একটি অপরটি থেকে স্বতন্ত্র এমন নয়। যেমন স্বপ্ন আবেগগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করার সাথে সাথে স্মৃতি একীভবনের কাজও করতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্বপ্ন বিশ্লেষণের বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে। একটি ধাপে রয়েছে স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কে চলতে থাকা বিভিন্ন প্রক্রিয়া। পরের ধাপে স্বপ্ন দেখার সময় যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা যাই আর শেষ ধাপে আছে স্বপ্ন দেখার মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদেরকে জাগিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া।
প্রতিটি মডেলেরই কিছু শক্তিশালী দিক ও দুর্বলতা আছে। স্বপ্নের মনঃচিকিৎসার ভূমিকা কিংবা মন-মেজাজের নিয়ন্ত্রনের তত্ত্ব স্বপ্নে নেতিবাচক আবেগের প্রাদুর্ভাবের ভালো ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু এই তত্ত্ব দুইটিকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দিতে হবে। প্রথমত, কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কৃত্রিম ভাবে না জাগালে দাবী করেন যে তারা কোন স্বপ্ন দেখেন না। আর তাদের যে আবেগীয় কিংবা বৌদ্ধিক সমস্যা আছে এমনও নয়। এক্ষেত্রে কেউ হয়তো বলতে পারে যে স্বপ্নের কথা সচেতনভাবে স্মরণ করতে না পারলেও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ঠিকই আবেগীয় মনঃচিকিৎসার প্রক্রিয়া চলমান আছে। দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হলো আবেগের দিক দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই কারো কারো স্বপ্নে দেখা দেয় না। অনেক নিয়মিত স্বপ্ন-ডাইরী লেখা স্বেচ্ছাসেবকের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি ঘটেছে। তবে কোন মনঃসমীক্ষক হয়তো বলবেন যে স্বপ্নে সেই সব আবেগ রূপকের ছদ্মবেশে দেখা দিয়েছে — তাই তাদেরকে চিহ্নিত করা এতো সহজ নয়।
স্বপ্নের স্মৃতি একীভবন/সংযুক্তিকরণ মডেলটিও নানা দিক দিয়ে আকর্ষণীয়। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাথে স্বপ্নে কেন অনেক আগের স্মৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসে তার ব্যাখ্যা দেয় মডেলটি। ব্যাখ্যাটি নতুন ঘটনার তথ্য পুরনো স্মৃতির সাথে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে বলেই পুরনো দিনের কথা স্বপ্নে উঁকি দিচ্ছে। স্মৃতি একীভবন/সংযুক্তিকরণ মডেলের মধ্যেই কিছু ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে যারা আলাদা গুরুত্বের দাবী রাখে। যেমন কোন কোন ব্যাখ্যায় দাবী করে যে মস্তিষ্কের স্মৃতি একীভবনের ক্ষেত্রে স্বপ্নই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এ ধরণের ব্যাখ্যাকে অবশ্য উপরের মতো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। যেসব স্বেচ্ছাসেবীরা স্বপ্ন দেখেন না বলে দাবী করেন, তাদেরকে বিভিন্ন স্মৃতি-পরীক্ষায় ভালোভাবেই উন্নীত হতে দেখা যায়। হার্বার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন হবসন একীভবন/সংযুক্তিকরণ মডেলের একটি লঘু সংস্করণ প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেন যে ঘুম-চক্রের মূল উদ্দেশ্য হলো স্মৃতি একীভবন ও সংযুক্তিকরণ। আর গল্প-বলা-স্বপ্নে আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই তা সম্মুখ কর্টেক্সের যৌক্তিক অংশের নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়ে মস্তিষ্কের অতিআবেগী অংশ দৃশ্য-স্মৃতির বিভিন্ন ছেঁড়া অংশকে পরপর জোড়া লাগিয়ে একটি কাহিনীর রূপ দেয়। এই মত অনুসারে, স্বপ্নের উপাদান আসলে সার্কাসে মজার আয়নায় দেখা মোচড়ানো প্রতিবিম্ব ছাড়া কিছু নয়। তাই স্বপ্নের কোন রূপকের ফ্রয়েডিয় কিংবা অন্য কোন ব্যখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন নেই।
স্মৃতি একীভবন/সংযুক্তিকরণ মডেলে বেশ কিছু ঝামেলা রয়েছে। স্বপ্নের আবেগীয় উপাদানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এত নেতিবাচক কেন তার কোন ব্যাখ্যা দেয় না এই মডেলটি। এ বিষয়ে ডেভিড লিনডেনের অনুমান হলো, জাগ্রত অবস্থায় নেতিবাচক আবেগীয় বর্তনীর (ভয়/উদ্বেগ/আক্রমণ) মাধ্যমে মস্তিষ্কে স্মৃতি একীভবনের কাজে জোড় দেয়। এটা যেন নেতিবাচক আবেগের সাথে জড়িয়ে মস্তিষ্কে স্মৃতি একীভবনের জন্য দাগ দিয়ে রাখা — কোন প্রবন্ধ পড়ার সময় তার গুরুত্বপূর্ণ লাইনকে যেমন করে আমরা দাগিয়ে রাখি, অনেকটা সেরকম। ভীষণ ভয় পেয়ে চমকে যাওয়া ঘটনা কিন্তু আমরা সহজে ভুলিনা। ঘুমানোর সময় যখন স্মৃতি একীভবন/সংযুক্তকরণের কাজ মস্তিষ্কে চলে, তখনো জাগ্রত অবস্থার মতোই একটা প্রক্রিয়ার দরকার যেটা বলে দেবে ”হুম। স্মৃতিকে দীর্ঘকালীন আবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তুমি এই স্নায়ু সংযোগ তৈরি করেছো। এখন তাহলে স্মৃতিটা লিখে ফেলো”। ডেভিড লিনডেনের মতে, এই ‘বলে দেয়ার প্রক্রিয়াই’ মস্তিষ্কের নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রক অঞ্চলকে সক্রিয় করার মাধ্যমে স্মৃতি একীভবনের কাজে জোড় দেয়। মোটা দাগে বলা যায় যে বাস্তব উদ্দীপনার অনুপস্থিতিতে স্বপ্নে ভয়/উদ্বেগ/আক্রমণের বর্তনী স্মৃতি গঠন ও অন্যান্য স্মৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কাজ করে। আপনার স্বপ্ন দেখা মস্তিষ্ক জানে না যে আবেগ সক্রিয়কারী অঞ্চল ছিনতাই হয়ে গেছে গল্প-বলা-স্বপ্নে নেতিবাচক আবেগ সরবরাহ করার জন্য।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন স্বপ্নের বিভিন্ন উপাদান আমাদের কাছে এতো অর্থপূর্ণ মনে হয় তার কোন ব্যাখ্যা এই মডেলগুলো দেয় কি না। কিছু কিছু মডেল স্বপ্ন দেখার প্রক্রিয়ার সাথে স্বপ্নের বিষয়বস্তুর সম্পর্ক নিয়েও আগ্রহী। স্বপ্নের স্মৃতি একীভবন/সংযুক্তকরণ মডেলের কিছু উৎসাহী গবেষক এমনটাও দাবী করেছেন যে স্বপ্নে কি দেখছি আর স্মৃতিতে কি লেখা হচ্ছে তা থেকে স্বপ্ন-দেখা-ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণে কিছুটা গুরুত্বের দাবী রাখে। প্রশ্ন হলো আমরা এই আলোচনাটাকে কত দূরে নিয়ে যেতে চাই। যদিও ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও ব্যক্তির নিজস্ব আগ্রহের জায়গা থেকে স্বপ্নের বিষয়বস্তুর সত্যিকারের ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য কি তা নিয়ে বিশ্লেষণের একটা স্থান রয়েছে। কিন্তু ডেভিড লিনডেনের কোন আস্থা নেই যে কারো স্বপ্নের বিষয়বস্তু থেকে কোন রূপক-অভিধান ঘেঁটে তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কোন ভালো সিদ্ধান্ত টানা যাবে। তাছাড়া এর পেছনে তেমন কোন জীববৈজ্ঞানিক ভিত্তিও পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বপ্ন দেখা অভিজ্ঞতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কাহিনীর খুঁটিনাটি কিছু নয়। স্বপ্নে জুতা না দেখে সিগারেট কিংবা মাকে না দেখে বাবাকে দেখাটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না। স্বপ্ন আমাদের জাগ্রত অবস্থার বাইরে এমন একটা অভিজ্ঞতা দেয় যেখানে বাস্তব জগতের নিয়মকানুন খাটে না, সেখানে কার্যকারণ ও যৌক্তিক চিন্তা এবং আমাদের বৌদ্ধিক প্রতিতী আকার্যকর হয়ে যায়। স্থান-কাল-পাত্র বদলে যায়, অভিকর্ষ সহ অন্যান্য নিয়মকানুন বেয়াড়া আচরণ করে, অদ্ভূতুড়ে আর অযৌক্তিক কাহিনীরা পর পর ভিড় করে। স্বপ্নে এই কাহিনীদের বেয়াড়া ভিড়কে আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নেই। গল্প-বলা স্বপ্নগুলো মূলত চেনাজানা দুনিয়া থেকে বাইরে কাল্পনিক সব ঘটনা-কাঠামো ও তাদের ব্যাখা হাজির করে। জেগে ওঠার পর আপনি হয়তো স্বপ্ন জগতের বদলানো-রূপ গ্রহণ করতে পারেন কিংবা যুক্তির দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন অথবা দুইটি জিনিসই মিশিয়ে ফেলতে পারেন। স্বপ্নের কাল্পনিক জগতের অভিজ্ঞতা পর্দার ওপরে চলে গেছে। সে অভিজ্ঞতাই মূখ্য, আনন্দের। আপাতত, স্বপ্ন ব্যাখ্যায় নিপুণতর কোন তত্ত্বের অপেক্ষায় থাকি।
সূত্র: ডেভিড লিনডেনের দ্যি এক্সিডেন্টাল মাইন্ড।
[পূর্বের লেখা: স্বপ্নের কি কোন মানে আছে?]
Leave a Reply