ওয়াল্ট ডিজনির তৈরি ডকুমেন্টারিগুলো অসাধারণ হয়ে থাকে। প্রতি বছর একটি করে ডকুমেন্টারি রিলিজ দেয় তাঁরা। রিলিজ হয় আর্থ ডে বা ধরিত্রী দিবসে। ধরিত্রী দিবসে মুক্তি পাওয়া এসব ডকু ফিল্মগুলো যেন পৃথিবীর প্রতি এক অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটা ডকু ফিল্ম একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর হয়ে থাকে। ২০১১ সালের বিষয় ছিল African Cat. (আফ্রিকার বাঘ ও সিংহ। বাঘ ও সিংহ মূলত বিড়াল শ্রেণীর প্রাণী)। ২০১২ তে ছিল শিম্পাঞ্জী। ২০১৪ সালের বিষয় ছিল ‘ভালুক’।
Bear- 2014 তে একজোড়া ভালুকের ছোটবেলাকার জীবন, তাদের বেড়ে ওঠার কয়েক বছরকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। পরিচালক মুভিটি শুরুই করেছেন এমন একটি মুহূর্তে যখন একটি মা ভালুক সদ্য দুটি ভালুক ছানার জন্ম দিয়েছে। মুভিতে মা ভালুকটিকে নাম দেয়া হয় ‘স্কাই’ আর বাচ্চা দুটোর নাম দেয়া হয় ‘স্কাওট’ ও ‘অ্যাম্বার’। একটি ভালুকের জীবনে চলতে ফিরতে কত ধরণের বিপদ আপদের সম্মুখীন হতে হয় তার কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে এই মুভিতে। ভালুকদের সমগ্র জীবনটাই যেন এডভেঞ্চারে ভরা। কি সে পূর্ণ বয়স্ক ভালুক হোক বা ভালুক ছানা হোক।
চিত্র: মায়ের বিশ্বস্ত কোলে নবজাতক ভালুক ছানা।
গুহাতে ভালুক ছানাগুলো কিছুটা বেড়ে ওঠার পর যখন সময় হয় বাইরে আসার তখন আশেপাশের পরিবেশ দেখে বোঝা যায় তাঁরা কতটা সুন্দর পরিবেশে থাকে। মানব চোখে বরফ তুষারের এই পরিবেশ হয়তো দেখতে সুন্দর কিন্তু তাদের তো আর সুন্দর দিয়ে হবে না। বাঁচার জন্য খাবার লাগবে। খাবারের তাগিদে এলাকা বদল করতে হয়। ভালুকের সমগ্র জীবনে তো নানান হিংস্র প্রাণীদের নিয়ে বিপদ আছেই পাশাপাশি পথে পথেও প্রাকৃতিক বিপদ চরাও হতে সময় নেয় না। বরফ আবৃত পাহারের কথাই ধরা যাক না, যেকোনো সময়েই উপর হতে বরফের তুফান (avalanches) নেমে পড়ে নিচে। ভালুকের চলার পথে এই তুফান পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত। ভাগ্যক্রমে মুভির ভালুকের সংসার বেঁচে যায় একটুর জন্য।
এরপরেই পরিচালক ভালুক ছানাদের দিয়ে মুভিতে কিছুটা হাস্যরস-হিউমারের সৃষ্টি করেছেন। বাচ্চা ভালুকদের কাণ্ড কারখানা দেখলে আসলেই হাঁসি পায় সেখানে। ভালুক-ছানা ‘স্কাওট’ ও ‘অ্যাম্বার’ যখন চারণভূমিতে আসে তখন তাদের সামনে যেন সম্পূর্ণ নতুন এক জগত দেখা দেয়। এ যেন একটা দরজা খুলে গেল আর সে দরজার ওপারেই আছে বিশাল এক রাজ্য। এই সময়টার আগে ভালুক-ছানার তাদের মা ব্যতীত অন্য কোনো ভালুকের দেখা পায়নি। চারণভূমিতে একসাথে এতগুলো ভালুক দেখে যেন তাঁরা অনেকটা বিস্মিত। এই ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো আমি অনেক খেয়াল করি। ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো একটা মুভিকে প্রিয় মুভির তালিকায় নিতে সাহায্য করে।
শুধু বাঘ, কুমির, হায়েনা কেন স্বয়ং নিজেদের প্রজাতি ভালুকদের কাছেও তাঁরা হুমকি-স্বরূপ। এক ভালুক দেখতে পারে না আরেক ভালুকের দলকে। তাই দেখা যায় বড়সড় শক্তি-সামর্থবান ভালুক তাদের তাড়া করে ফেরে, আর তাঁরা ভালুকের হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্য এখান থেকে ওখানে ছুটে। ভালুক-ছানার মাকে দেখা যায় সন্তানদের বাঁচাতে কত ধরণের চেষ্টা করে। কত কৌশল ব্যবহার করে আর সন্তানদের একটু আরামের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করে।
চিত্র: ভালুকে ভালুকে চলমান লড়াই। সন্তানদের সুরক্ষার জন্য একজন মাকে প্রতিনিয়তই এমন অনিচ্ছাকৃত লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়।
এ শুধু দুটি শাবকের খণ্ডচিত্রই এখানে চিত্রায়িত হয়নি, এর মাধ্যমে যেন সমগ্র ভালুকদের রীতিনীতি, পরিবেশ ওঠে এসেছে। মুভিতে একটি চলমান বিপদ ছিল নেকড়ে। যেখানে ছানারা যায় সেখানে নেকড়ে যায়, রক্ষে নেই। আশ্চর্য রকম ধূর্ত এই প্রাণী পদে পদে সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে কখন বসানো যাবে একটা কামড়, কখন সাবাড় করে ফেলা যাবে একটা ছোট বাচ্চাকে। তারও তো একটা জীবন আছে, বাঁচার তাগিদে কাওকে না কাওকে তো মারতেই হবে। আমরা মানুষেরা যেমন বাঁচায় তাগিদে প্রতিদিনের আহারে অগণিত প্রাণ মেরে চলছি তেমন। এই ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন মা’কে কতটা সতর্ক হতে হয় এরকম বিপদ থেকে সন্তানদের বাঁচাতে। মায়ের আন্তরিক খেয়ালে নেকড়ে পারেনা তাদের কিছু করতে। মা যখন খাবার আনতে যায় নদীতে, যখন থাকে না আশেপাশে তখন কীভাবে বাঁচে বাচ্চাগুলো? এক দারুণ এডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যায় এখানে।
চিত্র: চলমান বিপদ, ভালুক জীবনের সার্বক্ষণিক হুমকি নেকড়ে।
বন্য জীবনে চলতে গেলে একজন মায়ের দায়িত্ব থাকে তার বাচ্চাদের জীবনধারণের জন্য সবকিছু শিখিয়ে দেয়া। এখানেও দেখা যায় মা প্রত্যেকটা সময়ে সময়ে কীভাবে শাবকদের শেখায়। সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার আশ্চর্য নিদর্শন এই ডকু ফিল্ম।
ভালুকরা প্রতিটা সময় অপেক্ষা করে থাকে যে সময়টার জন্য সেটা গ্রীষ্মকাল। এই সময়টায় বরফ গলে যায়, নদীতে স্রোত বয়। স্রোতের সাথে সাথে আসে সবচে আকাঙ্ক্ষিত জিনিস স্যামন মাছ। এই মাছ ধরার সময়টায় তাদের সবচে ভাল যায়, এই সময়টার জন্যই সাঁরা বছর অপেক্ষা করে। এই সময়টাতে তাঁরা পর্যাপ্ত খাবার পায়, মোটাতাজা হয় এবং সামনের মাসগুলোতে কাজে লাগানোর মতো চর্বি জমা করে শরীরে। আর একজন মায়ের বেলায় খাবার ভেল পেলেই না তবে সন্তানদের স্তনের যোগান দিতে পারবে বেশি। আর মাছ শিকারের দৃশ্যগুলো মানব চোখে দারুণ উপভোগ্য। অসাধারণ লাগে তাদের মাছ শিকার।
চিত্র: ভালুকদের সবচে প্রিয় স্যামন মাছ। স্রোতের মাঝে নদীতে উপযুক্ত মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর মাছ লাফ দিয়ে মুখে এসে পড়ে। এমন মজার জীবন কতটা প্রজাতির হয়ে থাকে?
এই মুভির আরেকটি দারুণ বিষয় হল অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। ডিজনি ডকুমেন্টারিতে দেখানো প্রকৃতি দেখে যাযাবর হয়ে যেতে মনে চায়, দেখার সময় মনে হয় কি হবে এই ঘরবাড়ি, চাকরি বাকরি, টাকা পয়সা দিয়ে? দুনিয়ার সমস্ত সুন্দরগুলো পড়ে রয়েছে এখানে ওখানে। দেখতে মনে চায় অনেক উঁচু থেকে দেখলে কেমন করে একটা নদীকে আঁকাবাঁকা কলমের দাগ বলে মনে হয়, দেখতে মনে চায় কতকিছুই। আর আমি কিনা এভাবে ছোট জীবনটাকে এক বছর এক বছর করে শেষ করে দিচ্ছি? সুন্দরের জন্য, শান্তির জন্যই তো আমরা সবকিছু করি।
এই ডকুমেন্টারি তৈরিতে যারা কাজ করেছেন তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা জাগে। না জানি কত পরিশ্রম করতে হয়েছে একটা দেড় ঘণ্টার ভিডিও তৈরি করতে। ভালুক যেখানে যায় সেখানে যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, ক্যামেরার মানুষ। কত ঝামেলা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কত কষ্ট হয় এমন চিত্র ধারণ করা। অবশ্য মুভির শেষের দিকে ক্যামেরার পেছনের কিছু গল্প দেখানো হয়, যা খুবই সামান্য।
চিত্র: ক্যামেরার পেছনের একটি মুহূর্ত।
এই ডকুমেন্টারিটির জন্য বিখ্যাত গায়িকা অলিভিয়া হল্ট (Olivia Holt) তার “Carry On” গানটি গান। মুভিটি ২০১৪ সালের আর্থ ডে’র চারদিন আগে এপ্রিলের ১৮ তারিখ রিলিজ দেয়া হয়। এর ব্লু-রে ডিভিডি বাজারে ছাড়া হয় আগস্ট মাসে। মুভিটি বক্স অফিস আয় করে ১৮.১ মিলিয়ন ডলার।
এবার ডাওনলোড লিঙ্ক || 720p এর জন্য || 1080p এর জন্য || আর যারা আরও বেশি বিটরেট ও ফ্রেমরেটে দেখতে চায় তাদের জন্য ||এখান থেকে|| বেঁছে ভাল একটা নামিয়ে নিলেই হবে।
২০১৫ এর আর্থ ডে’তে রিলিজ দিবে Monkey Kingdom সেটা দেখার জন্য সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে বসে আছি!
সবশেষে মুভিটি থেকে কিছু স্ক্রিনশট তুলে দিচ্ছি নিচে।
ছবি ও তথ্যসূত্র:
Leave a Reply