মানব জেনোমের মধ্যে থাকা ‘জিনেটিক জঞ্জাল’ ভাবা হয়েছিল যেসব রেট্রোভাইরাসের জেনোম, তারা আসলে গ্রাহক জেনোমে এসে নতুন নতুন কাজের দায়িত্ব পেয়েছে; যেমন, একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে একধরনের রেট্রেভাইরাসের জেনোম মস্তিষ্ক গঠনে কাজ করে।
মানবশরীরে বাস করা কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়ার কথা শুনে হয়তো শিহরিত হয়েছেন, কিন্তু এটা জেনে কী অবাক হবেন যে আমরা আসলে বহু বহু ভাইরাস দিয়েও তৈরি হয়েছি? আমাদের জেনোমের ৮ শতাংশ গঠিত হয়েছে অনেক অনেক রেট্রোভাইরাসের জেনোম দিয়ে। বলে রাখি, এইডস রোগ তৈরি করে যেই ভাইরাস, HIV, সেটা একটা রেট্রোভাইরাস।
হয়তো নিজের স্বত্ত্বার একদম ভেতরে এরকম ভাইরাসের উপস্থিতি আমাদের জন্য ভাবতে কখনও কখনও ভীতিকর শোনায়, কিন্তু সেল রিপোর্টস পত্রিকায় প্রকাশিত নতুন একটি গবেষণা বলছে যে আসলে এসব ভাইরাস মানব মস্তিষ্ক গঠনে সাহায্য করেছে। আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরের নয় এমন আত্মীয়, ইঁদুরের জেনোমে কারিকুরি করে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যে মানব জেনোমে ঢুকে ভাইরাসগুলি আসলে নতুন নতুন কাজ পেয়েছে মানবদেহের জন্যই। ‘মস্তিষ্ককোষ অন্যান্য মানব কোষের তুলনায় বেশ জটিল’ বলছেন জোহান জ্যাকবসন, সুইডেনের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী, এবং গবেষণাপত্রটির একজন লেখক। তিনি সঙ্গে যোগ করছেন, ‘রেট্রোভাইরাসের সমবায় একে আরও জটিলতা এনে দিয়েছে, বিশেষ করে আমাদের জেনোমের এত বিশাল অংশ এদের দিয়ে গঠিত বলে।’
এবার বলি কিভাবে রেট্রোভাইরাস আমাদের জেনোমে ঢুকে যেতে পারে। রেট্রোভাইরাস অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে ভিন্ন, এদের জিনেটিক পদার্থ সম্পূর্ণরূপেই আরএনএ (RNA) দিয়ে গঠিত, এর এই সম্পূর্ণ আরএনএ কে সে গ্রাহক কোষে ঢুকিয়ে দেয় ডিএনএ (DNA) তে রূপান্তরিত হয়ে বংশবৃদ্ধি করার জন্য। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের ডিএনএ আমাদের ডিএনএ’র ভেতর ঢুকে যায়, কাচি দিয়ে একটা সুতা কেটে কাটা জায়গার মধ্যে আরেকটা সুতা ঢুকিয়ে আবার বেঁধে দিলে যেমনটা হয় তেমন ভাবে। আর রেট্রোভাইরাস যদি আমাদের জনন কোষ, যেমন শুক্রাণূ বা ডিম্বাণু আক্রমণ করে যেতে পারে তবে ভাইরাসের জেনোম পরবর্তী বংশধরের কাছে পৌছে যেতে পারে এবং সেখান থেকে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হতে হতে মানব জেনোমের অংশ হয়ে যায়। আর মিউটেশান (ডিএনএতে পরিবর্তন) এবং অন্যান্য ডিএনএ পদ্ধতির ফলে মানব জেনোমে ঢুকে যাওয়া ভাইরাসের জেনোম আর আমাদের জেনোম থেকে লাফ দিয়ে সরে অন্য গ্রাহকে যেতে পারেনা বা নিজের অণুলিপি নিজে আর তৈরি করতে পারেনা। অর্থাৎ ভাইরাসের জেনোমটা আমাদের জেনোমে বন্দি হয়ে থাকে। একে এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস বা অন্তর্ভূত রেট্রোভাইরাস বলে।
বেশিরভাগে অন্তর্ভূত রেট্রোভাইরাসের জেনোম এভাবে আজীবন কারাদন্ড পায়, এবং ডিএনএ মেথাইলেশান (DNA methylation) নামক একটি ডিএনএ পরিবর্তনকারী প্রক্রিয়ায় নিশ্চুপ হয়ে যায়, কোন কাজ করতে পারেনা। কিন্তু জ্যাকবসনের দল খুঁজে পেয়েছেন যে কোন কোন রেট্রোভাইরাসের জেনোম মাঝেমধ্যে জেল থেকে ছুটি নিয়ে বের হয়ে আসে (প্যারোলে বের হওয়া) আর দেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজও করে দেয়, যেমন মস্তিষ্কের গঠন হওয়ার প্রক্রিয়ায়। যেই প্যারোলের পুলিশ অফিসার ইঁদুরে এই কাজে সহায়তা করে সে একটি প্রোটিন, নাম TRIM28, যে রেট্রোভাইরাস কে আবার বন্দি করে ফেলে, তবে পরেরবার যেন আরও সহজে জেল থেকে ছুটি নিতে পারে এই শর্তে।
আসলে এভাবে অন্তর্ভূত রেট্রোভাইরাসের সাময়িক সময়ের জন্য ছুটি পাওয়াটা কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এই ছুটির সময়ে তারা কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবে, নতুন গবেষণা বলছে যে এরা ভ্রূণ থেকে মস্তিষ্ক গঠিত হতে সাহায্য করে। এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস আসলে একটি বড় ডিএনএ পরিবারের অংশ, যার নাম ট্রান্সপোসেবল এলিমেন্টস (Transposable Elements) বা ‘অদলবদলি’, যেগুলোকে এখনও ধরা হয় জিন-জঞ্জাল হিসেবে, কারন তাদের কাজ খুঁজে পাওয়া যায়নাই তেমন, আর ধারনা করা হয় তারা শুধু শুধুই জেনোমের অংশ দখল করে বসে আছে। এই গবেষণাগুলি আসলে আমাদের পূর্বধারনাকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে, দেখাচ্ছে যে এইসব জঞ্জাল আসলে জঞ্জাল নয়, বরং এদেরও কাজ আছে।
দারুণ সব ব্যাপার স্যাপার, তাইনা?
দৃষ্টি আকর্ষণ: আমি এখানে কিছু ইংরেজি শব্দের বাংলা ব্যবহার করেছি যেগুলি বাংলায় তেমন ব্যবহৃত হয়না, তবে ব্যবহার করতে করতে নিশ্চয়ই একসময় বিজ্ঞানে ব্যবহারের খুব সাধারন শব্দ হয়ে যাবে। অনুবাদে সচলায়তন লেখক হিমু সাহায্য করেছেন। এ ব্যাপারে মন্তব্য আশা করছি। শব্দদুটি হল:
Transposable elements: অদলবদলি এবং Endogenous retrovirus: অন্তর্ভূত রেট্রোভাইরাস
মূল সূত্র: http://www.scientificamerican.com/article/ancient-viruses-gain-new-functions-in-the-brain/?
Leave a Reply